E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আদর্শহীনতার অতলগহ্বরে বাংলাদেশ !!!

২০২০ নভেম্বর ২১ ১৭:১১:৩৬
আদর্শহীনতার অতলগহ্বরে বাংলাদেশ !!!

আবীর আহাদ


গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায় বিচার, সমাজতান্ত্রিক ও শোষণহীন সম্যজ, মানবিক মর্যাদাবোধ, আইনের শাসন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সন্রাস-ধর্মান্ধতা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ; সর্বোপরি বাঙালিত্ব----এসবই হলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার ।

আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে ১৯৭১ সালে আমরা বাঙালি জাতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে উপরোক্ত আদর্শ চেতনা ও অঙ্গীকারকে পাথেয় করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এদদশীয় রাজাকার অপশক্তির বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক রক্তাক্ত সমরে অবতীর্ণ হয়েছিলাম । অতঃপর ৩০ লক্ষ বাঙালির জীবনদান, তিন লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম ও দেড় লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধার সীমাহীন শৌর্য বীর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা । আর সেই স্বাধীনতাকে কেন্দ্র আমাদের সমাজ স্বাধীনতার পক্ষ ও স্বাধীনতার বিপক্ষ নামক দু'টি পরস্পরবিরোধী শক্তিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বিভক্ত হয়ে পড়ে ।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির খুশিতে আমরা স্বাধীনতার পক্ষশক্তি উদার মনোবৃত্তি নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে বলা চলে ক্ষমার দৃষ্টিতে নিয়েছিলাম । কিন্তু আমাদের সেই ক্ষমাকে আমাদের দুর্বলতা ভেবে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শক্তি তাদের অভিভাবক পাকিস্তান ও তার আন্তর্জাতিক মিত্ররা ভেতরে ভেতরে সুসংগঠিত হয়ে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী চার জাতীয় নেতাসহ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে । এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার ধ্বংসের কাজ শুরু হয় । পাশাপাশি দেশের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য অঙ্গন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধিতাড়নই শুধু নয়, কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে নানান মিথ্যা অভিযোগে হত্যা করা হয় । শুধু আওয়ামী লীগ নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, মো-ন্যাপ, জাসদ প্রভৃতি দলের নেতৃবৃন্দকে নানান মিথ্যা অভিযোগে কারারুদ্ধ করা হয় ।

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সকল প্রশাসনে রাজাকার আলবদর ও তাদের উত্তরাধিকারদের বসিয়ে দিয়ে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত করা হয় । এমনকি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিদিন সকাল বেলা বঙ্গভবনে প্রবেশ করেই হটলাইনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সাথে শলাপরামর্শ করেই তার দিনের কর্মসূচি শুরু করতেন বলে শোনা যেতো । এ সময় দেশের পরাজিত মোল্লাতন্ত্রকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামবিরোধী এবং রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিমালাকে কুফরি মতবাদ বলে অপপ্রচারের অবাধ লাইসেন্স দেয়া হয় ।

পত্রপত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধ করা হয় । এ সময় একশ্রেণীর ভাড়াটিয়া লেখক বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করে বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে, মাওলানা ভাসানীকে স্বাধীনতার আন্দোলনের নায়ক এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক ও দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে তারস্বরে প্রচার শুরু করা হয় । পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীকে প্রকাশ্য রাজনীতি করার অনুমতি প্রদান করা হয় । দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজাকারদের মন্ত্রিপরিষদে স্থান করে দিয়ে জেনারেল জিয়া দেশকে বলা চলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যান ।

এভাবেই জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের বুকে আরেকটি মিনি পাকিস্তান সৃষ্টি করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ফেলে-যাওয়া জাতীয়করণকৃত শিল্প কলকারখানা ব্যাঙ্ক বীমাসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান সাবেক মালিকদের হাতে তুলে দেন । পাকিস্তান থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা এদেশে এসে সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আমলের বাঙালি উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে টাকা-পয়সা নিয়ে আবার পাকিস্তানে ফিরে যান । এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জেনারেল জিয়া তাদের কাছ থেকে তার পার্টি বিএনপির নামে বিপুল অর্থ কমিশন লাভ করেন । অপরদিকে রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতিকে জটিল করে দিয়ে নিজের একক ক্ষমতা পাকাপোক্ত রাখার লক্ষ্যে ঐ অর্থ দিয়ে বিভিন্ন দলের রাজনীতিকদের ক্রয় করে তাদের দিয়ে বিএনপিকে সাজান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে দুর্বল করার জন্য অর্থ ছিটিয়ে সেই দলের মধ্যে আন্ত: দলীয় কোন্দল সৃষ্টি করেন যাতে কোনো দল তার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘটিত করতে না পারে । অন্যদিকে ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে বিপুল অর্থ, মাদক ও অস্ত্র তুলে দিয়ে দেশকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করেন যাতে অন্য কোনো দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে দাঁড়াতে না পারে ।

দেশের বুকে এ অবস্থা যখন চলমান, এ সময় বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসেন ।
পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-শ্রমিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তির দীর্ঘ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসে । প্রাথমিক দিকে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হলেও তার অভ্যন্তরে একটি দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাচক্রের উত্থান ঘটে । সে-উত্থানের ধাক্কায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সৎ মেধাবী ও ত্যাগী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী-শুভানুধ্যায়ীরা ছিটকে পড়ে । নেতৃত্বের সীমাহীন ক্ষমতার লোভ, উগ্র-আর্থবৈষয়িক চিন্তাচেতনা, আত্মীয়তা ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের টানে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ অপশক্তি, বিভিন্ন দলের অপরাধীচক্র, সমাজের বিষধর দুর্নীতিবাজ, শেয়ারবাজার-ব্যাঙ্ক লুটেরা ও মাফিয়া দুর্বৃত্তচক্র বিপুল অর্থ ছিটিয়ে আওয়ামী লীগের দুর্নীতিপরায়ণ নেতাদের মাধ্যমে দলের মধ্যে ঢুকে পড়ে । তারা দলের মধ্যে ঢুকে পর্যায়ক্রমে দলের বিভিন্ন স্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেয় এবং অনেকেই এমপি মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পদেও আসীন হন । আর এভাবেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার মুখ থুবড়ে পড়েছে ।

বর্তমান আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতারণার কৌশল হিশেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গালভরা শ্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বলে নিজেদের চিহ্নিত করলেও তারা মূলত: স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির কাজগুলোই করে যাচ্ছে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা এখন তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে ! বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে প্রশাসনকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অবস্থানে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের ষোলকলা পূর্ণ করা হয়েছে ।

অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে একটা গোঁজামিল সংজ্ঞায় অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি হাজার হাজার রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করা হয়েছে । যে মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত-----যাদের ত্যাগের বিনিময়ে জীবনে যিনি যা কল্পনাও করেননি তিনি তাই হয়েছেন হচ্ছেন ও হতে থাকবেন-----সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজের সৃষ্টির সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছেন । এসব জাতীয় অপরাধ ও অপকর্ম বিএনপি-জামায়াত জোট করতে পারে, কারণ তাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা আশা করা যায় না ! কিন্তু আওয়ামী লীগ এ জাতীয় অপরাধ ও অপকর্ম করে কোন আক্কেলে, তা আমাদের কাছ কোনোক্রমেই বোধগম্য নয় ।

এভাবেই বলা যায় যে, আজ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পদদলিত করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাকে ধূলিসাত্ করে তারা স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মান্ধ অপশক্তিকে খুশি করে চলেছে ! আরো পরিষ্কার করে বলা যায় যে, স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির যেসব সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অপরাধ করার কথা, সেগুলো তারাই অত্যন্ত সুচারুরূপে করে যাচ্ছে । অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্বাধীনতাবিরোধী হেফাজত ও চরমোনাই সমিতির মোল্লারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার লাগামহীন হুমকি দিলেও আজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে গভীর নীরবতা পালন করে প্রমাণ করছে যে, তারা ঐসব মোল্লাদের ভয় পান ! এতেই বুঝা যায় দল হিশেবে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার তাদের নৈতিক ভিত নষ্ট করে ফেলেছেন । সুতরাং এখন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে কিছুই নেই ! কোনো রাজনীতি নেই, কোনো নীতি, আদর্শ ও তন্ত্রমন্র নেই-----আছে শুধু একটি মাত্র অপ-আদর্শ, আর সেটি হলো : রাষ্ট্রীয় অবাধ ক্ষমতা, দুর্নীতি, লুটপাট, ধর্মান্ধতা ও মাফিয়াতন্ত্র ! অর্থাত্ বাংলাদেশ আজ আদর্শহীনতার অতলগহ্বরে হাবুডুবু খাচ্ছে !

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test