E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

জয়তু কঠোর ব্যবস্থা : জয়তু ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি

২০২১ নভেম্বর ১৬ ১৬:২৮:৪৬
জয়তু কঠোর ব্যবস্থা : জয়তু ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি

রণেশ মৈত্র


বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে পড়েছে। ছোট ছোট বাম দলগুলি বড় বলে অভিহিত ডান পন্থী ছোট দল সবাই সরকারের সাম্প্রতিক ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধির প্রতিবাদে নিজ নিজ সাধ্যশক্তি অনুসারে রাপথে নেমে হাজারো কণ্ঠে মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করছেন। সাংবাদিকেরা এ ব্যাপারে বিরোধিতা বারীদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, ছবি, বক্তব্য, নিবন্ধ, সম্পাদকীয় ও চিঠিপত্র প্রকাশ করে চলেছেন এই মূল্যবৃদ্ধির তীব্রবিরোধীতা করে, মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতাকে অস্বীকৃতি জানিয়ে।

এ ব্যাপারে এখন পর্য্যন্ত জানামতে গোটা বিশ্বের ডিজেলের দাম বেড়েছে-বেড়েছে ভারতেও কিন্তু কলকাতায় বা পশ্চিম বাংলায় গাড়ী ভাড়া কমানো হয়েছে। ফলে, স্বভাবত:ই বাংলাদেশে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর আরও সোচ্চার হয়েছে।

মানুষ বা নানা যানে যাত্রীদের কথা হলো-তাঁরা বাড়তি ভাড়া দেবেন কেন? তেলের দাম যখন কমে তখন কি তারা গাড়ীভাড়া কমায়? যমুনা সেতু চালু হওয়ার আগে নগরবাড়ী-আরিচা হয়ে যখন প্রথম বাস চালু হলো পাবনা থেকে ঢাকা পর্য্যন্ত তখন মালিকেরা শুরু করেছিলেন পাবনা থেকে ঢাকা যাবার জন্য বাসভাড়া জনপ্রতি ১৮ টাকা। এটা বিগত শতাব্দীর শেষ দিককার কথা। আর আজ? করোনার জন্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার এবং অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের প্রশ্নে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কোন বিধি না মেনে এবং ডাবল যাত্রী ছাদেও দিব্যি লং বা শর্ট রুটগুলিতে গাড়ী চালাতে থাকলো-গণমাধ্যমসমূহে সে খবরও যথারীতি প্রকাশিত হতে থাকলো।

আবার এবার এই সর্বশেষ দফায় (আপাতত:) ডিজেলের দাম বাড়ানোর জন্যে যখন পরিবহন মালিক শ্রমিকেরা তাদের সমিতি নামে-বেনামে অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশব্যাপী পরিবহন ধর্মঘট অঘোষিতভঅবে আকস্মিকভঅবে শুরু করলো-গাড়ীর চাকা বন্ধ করে লক্ষ লক্ষ যাত্রীর ও বিপুল পরিমাণ নানাবিধ প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করে দিলো-সরকার গত শনিবারে এ ব্যাপারে একটা সমাধানে পৌঁছে জটিলতা সৃষ্টি যাতে না ঘটে এমন প্রচেষ্টা নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন-মালক শ্রমিকেরা ঐ দিন বৈঠকে বসতে অস্বীকৃতি জানিয়ে পরদিন অর্থাৎ রবিবারে বৈঠকে বসতে রাজী হলেন কিন্তু আগে ভাগেই জানিয়ে দিলেন তাঁরা কত পরিমাণ দাবী মানলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করবেন।

“শান্তিকামী” ও অতিকথন ও স্তাবকতা খ্যত পরিবহনে ও সেতু মন্ত্রতী দিব্যি রবিবারেই বৈঠকে বসতে রাজী হলেন। কিন্তু তার ফলে যে মানুষের বা যাত্রী ও পণ্য চলাচলের দুর্ভোগ আরও ২৪ ঘন্টা বেড়ে গেল-তাতে তো সরকারের কিছুই আসে যায় না-তাঁরা প্রস্তাবে সম্মত হলেন। বৈঠক হলো এবং সরকার, মালিক-শ্রমিকরা ভাড়া বৃদ্ধিতে তুষ্ট হলেন। তুষ্ট হবেনই বা না কেন? এতে সরকারি বেসরকারি মালিকেরা তো সমভঅবেই লাভবান হবেন। হলোও। হঠাৎ টিভি চ্যানেলে রাজশাহী-ঢাকা পরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১২০ টাকা করে আর বাস মালিকরা নিচ্ছেন প্রতি টিকিটে ২০০ টাকা করে অধিক হারে। বিশ্বে দাম কমায় সরকার একদফা লাভবান হলো-দেশে তা বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা পেলেন সরকার। আর সরকার সংশ্লিষ্ট যে বিপুল সংখ্যক বাস-মালিক তাঁরাও লাভবান হলেন-এটা সরকারের আর একদফা লাভ।

সরকারের কি আদৌ মনে হয়-তাঁরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ? প্রকৃত পক্ষে নির্বাচন হোক না হোক, নির্বাচনের নাম করে বিজয়ী হয়ে আসা সাংসদ মন্ত্রীরা তো বলে থাকেন তাঁরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতার প্রমাণ অনবরত ডিজেল, তেল, গ্যাস, বিদ্যুত ও নানাবিধ খাদ্যপণ্যের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি?

বলি সেই যাত্রীরাই

একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক বিগত ৮ নভেম্বর পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের খবর দিতে গিয়ে শিরোনাম করেছে “বলি সেই যাত্রীরাই”। ডিজেলের দাম ২৭ শতাংশ বাড়ার জোরে পরিবহনের বাসভাড়া গড়ে ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। গত রোববার সারা দিনব্যাপী বৈঠক শেষে ভাড়া বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তের পর মহাদুর্ভোগের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে বাস চলাচল শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে টানা তিন দিনের জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পেলেন যাত্রীরা। একই দিনে প্রতি কিলোমিটারে ৬০ পয়সা ভাা বাড়ানোর পর তুলে নেওয়া হয়েছে ধর্মঘটও।

চাপের মুখে চিরকালের মত গণপরিবহনের সিদ্ধান্ত স্বভাবত:ই সকল মহলের মধ্যে অত্যন্ত বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। নগর পরিবহনে বিশেষজ্ঞরা এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। যে কোন জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধির যে একটা ‘চেইন এফেক্ট’ আছে, জনসাধারণ তার অভিজ্ঞতায় তা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছে। শুধূ তো বাস নয়, বেড়েছে ট্রাক, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, কমাশিয়াল কার-এমন কি রিক্সা, রিক্সাভ্যান সহ সকল প্রকার পরিবহনের ভাড়া। পরিণতিতে চাল-ডাল-তেল-নূন-শাক-সবজী, তরি-তরকারী, ডিম মাছ সব কিছুরই মূল্য যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অনুরূপভাবে স্ফীত হচ্ছে মালিক বা সরকারের পকেট। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে-দরিদ্ররা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে।

তা হলে বাকপটু সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী কি ভাবছেন? কার স্বার্থ রক্ষার কাজে দফায় দফায় ব্যবহৃত হচ্ছেন। যে হারে ডিজেলের দাম বাড়লো, গাড়ীভাড়া তার ডবল বাড়ানো হলো কোন যুক্তিতে? মানুষের ভোগান্তি বৃদ্ধিই কি তা হলে সরকারের নীতি?

পাঠক-পাঠিকাদের অগবগতির জন্যে নানা ধরনের পরিবহনের আগের এবং পরের বর্ধি ভাড়া এবং তার হার উল্লেখ করছি।

৫২ সিটের দূর পাল্লার বাসের (৫২ সিট) আগের ভাড়া-নতুন ভাড়া ১.৮০ এবং বৃদ্ধির হার ২৭। দূর পাল্লার বাস (৪০ সিট) আগের ভাড়া ১.৮৫-নতুন ভাড়া-২.৩৪ এবং বৃদ্ধির হার ২৬.৪৮ নগর পরিবহন (বাস)-১.৭০, নতুন ভাড়া ২.১৫ বৃদ্ধির হার ২৮.১২ শতাংশ। আর লঞ্চভাড়া বাড়লো কিলোমিটারে বাড়লো ৬০ পয়সা-সর্বনিম্ন ভাড়া ১৮ টাকার স্থলে ২৫ টাকা আর বৃদ্ধির হার ৩৫ থেকে ৪৩ শতাংশ পর্য্যন্ত। এগুলি সবই সরকারিভাবে ঘোষিত-সরকার ও মালিক শ্রমিকদের মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। এটাই অত্যধিক এবং অযৌক্তিক। পৃথিবীর কোন দেশে কোন পরিবহনের ভাড়া এমন হারে বাড়ে না। বাড়াতে চাইলে জনতার প্রচ- বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই বিক্ষোভের পরিণতিতে নিজ ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে মন্ত্রী মহোদয় পদত্যাগ করে থাকেন। আমাদের দেশে এমন অবস্থা বহুবার সৃষ্ট হলেও কোন দিনই কোন মন্ত্রী জনবিক্ষোভের পরিণতিতে পদত্যাগ করেন নি-সেই সংস্কৃতিও গড়ে ওঠে নি। অবশ্য এ কথঅও ঠিক, তেমন আন্দোলনও আমরা স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর কোন ইস্যুতেই গড়ে তুলতে পারি নি।

কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে তো পারিই নি উল্টো বয়ান শূনছি বাড়তি ভাড়ার বেশী কেউ নিলে সরকারের পক্ষ থেকে ‘কঠোর’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের ‘কঠোর ব্যবস্থা” নেওয়ার হুংকার শুনলে মালিক শ্রমিকরা মনে মনে আরও খুশী হয় এবং প্রকাশ্যে ঐ ঘোষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বর্ধিত ভাড়ার দ্বিগুন আদায় করে এবং প্রকাশ্যেই দেশের সর্বত্র মালিকেরা তাই করছেন। অসহায়ত্ব বাড়ছে যাত্রীদের যাত্রীদের মধ্যেকার দুর্বলতা অংশের।

নিব্ধটি লিখতে বসে ছোটবেলার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলে। সবে পাকিস্তান হয়েছে পশ্চিমবাংলা (অথবা ভারত সরকার) ট্রাম ভাড়া জনপ্রতি এক পয়সা করে বাড়িয়ে দেন। আর যায় কোথা? সঙ্গে সঙ্গে বর্ধিত ট্রাম ভাড়া প্রত্যাহার না করা পর্য্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক ধর্মঘট আহ্বান করে বিরোধী দল সমূহ। ভারতের অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টি তখন ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তাদের নেতৃত্বেই ঐ সর্বাত্মক হরতালটি আহুত হয়েছিল। পুলিশ কড়া মেজাজে হরতাল বন্ধ করতে চাইলো-মিছিলকারীদের প্রতি গুলি চালালে আন্দোলনকারীদের একজনের তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে। পরিণতিতে আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠলে সরকার বৈঠক আহ্বান করেন বিরোধীদলের প্রতি। বৈঠকে কমিউনিষ্ট পার্টি বিরোধী পক্ষের নেতৃত্ব দেয়। ক্ষমতায় তখনকংগ্রেস-যাদের নেতৃত্বে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করেছেন বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে। সেই স্বাধীনতা-সংগ্রামের বৃহত্তম দলটি ঐ বৈঠকে হরতাল আহ্বানকারীদের দাবী মেনে নেন এবং ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। সাধারণ মানুষ বিজয়ী হন-আর এখানে আমরা স্বাধারণ মানুষ পরজিত হচ্ছি বারংবার।
তা হলে সরকারি ‘কঠোর ব্যবস্থা’ মালিকদের কি দুর্দিন হয়। ইতিহাস সাক্ষী, না, দুর্দিন নয়-তাদের সুদিন হয়। কারণ ভাড়া তেলের বার্ধিত দামের চাইতে বেশী হারে ভাড়া আদায় করে পকেট স্ফীত করেন এবং তেল-ডিজেলের দাম সরকার কমালেও (যদিও কমানোর কোন রেকর্ড নেই) ভাড়া কিন্তু নানা অজুহাতে বৃদ্ধি পেতেই থকে। সীমাহীন জয়েন আরও একটি দিক হলো-ডিজেল আমাদের দেশের ৬০-৭০ ভাগের মত গাড়ী চলাচল করে। বাকী যানবাহন হলো গ্যাস চালিত। গ্যাস চালিত যান বাহনের মালিকেরাও ঐ সমঝোতা মূলক মূল্য বৃদ্ধি আদয় করছেন যদিও গ্যাসের দাম বাড়েনি-বাড়েনি পেট্রোলের দামও। তাই জয়তু মূল্যবৃদ্ধি! জয়তু “কঠোর ব্যবস্থা”।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test