E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কী ছিল নাইন-ইলেভেনের নেপথ্যে

২০১৪ সেপ্টেম্বর ১১ ১৩:৫৫:৫০
কী ছিল নাইন-ইলেভেনের নেপথ্যে

ড. কাজল রশীদ : নাইন-ইলেভেনের নেপথ্যে কী ছিল আজও তা পরিষ্কার হয়নি। দোষারোপ করা হয়েছে; কিন্তু যুক্তিতর্ক সহযোগে স্পষ্ট করা হয়নি কে বা কারা ছিল নাইন-ইলেভেনের হোতা। আর কেনই বা তারা ভয়ঙ্কর এ কাজটি করেছিল। যুদ্ধ ছাড়া পৃথিবীতে এরকম অপ্রকাশ্য আক্রমণের দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ নেই। নাইন-ইলেভেন সংঘটিত হওয়ার পরপরই এর জন্য দায়ী করা হয়েছিল জঙ্গি সংগঠন আল কায়দাকে; কিন্তু আল কায়দাপ্রধান লাদেনের দাবি ছিল, ‘আমি বা আমরা এ কাজ করিনি। তবে যারাই করুক আমরা এ ঘটনায় আনন্দিত।’ কী ভয়ঙ্কর কথা।

নাইন-ইলেভেনের ১৩ বছর পূর্ণ হলো বৃহস্পতিবার। নিহতদের স্মরণে এবারও জানানো হয়েছে শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এ রুটিনওয়ার্ক ফি বছর অব্যাহত থাকলেও আজ অবধি জানা যায়নি এর প্রকৃত রহস্য। ফলে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি কী ছিল নাইন-ইলেভেনের মনে, আর এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আক্রমণকারীরা আমেরিকাকে কী বার্তাই বা দিতে চেয়েছিলেন। নাইন-ইলেভেনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি রোষানলের শিকার হয়েছে মুসলমানরা। তাদের প্রতি সব সময় অভিযোগের তীর ছোড়া হয়েছে। যদিও এর পেছনে শক্তিশালী কোনো যুক্তি এখনও উপস্থাপন করা হয়নি। তবে আমেরিকার ওই অভিযোগ আমলে নেয়নি নোয়াম চমস্কি, ফিনিয়ান কানিংহাম কিংবা মিচেল চসুডোভস্কির মতো লেখক-গবেষকরা। তারা নাইন-ইলেভেনের অন্যরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পুরো ঘটনার গভীরে প্রবেশ করে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন কারা নাইনে-ইলেভেন ঘটাল, কেন ঘটাল আর তাদের উদ্দেশ্যই বা কী ছিল।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আমেরিকা অসম্ভব প্রতিশোধপরায়ণ একটি দেশ। তার স্বার্থের কাছে পৃথিবীর সবকিছু অতি তুচ্ছ। আমাদের নিশ্চয় মনে আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছোট্ট একটা ভুলের জন্য কী খেসারতই না দিতে হয়েছিল মহামতি গৌতম বুদ্ধের অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী জাপানের সাধারণ জনগণকে, যার মাসুল আজও দিতে হচ্ছে দেশটির দুটি শহর হিরোশিমা-নাগাসাকিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাল হারবার নামে মার্কিন নৌঘাঁটি ছিল আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে বেশ দূরের জায়গা প্রশান্ত মহাসাগরের একটা দ্বীপে। সেখানে ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান বিমান হামলা করে, যার মধুর প্রতিশোধ নেয় আমেরিকা ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে আণবিক বোমা হামলা করে। কোনো যুদ্ধে আণবিক বোমা ব্যবহারের এখন পর্যন্ত একমাত্র উদাহরণ আমেরিকা। লক্ষণীয়, তারা হিরোশিমায় ‘লিটল বয়’ নামের আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেই বুঝতে পেরেছিল এর ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসের পরিমাণ কতটা মানবসভ্যতাবিনাশী। তারপরও তাদের উন্মত্ততা প্রশমিত হয়নি। দু’দিনের ব্যবধানে তারা নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করে ‘ফ্যাটম্যান’ নামের দ্বিতীয় আণবিক বোমাটি। এই হচ্ছে আমেরিকা, আর এই হচ্ছে তাদের যুদ্ধের ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল।

হিরোশিমায় বোমা ফেলা হয়েছিল সকাল ৯টার আগে। তখন ছোট ছোট শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সময়। কর্মব্যস্ত মানুষ বেরিয়ে পড়েছিল যে যার কাজে। আকাশ ছিল বেশ পরিষ্কার, সকালটা ছিল আর দশটা স্বাভাবিক দিনের মতো। ওখানকার কেউই হয়তো জানত না এ সকালটা তাদের জীবনের শেষ সকাল। আর কোনোদিন তারা সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখবে না।

নাইন-ইলেভেনের সকালটাও ছিল বেশ ঝরঝরে। আমেরিকার শিশুরাও তখন যাচ্ছিল স্কুলে। কারণ হামলা দুটি ঘটেছিল সকাল ৯টার কিছুটা আগে ও পরে। এ হামলায় সংঘটিত হয় আমেরিকার তো বটেই বিশ্ব ইতিহাসের এক নজিরবিহীন ঘটনা। ছিনতাই করা হয় যাত্রীবাহী চারটি বিমান এবং নাটকীয়ভাবে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয় টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে। হোয়াইট হাউসও হামলাকারীদের টার্গেটে ছিল, তবে সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ১১ জন বাংলাদেশীসহ ৯৬টি দেশের প্রায় ৩ হাজার লোক প্রাণ হারান ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য এ সন্ত্রাসী হামলায়। আর তারপরই বদলে যায় গোটা বিশ্বের প্রেক্ষাপট। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে আফগানিস্তানের সামগ্রিক চিত্রই পাল্টে দেয় আমেরিকা। ইরাকেও ঘটে তাদের ইচ্ছামতো সব ঘটনা। প্রশ্ন ওঠে, বিশ্ব প্রেক্ষাপট বদল, আফগানিস্তান ও ইরাকে নৃশংসতা এবং অস্ত্র ব্যবসা অব্যাহত রাখতেই কি আমেরিকা নিজেই নাইন-ইলেভেনের জন্ম দিয়েছিল?

এ প্রশ্নের উত্তর না মিললেও এটা সবাই অবগত যে, আমেরিকা হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সুপার পাওয়ার। পৃথিবী নামক এ গ্রহের সব রাষ্ট্রকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা তার কাজ। বিশ্বকে ধমকিয়ে বেড়ানো, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ বাধানোর কাজটা বেশ নির্বিঘ্নে তারা করে চলেছে। অথচ আমেরিকা আগে এরকম ছিল না। কিছুদিন আগেও কোনোকিছু করতে বা বলতে হলে তাদের অনেক কিছু হিসাব-নিকাশ করে করতে হতো। অন্যরা কীভাবে নেবে সে ব্যাপারে গভীর চিন্তা করার প্রয়োজন হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এখন আর সে সবের বালাই নেই। এখন যেভাবে ইচ্ছা তারা পৃথিবীকে অশান্ত করে তুলছে। প্রশ্ন হলো, এ সব করে কি আমেরিকা শান্তিতে আছে? নাইন-ইলেভেনের ঘটনা নিশ্চয়ই তাদের শান্তিতে থাকার নমুনা নয়।

একটা গল্প এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য, আলেকজান্ডার অর্ধপৃথিবী জয় করার পর ভারতে এসে অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, এখানকার জৈন সাধুরা তাকে মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। এমনকি কেউ কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করছে না। বিষয়টা আলেকজান্ডারের মনে রেখাপাত করল। তিনি সাধুদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার তোমাদের আমার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই কেন? উত্তরে সাধুরা বলল, তোমার প্রতি আগ্রহের তো বিশেষ কোনো কারণ নেই। কারণ তুমিও মানুষ আমরাও মানুষ। পার্থক্য হলো অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তুমি অনেক শ্রান্ত ও বিচলিত এবং পৃথিবীর সবকিছু দখলের আশায় উন্মত্তও, যা আমাদের নেই। কারণ আমরা জানি, একটা মানুষের জন্য প্রয়োজন মাত্র সাড়ে তিন হাত জমি, এর বেশি নয়।

আমেরিকা এক অদ্ভুত রাষ্ট্র! এখানে এসে মিলেছে বহু মত ও পথ। আমেরিকা শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের নেপথ্য ইন্ধন ও মদদদাতা বারাক ওবামার দেশ। তেমনি আমেরিকা মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো বর্ণবিরোধী এক মহান নেতারও দেশ, যিনি ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ শিরোনামের বক্তৃতায় এবং জীবনকর্মের মধ্য দিয়ে আমেরিকার একটি প্রজন্মকে আশা ও স্বপ্নের সুতোয় বাঁধতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবার এ আমেরিকাতেই জন্মেছিলেন বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি রবার্ট ফ্রস্ট। কবি শামসুর রাহমানের সাধু অনুবাদে যার কবিতা আমাদের কৈশোরকে মুগ্ধ করেছিল গভীরভাবে। তার কবিতাতেই তো রয়েছে, I have promises to keep, And miles to go before I sleep.

আলেকজান্ডারের ইচ্ছা ছিল পৃথিবী জয় করার। তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এসে আমেরিকার সে ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। পৃথিবীকে তারা এক অর্থে হাতের মুঠোয়ই বন্দি করেছে। প্রশ্ন হলো, এতকিছুর পরও তারা কি নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে? নাইন-ইলেভেনের ত্রয়োদশ বর্ষপূর্তিতে জানতে ইচ্ছা করে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধবিগ্রহ ছড়িয়ে দিয়ে কতটা নিরাপদ আর নিশ্চিন্তে আছে আমেরিকা?

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test