E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা রাখা হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে

২০২১ অক্টোবর ২৫ ১৫:৩৩:৪৮
মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা রাখা হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে

আবীর আহাদ


মুক্তিযোদ্ধা তালিকা।এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্ন। এটা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বের প্রশ্ন। জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন। এটা নিয়ে ছলচাতুরি, গোঁজামিল ও জালজালিয়াতি চলবে না। চলতে দেয়া হবে না। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকাররাও স্থান পাবে----এসব কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া হবে না। ইতিমধ্যে প্রকাশিত পর্বভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা তালিকার গতিপ্রকৃতি দেখে এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকার নামে হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদের নামও মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে পরিগণিত হচ্ছে! বিশেষ করে তালিকার মধ্যে যখন ভারতীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের নাম প্রকাশিত না হলেও শুধুমাত্র গেজেট বা লাল তালিকার অনেক বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধার নাম চূড়ান্ত তালিকায় চলে আসছে, তখন তালিকাটা যে স্বচ্ছ হচ্ছে না, সেটাই প্রমাণিত হয়। আর প্রায় প্রতিদিনই তো জামুকা থেকে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবে মুক্তিযোদ্ধা পয়দা হচ্ছে!

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আন্দোলন, সংগ্রাম ও লেখালেখির পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ( জামুকা) গত কিছুদিন আগে বেসামরিক ও বাহিনী গেজেটধারীদের যাচাই বাছাইয়ের যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলো, সেটির ওপর আমরা দৃষ্টি রেখেছিলাম। যদিও গৃহীত যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আস্থা ছিলো না, তারপরও আমরা চেয়েছি যাচাই বাছাই হোক। তবে আমাদের কাছে খবর ছিলো, তাদের মনোনীত নতুন যাচাই বাছাই কমিটিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ২০১৭ সালের বিতর্কিতরা ধর্ণা দিয়ে পুনরায় কমিটিতে অবস্থান নিয়ে পুরাতন বাণিজ্যিক অভিজ্ঞতায় হাজার হাজার ভুয়াদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ নিয়ে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বলে সুপারিশ করেছে। যাচাই বাছাইয়ের তিন/চার মাস অতিবাহিত হলেও অনেক এলাকার ফলাফল কেন্দ্রে না আসার মূলেই ছিলো অর্থের খেলা! আর এসবের পেছনে শক্তি সাহস ও কলকাঠি নাড়ছেন স্থানীয় বেশকিছু আওয়ামী লীগ নেতা, এমপি, বড়ো বড়ো আমলা ও মন্ত্রীরা।

অপরদিকে এ তালিকার অমুক্তিযোদ্ধারা অর্থ নিয়ে একশ্রেণীর লোভাতুর ভারতীয় ও লাল তালিকার মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরঘুর করেছে! এ অবস্থায় বাণিজ্যিক ধান্দায় যাচাই বাছাই ভেস্তে গিয়ে ভুয়ারা আবার ক-তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে পুনর্বহাল হয়েছে। এর সব দায়-দায়িত্ব মন্ত্রী মহোদয়কেই নিতে হবে। এ অপ্রীতিকর অবস্থা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেজন্য মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতি আমার পরামর্শ ছিলো, যাচাই বাছাই এলাকার মধ্যে এনএসআই এসবি, ডিবি, ডিজিএফআই ও দুদকের গোয়েন্দা জাল বিস্তার করুন যাতে কমিটির কোনো সদস্য, অমুক্তিযোদ্ধা ও সাক্ষীরা আর্থিক লেনদেন করতে না পারে। এছাড়া যাচাই বাছাইকালে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনসহ আইন-শৃঙ্খলারক্ষাবাহিনী মোতায়েন রাখুন। কেউ ভুয়া প্রমাণিত হলে বা মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গ্রেফতার ও তার গেজেট বাতিলের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ রকম ২/১টা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারলে কোনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়া সাক্ষ্যদাতা যাচাই বাছাই স্থলে হাজিরই হতো না। আর কেউ যদি উপযুক্ত কারণ ছাড়া যাচাই বাছাই স্থলে গরহাজির থাকে তাহলে তাৎক্ষণিক তাকে অমুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করার ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিলো। যেমন আমার জানা মতে, অতীতে যতোবার যাচাই বাছাই হয়েছে ততোবারই একজন প্রভাবশালী অমুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আত্মীয় মারফত 'গুরুতর হৃদরোগে'র প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দিয়ে যাচাই বাছাই বোর্ডে অনুপস্থিত থেকে পার পেয়ে এসেছে! এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায় সে-বিষয়টির দিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখাও উচিত ছিলো। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে যাচাই বাছাই কমিটিকে তাদের মর্জিমাফিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে, ফলে সর্বত্রই ফ্রিস্টাইলে বাণিজ্য সংঘটিত হয়েছে! অনেকের ধারণা, যাচাই বাছাই কমিটি গঠন নিয়েও বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য হয়েছে বলেই যাচাই বাছাই কমিটি আজান দিয়ে ভুয়াদের নিকট থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে তাদের পার করে দিয়েছে!

শুধুমাত্র বেসামরিক ও বাহিনী গেজেট যাচাই বাছাই করে ক্ষান্ত দিলে হবে না, পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সব তালিকার অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের জন্যে উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র বেসামরিক ও বাহিনীগেজেট নয়, অন্যান্য সব তালিকা বিশেষ করে লাল মুক্তিবার্তা তালিকার মধ্যেও বিপুলসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছে।

আমাদের জানা মতে, সম্প্রতি একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে বিদ্যমান মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বিপুলসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে যে তালিকা প্রস্তুত করেছে তাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লক্ষের মতো, যে সংখ্যাটার কথা আমি আজ কয়েক বছর ধরে বলে আসছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তথা জামুকা সেই গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ও সুপারিশ আমলে না নিয়ে তাদের মনগড়া তালিকা প্রকাশের যাবতীয় ব্যবস্থা প্রায় সম্পন্ন করে এনেছে যে তালিকায় স্থান পাবে হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি অগণন রাজাকাররাও, যার আলামত ইতোমধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে। এর পশ্চাতে রয়েছে জামুকাসহ বেশকিছু ক্ষমতাসীন নেতা এমপি মন্ত্রী ও একশ্রেণীর লোভাতুর মুক্তিযোদ্ধার রাজনৈতিক, আর্থিক ও আত্মীয়তার সংযোগ। এরা ঐসব কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের ভাগ তুলে দিতে চায় অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদের হাতে ! আর দু:খজনক সত্য এই যে, এহেন গোঁজামিল, অনৈতিক ও আসল-নকল মিশ্রিত বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকাটি বৈধতা পেতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত দিয়ে! আমাদের আরো দু:খ এই যে, এসব জালিয়াতি গোঁজামিল অনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে সারা দেশের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন নাগরিক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তিনিও কোনো খোঁজখবর নিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই!

এতো দাবি, এতো প্রতিবাদ ও এতো সুপরামর্শ দেয়ার পরও যদি বহুল সাধনা ও প্রত্যাশিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার থেকে যায় তাহলে কিন্তু খবর আছে, মন্ত্রী সাহেব! আমাদের হিসেব মতে দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই দেড় লক্ষের ওপর নয়। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি, দেখি, আপনার তালিকার সংখ্যা কতো দাঁড়ায়?

দুই .

বর্তমান মন্ত্রী মহোদয় ও জামুকার অতীত ও চলমান কার্যক্রম দেখে-আসার ফলে আমাদের কাছে এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, তাদের তালিকা প্রকাশ ফলপ্রসূ হবে না! সে জন্যে আমরা আমাদের দাবিতে অটল। আমাদের দাবি হলো, বঙ্গবন্ধু সরকারের বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে উচ্চতর বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমিশন গঠন করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ণয় করতে হবে। বঙ্গবন্ধু সরকারের সেই মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটি (1972) হলো : Freedom Fighters (FF) means any person who had served as member of any force engaged in the War of Liberation.

এটাই হলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংজ্ঞা। বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার ভেতর সংঘবদ্ধ সশস্ত্র (ফোর্স )বাহিনীর কথা রয়েছে-----যেসব বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের সাথে সম্পর্ক ছিলো। এ-সংজ্ঞার আলোকে মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন সেক্টরভিত্তিক সশস্ত্র গণবাহিনী (এফএফ), মুজিববাহিনী, সামরিক বাহিনী, ইপিআর পুলিশ আনসার বাহিনী ও স্থানীয় বিভিন্ন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা হবে সর্বোচ্চ দেড় লক্ষ।

অপরদিকে আকম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকার)-এর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা (2016) : The people who were involved in the liberation war in response to the call of the Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman in between March 26 and December 16, 1971.

এটা কিছুতেই মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা হতে পারে না। এটা হলো মুক্তিযুদ্ধের সাথে কোনো-না-কোনোভাবে জড়িত লোকদের সংজ্ঞা যাকে প্রচ্ছন্নভাবে 'মুক্তিকামী জনতা'র সংজ্ঞা বলা যেতে পারে। জামুকা প্রণীত এই তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের কথা নেই নেই কোনো সংঘবদ্ধ সশস্ত্র বাহিনীর (ফোর্স ) অস্তিত্ব ! জামুকার ঐ সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিকামী সবাই মুক্তিযোদ্ধা! এদের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি! এ-জন্য যখনতখন যে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন হচ্ছেন এবং হতেই থাকবেন। কেউ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য হবে না! স্বাধীনতার ৩/৪ বছর আগে ও পরে জন্মগ্রহণকারীরাও বীর মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবেন!

সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা নামের এই গোঁজামিল ও ধান্দাবাজির সংজ্ঞার বাণিজ্যিক লীলাখেলায় অমুক্তিযোদ্ধাদের বহাল রেখে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশ করা হলে তা কোনোভাবেই কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ নিয়ে দেশের ভেতর তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। তেল আর জল যেমন মেশে না, তেমনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সাথে নকল মুক্তিযোদ্ধাও মিশতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীসহ জামুকা, এমনকি সরকারের কেউ যদি মনে করে থাকেন যে, তারা যা করবেন সেটাই সবাই মেনে নেবে, এটা ভুল। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত রণাঙ্গনে শত্রু ও মৃত্যুর সাথে লড়াই-করা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হয়তো এখনো তারা চেনেননি। তাদেরকে বয়সের ভারে ও আর্থিকভাবে দুর্বল ভেবে তাদের চোখের সামনে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যারেতারে রাজাকার-অমুক্তিযোদ্ধা নির্বিশেষে যখনতখন মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে বাহাদুরি প্রদর্শন করবেন, এমন দুঃসাহস পরিহার করার এখনো সময় রয়েছে। অন্যথায় এর পরিণতি হবে ভয়াবহ, যা হয়তো তারা কল্পনাও করতে পারবেন না!

অতএব, সাধু, সাবধান !

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test