E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দিকভ্রান্তির কবলে আওয়ামী লীগ

২০২১ মার্চ ৩০ ১৩:১৬:২১
দিকভ্রান্তির কবলে আওয়ামী লীগ

আবীর আহাদ


অর্থের লালসা, আত্মীয়প্রীতি ও অপরাজনীতির দোলাচলে আওয়ামী লীগ আজ বিভ্রান্ত । ক্ষমতার অন্ধমোহে স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত- হেজাজত, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকার ও তাদের সন্তানদের আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দলটিকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে দাঁড় করানো হয়েছে ! আর সবচেয়ে যে শঙ্কাটি বিরাজ করছে, তাহলো, রাজাকারদের সন্তানেরা আওয়ামী লীগে অবস্থান নিয়ে সবার আগে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে নিশানা করেছে ।

মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধারা বহু রাজাকারকে হত্যা করেছিলো, পাদানী মার দিয়েছিলো । আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিলো । সেটিকে মাথায় রেখে রাজাকারদের সন্তানেরা তাদের বাপ-দাদাদের হত্যা ও তথাকথিত অপমানের প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে । ইতিমধ্যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে । অনেকের বাড়িঘর দখল করেছে । অগ্নিসংযোগ করেছে । মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ওপর ক্রমাগত নানাবিধ অত্যাচার ও নিপীড়ন চলছে ।

এখানেই শেষ নয় । মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়া রাঘব বোয়ালরা দলের প্রভাবশালী অবস্থানেই শুধু নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় তথা এমপি মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পদেও তারা আজ আসীন হয়েছে ! আরো আছে অপদার্থ ও ভোদাই টাইপের কিছু এমপি-মন্ত্রী ! এরা যে কী যোগ্যতায় এসব অবস্থানে আসন লাভ করেছেন তা দেশের কেউ জানেন না । এর পাশাপাশি দলের জন্য অতীতে যারা অবদান রেখেছেন, মুক্তিযোদ্ধা, সৎ, ত্যাগী ও মেধাবী মানুষগুলো ঐসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের কনুইয়ের ধাক্কায় কোথায় হারিয়ে গেছে, সেসবেরও কোনো খোঁজখবর কেউ রাখে না !

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগের এসব অবস্থার দায় ও দায়িত্ব অবশ্যই আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের ওপর বর্তায় । অনেকে যুক্তি দেখান, সৎ ত্যাগী ও মেধাবীদের দিয়ে নাকি দল ও রাষ্ট্র চলে না ! একথা তারা কোন নিক্তিতে মেপে বলেন তা আমরা বুঝি না । নিকট অতীত থেকে অদ্যাবধি কি দল ও দেশ পরিচালনা করার কাজে ঐ সৎ ত্যাগী ও মেধাবীদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে ? হয়নি বললেই চলে । তাহলে দলে ও সরকারে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের প্রাধান্য দিয়ে ঐসব আন্দাজি কথা বলে প্রকৃতপক্ষে কীসের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয় তা বুঝতে কারো বাকি থাকে না ।

মূলত: রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ঐসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের যোগসাজসে ভাগাভাগি করে লুটপাট করাই হলো লক্ষ্য । এই ভাগাভাগির লুটপাটের হোলিখেলায় দেশের মধ্যে তরতরিয়ে তথাকথিত ধনিক শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে----দেশের সব সম্পদ মুষ্টিমেয় লুটেরাদের হাতে চলে যাচ্ছে । সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে চরমতম বৈষম্য ও আর্থসামাজিক অরাজকতা । যার প্রভাবে সামাজিক সম্প্রীতি, নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে ।

আওয়ামী লীগ সরকারের সবচে বড়ো ভুল ও অপরাধ এই যে, তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে যাওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যাদের কোনোই সংযোগ ছিলো না বা স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ছিলো, তারা বিএনপি-জামায়াত সরকারের অনুসৃত পথ অনুসরণ করতে গিয়ে তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে ! কী আশ্চর্য, তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের ১৯৭২ সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে একটি গোঁজামিল সংজ্ঞার অবতারণা করার ফলে তার দলের নেতা এমপি মন্ত্রীসহ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ----এবং বর্তমানে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির সুযোগ গ্রহণ করে চলেছে ! ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির অর্থ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থের লালসা, আত্মীয়প্রীতি ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি । বিএনপি-জামায়াতের ঐসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের লালন এবং তার সরকারের হাতে সৃষ্ট হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরির অপবাদ ও অপরাধে আওয়ামী লীগকেও ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে ।

এছাড়া বাঙালির বিগত হাজার হাজার বছরে মধ্যে সবচাইতে বড়ো গৌরবোজ্জ্বল ও মর্যাদাপূর্ণ অধ্যায়ের রূপকার----স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ----যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক সর্বাত্মক সশস্ত্র রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরাক্রমশালী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছিলো, তাদের ঐতিহাসিক অবদানের স্বীকৃতি জাতীয় সংবিধানে না দিয়ে যে মারাত্মক ভুল ও অপরাধ করে আসছে, সেজন্যও আওয়ামী লীগকে ইতিহাসের কাছে জবাবদিহি করতে হবে ।

সবকিছু পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, যে-দলটির সাথে দেশের সব দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের আবেগ-অনুভূতি, আশা-আকাঙ্খা জড়িত, জড়িত দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন ----সে-দলটি আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকটি হারিয়ে ক্রমান্বয়ে অজানা এক অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে !

ঠিক এ-অবস্থায় দলটির কাঁধে চড়ে বসেছে আরেক অন্ধকারের অপশক্তি, যার রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে দেশকে ধর্মীয় কূপমণ্ডকতার জালে আঁটকে দেশের বুকে একটি ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে স্বাধীনতাকে হরণ করা । আর সেই অপশক্তিটি হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম । তারা সরকারের ঘাড়ে চড়ে দেশের সর্বত্র ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে দেয়ার মতলব নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে ।

সরকারের আপোসকামিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় হৃষ্টপুষ্ট-হওয়া স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গি হেফাজতে ইসলামের কুত্তাতাণ্ডব দেখার জন্যে মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে রয়নি । যে হেফাজত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার নির্জাস রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কুফরি মতবাদ বলে আখ্যায়িত করে----যারা বাংলাদেশের সংবিধান, জাতির পিতা, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত মানে না----যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দিতে চেয়ে কোথাও কোথাও অপমানজনক ভাঙচুর করে, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে তথাকথিত ইসলামী সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তরিত করছে----যারা ধর্মান্ধতার উন্মাদনায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও অত্যাচার করে আসছে----সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে রক্ত ও জীবনসহ সবকিছু দিয়ে সহযোগিতাকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিকে ঠেকানো ও তাঁকে অপমান করার মানসে কয়েক দিন ধরে ধারাবাহিক হুমকি ধামকি করে গত ২৭ ও ২৮ মার্চ সারা দেশে বিক্ষোভ ও হরতালের নামে সারা দেশে বিভীষিকাময় জ্বালাও পোড়াও ও জনজীবন বিপর্যস্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি----তারা কোথাও কোথাও নাঙ্গা তরবারি হাতে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ও জনগণের ওপর চড়াও হয়েছে; কোথাও কোথাও বঙ্গবন্ধুর ছবি-ভাস্কর্য গুড়িয়ে দিয়েছে, জাতীয় পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেছে। এরা মূলত: তথাকথিত ইসলামী জোসে নরেন্দ্র মোদি ঠেকাও---এর পাশাপাশি অন্তরালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানকে পণ্ড করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিলো ।

কারণ বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিকে তারা তাদের পূর্বসূরি হানাদার পাকিস্তানিদের সাথে এদেশীয় দালাল রাজাকার আলবদর আলশামস ও আলমুজাহিদ বাহিনীর পরাজয়ের গ্লানিতে তাড়িত হয়ে, পাকিস্তানের ইন্ধনে ঐসব পৈশাচিক কার্যকলাপ করেছে । ভারতে নরেন্দ্র মোদী তথাকথিত মুসলমানদের ওপর কী করেছে, সেটাকে পুঁজি করে তারা কেনো ভারত মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করে তাদের সাধের পাকিস্তান ভেঙে ছিলো----সে-কারণেই তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে । এতসব অপরাধ ও অপকর্ম করেও এ সংগঠন ও এর জঙ্গি নেতৃত্বকে কেনো যে আওয়ামী লীগ সরকার এখনো সহ্য করে চলেছে তা ভাবতে অবাক লাগে।

অপরদিকে ইসলাম ধর্মের সোল এজেন্সি নিয়ে এই স্বাধীনতাবিরোধী হেফাজতে ইসলাম কে কাফের, কে মুরতাদ, কে মুসলিম, কে মুসলিম নয়----কে আস্তিক, কে নাস্তিক ইত্যাদি বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে ধর্মের নামে দেশের বুকে হানাহানি ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে চলেছে । তাদের মতলব না-বুঝে সরকারও তাদেরকে মাথায় তুলে নিচ্ছে । যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাজাত শিক্ষা ও সংস্কৃতি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার কথা, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধর্মীয় অপচেতনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে ।

দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে তথা ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে যেখানে সাধারণ্যের মনোজগতকে বিকশিত করার লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাভিত্তিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন, সেখানে সরবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে ইসলাম ধর্মের আবরণে ধর্মান্ধ ও জঙ্গিবাদী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান----যার মূল লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে নস্যাত্ করা । এ-বিষয়টি যদি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে আমাদের সান্ত্বনার জায়গাটা থাকে না । আর এ-অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা চরম দিকভ্রান্তি বৈ কিছু নয় ।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test