E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

উপজেলাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব প্রশাসনিক দপ্তর স্থাপন প্রসঙ্গে

২০২১ মার্চ ১২ ১৬:৪৩:৫৪
উপজেলাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব প্রশাসনিক দপ্তর স্থাপন প্রসঙ্গে

আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়টি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতোই সরকারের একটি প্রশাসনিক বিভাগ । অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতোই এ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী, সচিব, অতি:সচিব, যুগ্মসচিব, উপসচিব, সহকারি সচিব ও অন্যান্য কেরানিকুল ছাড়াও অধিদপ্তরের মর্যাদায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল নামক একটি সংস্থা রয়েছে । সেখানেও একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মতো বিরাট জনবলসম্পন্ন প্রশাসন রয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ পৃথক একটি মন্ত্রণালয় হওয়া সত্বেও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতো এ মন্ত্রণালয়ের জেলা, উপজেলা ও থানাভিত্তিক কার্যালয় নেই । প্রতিটি জেলা উপজেলা ও থানায় প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব প্রশাসনিক কার্যালয় রয়েছে, যেমন উপজেলা জনপ্রশাসন, উপজেলা শিক্ষা, উপজেলা স্বাস্থ্য, উপজেলা সমাজসেবা, উপজেলা ভূমি, উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রভৃতি ইউনিট কার্যালয় ।

সেখানে সরকারের তথা জাতীয় চেতনাদৃপ্ত মন্ত্রণালয় বলে খ্যাত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জেলা, উপজেলা বা থানা পর্যায়ে নিজস্ব কোনো প্রশাসনিক ইউনিট নেই ! মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও অন্যান্য অসুবিধাদির সমাধান এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নমূলক কাজ করতে হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার দপ্তরকে । উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা সমাজসেবা ইউনিটের লোকবল এমনিতেই কম । এদের ওপর আবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কার্যাবলি চাপিয়ে দেয়ার ফলে কাজের চাপে কোনো কাজেই গতি আসে না । অপরদিকে চেতনাগত একটা বিষয়ও এখানে কাজ করে । উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা বলুন, আর সমাজসেবা কার্যালয়ের কথা বলুন---- প্রায় সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও দুর্নীতিবাজরা বসে আছে । তারা নানান ইঞ্জিনিয়ারিং করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বিলম্বিত করা, তাদের নাম-ঠিকানা ভুল বানানে লেখা ইত্যাদি কারসাজি করে ঝামেলায় ফেলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি একধরনের প্রতিহিংসা চরিতার্থসহ এসব সমস্যার সমাধানের অজুহাতে অবৈধ অর্থ আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে থাকে ।

বেশকিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সমাজসেবা কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী একে অপরের যোগসাজশে অমুক্তিযোদ্ধা বা অস্তিত্বহীন মুক্তিযোদ্ধার নামে ভাতা উত্তোলন করে তা ভাগবাটোয়া করে আত্মসাত করে খায় । বিশেষ করে সাম্প্রতিক সমাপ্ত MIS প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উপজেলা সমাজসেবা দপ্তর একটি জঘন্য কার্যকলাপ করেছে । তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য বিকৃতি ঘটিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে । MIS এর প্রয়োজনে নিশ্চয়ই কোনো মুক্তিযোদ্ধা তাঁর নাম ধামসহ কোনো তথ্য বেঠিক দেননি । কিন্তু MIS-এ দেখা গেল অনেকের নাম আসেনি । আবার দেখা গেলো মুক্তিযোদ্ধার নাম, বাবার নাম, ঠিকানা ভুল । নামের বানানেও ভুল । কোনো মুক্তিযোদ্ধা তার নামধাম ঠিকানা ভুল করবেন বা ভুল বানানে লিখেছেন তা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয় । তথ্য বিভ্রাটের ফলে অনেকের ভাতা ডিজিটাল পদ্ধতিতে তাদের ব্যাঙ্ক হিসাবে ঢোকনি । পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ঠিকানায় বিকৃতি ঘটিয়েছে সমাজসেবা দপ্তরের কেরানি সাহেবরা, যাতে পরবর্তীতে তা সংশোধনের জন্য অর্থকড়ি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছে যান ।

অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে উপজেলা/থানায় কোনো চিঠি ও প্রজ্ঞাপন গেলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর/কেরানিরা সময়মতো নির্বাহী কর্মকর্তা বা সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছে পেশ করেন না । যেহেতু এসব চিঠি বা প্রজ্ঞাপনের ভেতর তাদের কোনো ব্যক্তিস্বার্থের বিষয় নেই, সেহেতু তারা সেগুলো গুরুত্বের সাথে দেখে না । এ জন্য দেখা যায় কম্পিউটার অপারেটর বা কেরানির কাছে মুক্তিযোদ্ধারা অনেকখানি জিম্মি থাকেন । তাদের গাফিলতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছুই বলা যাবে না ! প্রতিবাদ করলে বলা হয় মুক্তিযোদ্ধারা ভালো না, তারা দুর্ব্যবহারকারী ! যেহেতু এসব কাজগুলো কেরানি সাহেবদের দাপ্তরিক কাজ না হলেও তারা দয়া করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করে থাকেন-----এ বাড়তি কাজের বিনিময়ে তারা সরকারের কাছে থেকে কোনো বাড়তি বেতন বা ভাতা পায় না । ফলে তারা কায়দা-কৌশল করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঝামেলায় ফেলে দিয়ে তা থেকে তাদের উদ্ধার করার বিনিময়ে কিছু অর্থ হাতিয়ে নেয় বলে ভুক্তভোগীরা এ"তথ্য জানিয়েছেন। সুতরাং সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক যে ভাতাটি দেন, এসব ঝামেলা থেকে মুক্তির উপায় হিশেবে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভাতার একটা অংশ কেরানিদের দিয়ে আসেন ।

সুতরাং একটা স্বাতন্ত্র্য মন্ত্রণালয় হিশেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জেলা উপজেলা ও থানায় তাদের নিজস্ব প্রশাসনিক ইউনিট থাকা একান্ত জরুরি ও বাঞ্ছনীয়। তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এসব প্রশাসনিক ইউনিট গঠন করা প্রয়োজন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্মদের সমন্বয়ে । জেলা উপজেলা ও থানায় অন্যান্য মন্ত্রণালয় যেভাবে তাদের প্রশাসনিক স্তর বিন্যাস করেছে, অনুরূপ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কেও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বার্থে ঐ পর্যায়ে তাদের শাখার বিস্তৃতি ঘটাতে হবে ।

আজ প্রায় ২০ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় চলছে । অথচ একটা গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাতন্ত্র্য মন্ত্রণালয় হিশেবে তার কোনো অধিদপ্তর, জেলা, উপজেলা ও থানায় কোনো প্রশাসনিক ইউনিট নেই । এ মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় কাজগুলো চলছে অন্যান্য দপ্তর, যেমন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সমাজসেবা দপ্তরের মর্জির ওপর । বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এবং প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রিপরিষদ, জনপ্রশাসন ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ঊধর্তন কর্মকর্তাদের মাথায় এতোকালেও এ বিষয়টি ঢুকলো না, তা ভাবতে অবাক লাগে ! মূলত: অন্যান্য লাভজনক মন্ত্রণালয়ে লুটপাট ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকার ফলে আর্থিকভাবে লাভহীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তথা মুক্তিযোদ্ধাদের সুখ-দু:খ হৃদয় দিয়ে অনুভব করার মতো রাজনৈতিক নেতা এমপি মন্ত্রী ও আমলার সকরুণ অভাব এ অব্যবস্থার জন্যে দায়ী । আসল কথা হলো, যাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কাজ করে না তারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উচ্চাসনে বসে আছে যাদের মূল লক্ষ্য: ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে লুটপাট করা ।

এ রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও প্রশাসনিক কারণে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সরকারের মধ্যে বিমাতৃসুলভ আচরণের শিকার হচ্ছে । বিশেষ করে আরো দু:খজনক সত্য এই যে, এ যাবত্কালে যাদেরকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়েছে তারা সবার সেরা অযোগ্য মন্ত্রী হিশেবে পরিগণিত হয়েছেন ! এর অর্থ : এ মন্ত্রণালয়টি সরকারের গুডবুকে নেই, ফলে মন্ত্রী হিশেবে যোগ্য কোনো লোক এখনে নিয়োগ করা হয়নি । এর কারণ, সরকারের মানসিকতাস । সব সরকার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নানাভাবে ভোগ করে আসছেন, কিন্তু তারা কেউ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মহিমার মূল্য দিতে কার্পণ্য করে আসছেন । এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, সরকার ও সরকারের বাইরে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠী যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত নয়-----কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজাকারিত্বের সাথে জড়িত----সেহেতু তারা মুক্তিযুদ্ধের মহিমা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা দিতে মনে বড়োই কষ্ট পান । আসলে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি একধরনের হীনমন্যতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পরশ্রীকাতরতা প্রকাশ করতে যেয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এসব জটিলতার জন্ম দিয়েছেন ।

সুতরাং মুক্তিযুদ্ধেবিষয়ক জটিলতা নিরসন ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক কল্যাণে সরকারকে অনতিবিলম্বে জেলা, উপজেলা ও থানায় থানায় অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আদলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শাখা দপ্তর স্থাপন করতে হবে এবং এসব দপ্তরে যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মরা চাকরি পান তারও ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্যে আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি । এছাড়া পর্যায়ক্রমে মুক্তিযুদ্ধেবিষয়ক মন্ত্রণালয়কেও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মের দ্বারা পরিচালিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে । কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি হীনমন্যতা ও পরশ্রীকাতরা পোষণকারীদের দ্বারা অতীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিড়ম্বনাই শুধু বেড়েছে, এখন বৃদ্ধ ও শেষ বয়সে আর কোনো অবস্থাতেই তারা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে রাজি নন ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test