E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুখোশধারী চেতনাবাজ ও লুটেরাদের উচ্ছেদ করতে হবে

২০২১ আগস্ট ৩০ ১৪:১৯:২৫
মুখোশধারী চেতনাবাজ ও লুটেরাদের উচ্ছেদ করতে হবে

আবীর আহাদ


রাষ্ট্র ক্ষমতার সাথে জড়িত কিছু মানুষ আছেন। তারা মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু দয়াদক্ষিণা দিয়ে তারা অনেক পুণ্যের কাজ করে ফেলেছেন! এটাই তো তাঁদের  বড়ো সম্মান! আর সম্মান দেয়ার কী আছে? তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই, যারা এসব বলেন, ভাবেন, তারাই বা মুক্তিযুদ্ধের সময় কী ভূমিকা রেখেছেন, কী হতে চেয়ে কী হয়েছেন? মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সব সামর্থ্য থাকলেও জীবনের মায়ায় তারা মুক্তিযুদ্ধে যাননি। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরুদ্বিগ্নে সংসার করেছেন। হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর ভয়ে মায়ের আঁচলতলে ঠাঁই নিয়েছেন। নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে জীবন যাপন করেছেন। পাকি সরকারের হুকুম তালিম করে অনেকে চাকরি করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। অনেকে পাকিদের সবরকম খেদমতও করেছেন। রাজাকার আলবদর হয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে পাকিদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। লুটপাট অগ্নিসংযোগ ধর্ষণসহ নানান অপকর্মও করেছেন।

দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর তারাই বিভিন্ন সময় টাকা, রাজনৈতিক শক্তি ও আত্মীয়তার জোরে মুক্তিযোদ্ধাও সেজেছেন। আর আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন! কেউ কেউ একাত্তরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েও নিজের সাবেক সামরিক বাহিনীর পরিচয় গোপন করে অর্থ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বিস্ময়করভাবে বেসামরিক গেজেটে বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন! আর যে প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা বানানো হচ্ছে তাতে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা বানানো হতে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সংজ্ঞা এবং সুরক্ষা আইন না থাকার ফলে যত্রতত্র যে-কেউ অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা দেড় লক্ষের নিচে। কিন্তু ইতিমধ্যে সরকারি তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো। এর মধ্যে বিরাট সংখ্যক রাজাকাররাও ঠাঁই পেয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তারা অমুক্তিযোদ্ধাসহ রাজাকারদের যেমন মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগ সরকার একনাগাড়ে আজ তেরো বছরেও দেদার অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই ৭২ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংজ্ঞা প্রদান করেন। সেই সংজ্ঞায় বলা হয়েছিলো : "মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো একটি সশস্ত্রবাহিনীর (ফোর্স) অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।" এ সংজ্ঞাটি ছিলো সত্যিকার অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংজ্ঞা। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা মানেনি, তেমনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও মানছে না। কেনো মানছে না, তার কারণ আগেই বর্ণনা করা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রণয়নের দাবিতে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে আমরা সর্বপ্রথম একটি আন্দোলনের সূত্রপাত করি। সেই আন্দোলনের প্রয়োজনে আমরা বিভিন্ন সময় সভা, সমাবেশ, আলোচনা সভা, মতবিনিময় সভা, সংবাদ সম্মেলন, অবস্থান কর্মসূচি, পদযাত্রাসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করেছি। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সঠিকভাবে প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি উচ্চতর বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমিশন গঠনের সুপারিশও পেশ করেছি। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার কোনোই প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের নামে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল যে প্রক্রিয়ার অবতারণা করে আসছেন, তাতে উগ্র বাণিজ্যিক ধান্দার সুযোগ নিয়ে ভুয়ারা পুনরায় তালিকায় ফিরে এলেও অনেক প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা বঞ্চিত হচ্ছেন।

আর ইদানিংকালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সরকারের অবহেলা ও আচরণসহ সারা দেশে সরকারি দলের সমর্থকরা যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারবর্গের ওপর হত্যা হামলা মামলাসহ অত্যাচার করে চলেছে, তাতে সরকারের মধ্যেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দেয়ার শেষ পরিণতি হিশেবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকমহল অভিমত ব্যক্ত করেছেন! আওয়ামী লীগ এখন দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্র, লুটেরা, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও হাইব্রিডেদর নিয়ে পথ চলছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার যে সর্বনাশা কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার একটি অপমৃত্যু সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে। কী পরিতাপের বিষয় যে, আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে মুজিবনগর সরকারের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা কাটঅফ ডেট ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা বাতিল হয়! মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়! বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পত্তি বিক্রির পাঁয়তারা চলে! আসলে এসব করা হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা অবমূল্যায়ন, যাকে তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানো ও লুটপাট করে খাওয়ার লক্ষ্যে। এসব অপকর্ম বিএনপি-জামায়াত, জাতীয় পার্টি করতে পারে।কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধের প্রতি তারা দায়বদ্ধ নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আওয়ামী লীগ সরকার এ-সব করে কিসের লক্ষ্যে এ প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সব মানুষের মনে বেদনার অনুরণন সৃষ্টি করে।

মুক্তিযোদ্ধারা দেশটি স্বাধীন করেছিলো বলেই যারা যা কল্পনাও করেননি তারা তাই হয়েছেন। ক্ষমতা খাটিয়ে, ঘুষ-কমিশন খেয়ে, ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে প্রতারণার আশ্রয়ে শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের মহোৎসব চলছে! লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। রাজনীতি এখন আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র আজ দেশের ভাগ্যবিধাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যারা দুর্নীতি ও লুটপাটের অপকর্মের সাথে জড়িত তারা যে জীবনে বেঁচে থেকে এতসব ধনসম্পদ অর্জন করলেন অনেকেই রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী বিচারপতি স্পিকার মন্ত্রী এমপি সচিব জেনারেল ব্যবসায়ী শিল্পপতিসহ অন্যান্য সবকিছুই হয়েছেন হচ্ছেন ও হবে এটাও কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দয়ার দান! অথচ তাদের হাতেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা দলন-পেষণ চলছে!

তবে একথাও ঠিক, মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বনে-যাওয়া বিশাল ধনীদের অনেকেই গালভরা শ্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জয়গান করেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ও তাদের দাবিদাওয়া সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও একটি কথা বলেন না! তারা মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছি, আর কী? রাজনৈতিক সামাজিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে জেত উঠেছি, মরার পরে পাবো রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার, বংশপরম্পর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বলে সম্মানিত হবে! তারাই আবার অপর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করেন না! এরা আসলে প্রতারক। দ্বিচারী ও বর্ণচোরা। সুবিধাবাদী। মুখোশধারী। মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাদের অন্তরে বিষ! তারা মনে করে, দরিদ্র ও অশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা হবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতীয় বীর? এটাই তাদের পরশ্রীকাতরতা। হিংসা। মূলত: মুক্তিযুদ্ধের নামে ক্ষমতা এবং ক্ষমতায় থেকে দু'হাতে লুটপাটই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।

রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদেরও একটি আদর্শ আছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এসব মুখোশধারীদের আদর্শ বলতে কিছু নেই। পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান-দলন এবং মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতায় বসে দুর্নীতি-লুটপাট করাই তাদের আদর্শ। মূলত: এসব মুক্তিযুদ্ধের মুখোশধারীরা রাজাকারদের চাইতেও নিকৃষ্ট মনের অধিকারী!

যতোদিন সমাজ ও রাষ্ট্রে এ-ধরনের মুখোশধারী প্রতারক ও বর্ণচোরারা থাকবে, ততোদিন এ-সমাজে, এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা নেই। দেশের উন্নয়নের নামে লুটেরাদের উন্নয়ন হবে। কিন্তু জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন হবে না। নৈতিকতা ও চরিত্রের উন্নয়ন হবে না।

দেশের জনগণ, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত যুবসমাজসহ সমাজশক্তিকে সর্বাগ্রে সংগঠিত হয়ে এই প্রতারক, লুটেরা ও বর্ণচোরারাদের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এদেশটি সবার। মুক্তিযোদ্ধারা দেশটি স্বাধীন করে দিয়েছেন, তারা এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, তারা আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে দুর্বল। শুধু তাদের দিকে চেয়ে থাকলে চলবে না। একজীবনে সবকিছু হয় না। তারপরও তো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে কলম ও সাংগঠনিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন যুবসমাজ ও সমাজশক্তির দায়িত্ব দেশটাকে মুখোশধারী প্রতারক ও লুটেরাদের হাত থেকে উদ্ধার করা এবং তাদেরকে উচ্ছেদ করা।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test