E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ষাটের অগ্নিঝরা দিন ও কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সাথে

২০২১ ডিসেম্বর ০৫ ১৮:০৩:৩৭
ষাটের অগ্নিঝরা দিন ও কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সাথে

রণেশ মৈত্র


ষাটের দশক। কঠিন সামরিক শাসননের যাঁতাকলে পূর্ববাংলা নিষ্পিষ্ট। স্বৈরাচারীসামরিক শাসক, তৎকালে ’লৌহমানব’ বলে পরিচিত পাকিস্তানি জেনারেল ফিল্ডমার্শাল আইউব খানের অত্যাচারে জর্জরিত সমগ্র পাকিস্তান, বিশেষ করেপূর্ববাংলা। আর তার প্রতিবাদে, সামরিক শাসনের আশু অবসানের দাবিতে ছাত্রযুবসমাজ, গণতন্ত্রকামী সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা দেশের রাজপথগুলোকেদৃপ্ত পদভারে প্রকম্পিত করে চলেছেন। সামরিক শাসনের কঠোরতা তার থোড়াইপরোয়া করে ব্যাপক গণ আন্দোলন গড়ে তুলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেতুলছেন। সরকার তার প্রতিশোধ নিচ্ছে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বিনাবিচারেআটক করে কারারুদ্ধ করার মাধ্যমে। ওই কর্মসূচি যেমন পাকিস্তান সরকারতোমনই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী গ্রুপ) ব্যতীত অপর সকল দলকেওআতঙ্কিত করে তোলে। তারা সরাসরি শেখ মুজিবকে পুনর্বার ’পাকিস্তান ওইসলামের দুশমন’ আখ্যায়িত করেন। শেখ মুজিব চলে আসেন পূর্ব বাংলায়, ঢাকানগরীতে। দিনকয়েকের মধ্যে তিনি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদসহ প্রথমসারির কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাসহ গ্রেফতার হলেন। শেখ মুজিব (তখনও তিনি ’বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত হননি) ব্যতীত অপর নেতৃবৃন্দকে প্রদেশের অপরাপরকেন্দ্রীয় কারাগারে বদলি করে দেওয়া হয়। মুজিব ভাই থেকে যান একা এক বিশাল ওয়ার্ডে। আমি ওই দফায় গ্রেপ্তার হই ঠিক যেদিন পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় তারকয়েক ঘন্টার মধ্যেই, দুপুরবেলায়। খেতে বসেছিলাম দেড় বছর কারারুদ্ধ থাকারপর। আগের দিন মুক্তি পেয়ে বাসায় আসি। পরদিনই আবার সরকারি আতিথ্যনিতে হল, স্ত্রী-সন্তানদের রেখে। এবার গ্রেুফতার জন্মাদোষে। অর্থাৎ হিন্দুঘরে জন্ম নিয়েছিলাম তাই।

পাকিস্তান সরকার যুদ্ধ লাগার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি অবস্থা দিয়ে ’শত্রু সম্পত্তি আইন’ জারি করে। পাশাপাশি নেতৃস্থানীয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের গ্রেপ্তার শুরু করে। অবশ্য ৮/৯ মাসপর অপর হিন্দুনেতাদের মুক্তি দেওয়া হল । আর আমরা যারা ন্যাপ-সিপিবিকরতাম তাদের রেখে দেওয়া হল। খুশি হয়েছিলাম, বাঁচা গেল, কারণ রাজনৈতিকপরিচয়টা পুনরুদ্ধার হল। কিন্তু মুক্তি কবে পাওয়া যাবে তা অনুমান করা যাচ্ছিলনা। এমন সময় আমার স্ত্রী পূরবী মৈত্র এলেন আমাদের ইন্টারভিউ নিতে।উৎসাহিত করলেন আমাকে ’ল’ পরীক্ষা দিতে। রাজি হলাম. বল্লাম নতুন পাস করাআইনজীবীদের জাছ থেকে সিলেবাস জেনে নিয়ে কিছু বইপত্র পাঠাতে । তিনিপাবনায় ফিরে সাধ্যমতো বই সংগ্রহ করে পাঠালেন। আমাকে অনেক আগেই আরওকয়েকজন বন্দীসহ পাবনা জেলা করাগার থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলিকরে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে গিয়েই পূররী ইন্টারভিউ নেন।

যাহোক, পরীক্ষা দিতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে, তিনি নিয়মিতকোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তা জানিয়ে ওই মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত করতেহয়। ওই অনুমতি পাওয়ার পর উচ্চতম কারাকর্তৃপক্ষের (ইনসপেক্টর জেনারেল অবপ্রিজনস) কাছে দরখাস্ত করে পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন ও পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতেআবেদন জানাতে হয়। এসব ফর্মালিটি শেষ হতে হতে কয়েকমাস লেগে গেল।সেই ফাঁকে পড়াশুনাও চলল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তা জানানো হল কর্তৃপক্ষকে। পরে আমাকে জানানো হল, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের কারাগারগুলোর মধ্যে কেবলমাত্রঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পরীক্ষার কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। সুতরাং সেখানে আমাকে বদলি করা হল। তখন তো যমুনা সেতু নির্মিত হয়নি। তাই ট্রেনে সিরাজগঞ্জ-জগন্নাথগঞ্জ ফেরিতে যমুনা পার হতে হত। সরাসরি ট্রেনে রাজশাহী থেকে ঢাকারইন্টার-ক্লাস টিকেটের যাত্রী। সাথী তিন বন্দুকধারী পুলিশ যার মধ্যে একজন সম্ভবতজমাদার-জাতীয় ছিলেন। পুলিশ দেখে ট্রেনের যাত্রীরা কেউ ভাবত চোর-ডাকত, কেউ বা চোরাকারবারী প্রভৃতি। পরে কম্পার্টমেন্টের সবার ভূল ভাঙ্গলো যখন আমিএকগাদা সংবাদপত্র কিনলাম এবং তাদের দু’একজনের সঙ্গে কথা বললাম। রাজবন্দী জানার পর কী যে সম্মান যাত্রীরা দিলেন তা স্মরণীয়।

তবে সেই আমলেরমতো রাজবন্দীদের সম্মান আজ নাকি বিন্দুমাত্র অবিশিষ্ট নেই । কারণ রাজনীতি এখন হয়ে পড়েছেসন্ত্রাসনির্ভর ও দুর্নীতিপরায়ণ আমাদের রাজনীতি। যখন থেকে রাজনীতি-আদর্শ তিরোহিত হতে থাকে তখন থেকে রাজবন্দীদের সম্মান-মর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়।যাহোক, আমার সঙ্গেসঙ্গে এসকর্ট করা পুলিশরা পর্যন্ত চা-নাস্তা-মিষ্টি পেয়ে গেলেনযাত্রীদের কাছ থেকে। আরও পেলাম দামি সিগারেটের কার্টূন (তখন ধূমপানের অভ্যাস ছিল রীতিমতো)। ঢাকা পৌঁছালাম পরদিন সকাল ৮টার দিকে। জেল খানায়যেতে আরও ঘন্টাখানেক। তখন ফুলবাড়ি স্টেশন ছিল ঢাকার স্টেশন। জেলখানায়গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই ডেপুটি জেলর, যিনি রাজবন্দীদের ব্যাপারেদায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, এলেন। দেখি তিনি পূর্বপরিচিত। চমৎকার ব্যবহার। কাগজপত্রসব জমা নিয়ে এসকর্ট পার্টিকে বিদায় দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে আমি কোনওয়ার্ডে থাকতে চাই তা জানতে চাইলেন।জানালাম. এবার পরীক্ষা দিতে এসেছি।তাই পরীক্ষা পর্যন্ত জেনারেল ওয়ার্ডে যাব না। আমাকে নিরিবিলি পড়াশুনা করতে হবে, তাই কোন সেলে দিলে ভালো হয়।অত:পর ঘন্টাখানেক আরও অপেক্ষা করার পর ডেপুটি জেলর নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে গেলেনড়ষফ ২০ পবষষং-এ; সেখানে গেটমুখী একটি সেলআমার জন্য বরাদ্দ।

ইতোমধ্যেই তা ধুয়েমুছে একটি লোহার খাট, চেয়ার টেবিল,খাবার জল, গেলাস দেওয়া হয়েছে। বেলা অনুমান সড়ে এগারটা। কিছু কথাবার্তা বলে যাওয়ার সময় ডেপুটি জেলর বললেন, ‘আপনার এ সেলগুলোতে প্রবেশেরপ্রধান দরজা সর্বদা বন্ধ থাকবে। ভেতরে হাঁটাচলা করবেন’। বললাম , ‘এটা তোশাস্তি’। হেসে ডেপুটি জেলর ‘উপায় নেই’ বলেই চলে গেলেন, ওই দরজাটাও তালাবদ্ধ হয়ে গেল। স্নান সেরে বিছানা পেতে শুয়ে বিশ্রাম নিলাম। বেলা একটারদিকে দুপুরের খাবার এল। খেয়ে লম্বা ঘুম। রাতে ট্রেনে-স্টিমারে তো ঘুমাতেপারিনি তেমন একটা। বিকেল পাঁচটার দিকে এক সিপাই এসে ডেকে ঘুম ভাঙিয়েবলল, বাইরে এসে দেখুন আপনার জন্য একজন অপেক্ষা করছেন। তাড়াতাড়ি উঠেহাত-মুখ ধুয়ে মেইন দরজা খোলা পেয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি মুজিব ভাই দাঁড়িয়ে তাঁরবিশাল বপু নিয়ে। হাতে সেই চিরচেনা চুরুটের কালো পাইপ । হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ন্যাপনেতাকেও গ্রেপ্তার করল? ন্যাপ তো আইউবের পক্ষে।’ আমিও হেসে বললাম , ’সেজন্যই তো আপনারও এক বছর আগে আমাকে ধরে এনেছে।’

মুজিব ভাই বললেন, ‘আরও কাউকে ধরেছে নাকি? বললাম অনেককে । সংখ্যায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর তিনগুণ হবে। খোঁজ নিয়ে দেখুন। উনি বললেন, ’বেশ চলুন এখন হাটাযাক’। মুজিব ভাই-এর সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৫৩ সালে, পাবনায় আওয়ামী লীগ নেতাপ্রয়াত বগা ভাইয়ের বাড়িতে। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করি। ছাত্র ইউনিয়নেরপ্রতিনিধিদল নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে, ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিকনির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার জন্য সকল দলের (কমিউনিস্ট পার্টিসহ) একটি যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি ও মওলানা ভাসানী উদ্যোগী ভূমিকানেন। তিনি বলেছিলেন, মওলানা সাহেব ও তিনি এ ব্যাপারে একমত। তবে শহীদ সাহেব (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে রাজিকরানোর চেষ্টা চলছে। সেটা সফল হলে যুক্তফ্রন্ট হয়েযাবে। আমরা বলেছিলাম,সফল তো হতেই হবে, নইলে আমরা ছাত্রসমাজ ছাড়ব না। এভাবে এরপরযতবারই তিনি পাবনা এসেছেন ততবারই সাক্ষাত হয়েছে, অন্তরঙ্গভাবে আলাপ-আলোচনাও হয়েছে। পাবনায় তখন ছাত্র ইউনিয়ন ছিল প্রধান ছাত্র সংগঠন-ছাত্রলীগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ফলে তা বুঝতে পেরে সেভাবে তিনিগুরুত্ব দিতেন।

মওলানা ভাসানীর তো কথাই নেই। তিনি তো ছাত্রলীগের চেয়ে ছাত্রইউনিয়নকেই তাঁর আপন বলে মনে করতেন, মূলত ছাত্র ইউনিয়নের অসাম্প্রদায়িক,সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী ও সমাজতন্ত্রকামী নীতির জন্য।১৯৬২ সালে বা তার কিছু পরে যখন এনডিএফ গঠিত হয় তখন মুজিব ভাই শহীদসোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাবনা আসেন জনসভা করতে। সেই জনসভার শুরুতেউপস্থিত বিশাল জনতাকে সামাল দিতে মাইক আমার হাতে দেওয়া হয়। আমরা মুহুর্মুহু শ্লোগান তুলি ‘মওলানা ভাসানীর মুক্তি’ ‘এক ইউনিট’, সিয়াটো-সিন্টে চুক্তিবাতিল’ প্রভূতি দাবিতে।নেতৃবৃন্দ ছিলেন সার্কিট হাউসে, আর জনসভা ওই ভবনেরসামনে পাবনা স্টেডিয়ামে। নেতারা মঞ্চে এলে তাদের স্বাগত জানাই; আমরা দিচ্ছিজিন্দাবাদ প্রভৃতি শ্লোগান; কণ্ঠে আরও ছিল মওলানা ভাসানীর মুক্তি, সম্রাজ্যবাদ ওএক ইউনিট বিরোধিতা। শ্লোগানগুলো শুনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মনে মনে ক্ষুব্ধহচ্ছিলেন। সে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটালেন সভা শেষ হলে সার্কিট হাউসে ফিরে গিয়ে।সেখানে তিনি মুজিব ভাইকে ডেকে বললেন, ওই শ্লোগাসগুলো কেন এত দেওয়াহল? মুজিব ভাই বাইরে এসে বারান্দায় আমার কাছে কৌশল করে বিষয়টি জানতেচাচ্ছিলেন। বললাম, শ্লোগানগুলোর প্রাতিটি পাবনা এনডিএফ কমিটিতেসর্বসম্মতিক্রমেঅনুমোদিত। আপনি প্রয়োজনে ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেবকে জিজ্ঞেসকরুন। তিনি তাই করলেন।মনসুর সাহেব স্বীকার করলেন। তা শহীদ সাহেবকেজানালে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, What is their members?” আমি তখন উনার রুমের কাছাকাছি। তাই নিজেই জবাব দিলাম, ”not less thanAwami Leage” ...তিনি এ জবাব শুনে ফুঁসতে থাকলেন।

যাহোক, অত:পর পাবনা থেকে পরদিন তাদের সঙ্গেই আমি উত্তরবঙ্গ যাব ’সংবাদ’-এর পক্ষ থেকে তাদের ট্যুর কভার করার জন্য। সারাপথ ট্রেনে। নানা জায়গায়এডিএফ নেতৃবৃন্দের এ সফর উত্তরবঙ্গের মানুষ ও বিভিনড়ব দলের নেতাকর্মীদের মনেসামরিক শাসনবিরোধী জোয়ারে সঞ্চার করেছিল। আর সংবাদে আমার রির্পোটিদেখে মুজিব ভাই তো বেজায় খুশি। তিনি যাত্রাপথ সাংবাদিকদের খোঁজখবর নিতেতাদের কামরায় ছুটে আসতেন, কোনো সমস্যা আছে কিনা জানতে চাইতেন। হাতেকরে আনতেন সংবাদ ও ইত্তেফাক। ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতার সামনেইবলতেন, ’সংবাদের রিপোর্টটিই হচ্ছে বেস্ট’।

যাহোক, এবার জেলখানার প্রসঙ্গে চলে আসি। প্রায় আধা ঘন্টা হাঁটতে হাঁটতে শেষেআমার লকআউটের সময় এসে যাওয়ায় দুজন মিলে হাঁটা বন্ধ করতে হল। মুজিবভাই চলে গেলেন তাঁর দেওয়ানী ওয়ার্ডে (বলা হত দেওয়ানী ফটক)। গিয়ে তিনিদুখানি খবরের কাগজ পাঠিয়ে দিলেন। ওই পড়তে পড়তে আহারাদি শেষ করেসেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম।পরদিন সকালে উঠে হাতমুখ ধুয়ে এক পেয়ালা চামুখে দিতেই দরজার ওপাশে মুজিব ভাই এসে হাজির। বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে।মুজিব ভাই দেশের কোনো খবর জানা আছে কিনা, ঢাকায় আমার পক্ষে লোকজনকী বলল জানতে চাইলেন। আমি জানালাম, ক্রমশই মানুষ আইউব সরকারেরবিরোধী হয়ে উঠছে এবং ছয় দফার সমর্থনে এসে সামিল হচ্ছে। শিগগিরই একটাবড় রকমের বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হল, যদি আওয়ামী লীগ ও ন্যাপযৌথভাবে আহ্বান জানায়। তিনি বললেন, যৌথভাবে আহ্বান করা সম্ভব হবে কিনাজানি না, তবে আওয়ামী লীগ যেন আহ্বান জানায় সে চিন্তায় আছি। যে ভয়ঙ্কর অত্যাচারী শাসক ক্ষমতায় , তাই সংগঠিত হাতে সময় লাগতে পারে।

তবে উভয়ের মধ্যেকথা থাকল দলীয় উৎস থেকে কোনো গোপন খবর এলে তা আমরা পরস্পর রক্ষাকরব। ন্যাপ তখনও অবিভক্ত যদিও ভেতরে ভেতরে রুশ-চীন মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণেভাঙনের সুর বেজে চলছিল। বাংলাদেশে যারা চীনের মতাদর্শের সমর্থক ছিলেন,জাতীয় রাজনীতিতে তারা সামাজিক শাসক আইউবকে সমর্থন দিয়ে বসায়জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। অপরপক্ষে ন্যাপের বিশাল অংশ সমর্থন করতেন রুশমতাদর্শ এবং জাতীয় রাজনীতিতে তারা সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরতন্ত্রবিরোধী,গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী। তাই দেখা গেল চীনপন্থী নামে অভিহিতরাউগ্র আওয়ামী লীগবিরোধী; অপরপক্ষে রুশপন্থীরা আওয়ামী লীগের বহুদিকেরবিরোধী হলেও গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠায় নিম্মতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রত্যয়ী।

১৯৬৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাপবিভক্ত হয়। চীনপন্থীরা মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এবং রুশপন্থীরা উত্তর পশ্চিমসীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালি খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামীপার্টি এবং পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অধ্যাপক মোজাফফরআহম্মেদের নেতৃত্বে গঠিত হয়। স্বল্পকালের মধ্যেই এটি সমগ্র পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।বিরোধ দেখা দেয় মুজিব-ভাই এর ছয় দফা কর্মসূচি নিয়ে। চীনাপন্থীরাআইউবের সুরে ওই কর্মসূচিকে মার্কিনী ষড়যন্ত্র এবং পাকিস্তানের সংহতি বিরোাধী বলে প্রচার করে। আর রুশপন্থীরা একে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের অনুসারী বলেতার প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু ১৯৬৬ সালে আনুষ্ঠানিক বিভক্তি না হওয়ায় রুশপন্থী ন্যাপ নেতারা ব্যক্তিগতভাবে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে ছয় দফা কর্মসূচিতেসমর্থন জানান। এ কথা মুজিব ভাইকে খোলামেলা বলে আমি নিজেও সেই মতেরঅর্থাৎ রুশপন্থী মতবাদের অনুসারী বলে উল্লেখ করলে তিনি বিস্মিত ও আনন্দিতহন।

যাই হোক, এভাবে দিন চলতে থাকল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঘোাষণা করাহল ৭ জুন আওয়ামী লীগ বন্দীমুক্তি ও অপরাপর দাবিতে হরতাল আহ্বান করেছে।খবরটি সংবাদপত্র মারফত আমরা জানতে পেলাম। দিবসটি ছয় দফা দিবসহিসেবেও কোনা কোনা সংবাদপত্রে উল্লিখিত হয়।ইতোমধ্যে মে মাস থেকেই আমার ’ল’ পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ৭ জুন তারিখে একটিপরীক্ষা হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পূর্বাহ্নেই জানিয়ে রেখেছেন। দিনটি যতইনিকটে আসতে লাগল আওয়ামী লীগের ওপর সরকারি নির্যাতন-নিপীড়নও বাড়তেথাকল। ওইদিন হরতাল, মিছিল ও জনসভার কর্মসূচি ছিল। সপ্তাহ খানেক আগেথেকেই সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দেওয়ালের বাইরে থেকে সহস্র কণ্ঠে যখন শ্লোগান ধ্বনিত হত ‘জয় বাংলা’ ’জাগো বাঙালি জাগো’- কারা প্রকোষ্ঠে লক-আপেবসেও আমরা উজ্জীবিত হতাম। এভাবে ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের পরীক্ষাসমূহেরনিয়ন্ত্রক বরাবর দরখাস্ত করলাম যেহেতু জনগণ ৭ জুন হরতাল বা কর্মবিরতিডেকেছে, তাই তার সমর্থনে আমি ওইদিনকার পরীক্ষা দিতে বিরত থাকব।জমাদ্দারের হাতে দরখাস্ত দিয়ে অফিসে পাঠালাম। কিন্তু জমাদার অফিসে যাওয়ারপথে মুজিব ভাই-এর ওয়ার্ডে গিয়ে সালাম জানাতেই তিনি দরখাস্তটি পড়ে জমাদারসাহেবকে বলে পাঠালেন আমি যেন দরখস্তিটি প্রত্যাহার করে নিই কারণ পরীক্ষার সঙ্গে সারাজীবনের ক্যারিয়ারের প্রশ্ন জড়িত।

আন্দোলনের জন্য তো সারটি জীবনই রয়েছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাাঁর কথা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললাম. জনগণআন্দোলনে থাকবে আর আমি নিজের ক্যারিয়ারের জন্য আরামে বসে পরীক্ষা দেবতা হবে না । দরকার হলে পরের বছর পরীক্ষ দেব- এই বলে জমাদার সাহেবকেদ্রুত দরখাস্তটি অফিসে নিয়ে জমা দিতে বললাম। ছুটে এলেন জেলার ডেপুটিজেলর। তাদেরও একই অনুরোধ। আমি তা মানতে অপারগতা জানিয়ে দ্রুতদরখাস্তটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বললাম। তারা অফিসে ফেরতগিয়েই দরখাস্তটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর জন্য পাঠিয়ে দিলেন।বিকেলে হাঁটার সময় মুজিব ভাই প্রসঙ্গটি তুলে বললেন, কাজটি কিন্তু ভালো হল না। আমার ভিন্নমত পুনরায় তাঁকে জানালাম। উনি বল্লেন, ছাত্রলীগের কোনো নেতাতো পরীক্ষা দেওয়া থেকে বিরত থাকবে না। সেখানে অন্তত নিজ দলের অনুমতিনিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। বললাম, তারাও তো সম্ভবত আপনার অনুরূপ পরামর্শই দিতেন। পরে বঙ্গবন্ধু বললেন,‘আসলে আমার তো ছয় দফা না, একদফা। স্বাধীন বাংলা’। উত্তরে বললাম, ‘পারবেন না। কারণ আপনার কেবলা তোআমেরিকামুখী। তারা কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কদাপি সমর্থন করেনি,করবেও না। হেসে তিনি বললেন, ’হ্যাঁ, আমেরিকাই বটে তবে ভায়া ইন্ডিয়া।’ বললাম. ’ইন্ডিয়ার ভিন্ন ভিন্ন লবি আছে, তাই তাদের মাধ্যমে সোভিয়েতের শরণাপন্ন হোন।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘দেখা যাক।’অত:পর ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ হল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে আটক থাকলেন। ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি বিজয়ীর বেশে দেশেপ্রত্যাবর্তনের পর সম্ভবত ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো এক দিনে স্বাধীন বাংলাদেশেরপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি পাবনা সফরে এলেন।

পাবনাবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে হেলিকপ্টার থেকে নামার পর প্রায় হাজার খনেক অভ্যর্থনাকারীর অন্যতম হিসেবে পাবনা ষ্টেডিয়ামে আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে. তবে একটু পেছনের দিকে তৃতীয়সারিতে।বঙ্গবন্ধু রুশপ্রদত্ত হেলিকপ্টার থেকে নেমে পুলিশের আনুষ্ঠানিকতা শেষে অভ্যর্থনাকারীদের প্রথম সারি থেকে করমর্দন করতে লাগলেন। হঠাৎ আমার ওপরচোখ পড়তেই লাইন ও কর্ডন ভেঙে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘ আলিঙ্গনশেষে বললেন,’কী, বলেছিলাম না দেশ স্বাধীন করে ছাড়ব? উত্তরে আমিও বললাম,‘আপনার মার্কিনী কেবলার সহযোগিতায় বিজয় অর্জিত হয়নি, হয়েছে আমার বলাসমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায়’। হেসে বললেন, ‘কথাটি পাঁচবছর আগে ঢাকা জেলে হয়েছিল। আজও মনে আছে দেখছি।’ বললাম, ‘ভুলেইগিয়েছিলাম, আপনিই এতদিন পরে তা মনে করিয়ে দিলেন।’এবারে আবার ফিরে যাই আবার সেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। একদিনের কথাবিশেষভাবে মনে পড়ছে। তবে দিন-তারিখ মনে নেই। বিকেল চারটের দিকে একটা স্লিপ হাতে হেড ওয়ার্ডার এসে আমার হাতে দিলেন। দেখি তাতে লেখা আছে-‘ফর ইন্টারভিউ মি, রণেশ মৈত্র, সিকিউরিটি প্রিজনার।‘জিজ্ঞেসকরলাম, ’কার সাথে ইন্টারভিউ?’ হেড ওয়ার্ডার বললেন ’ তা কিছু বলেনি।’ কাপড়-চোপড় পরে ডিটেনশন অর্ডারটা হাতে নিয়ে চললাম রাজবন্দীদের ইন্টারভিউ রুমে।ঢুকতেই দেখি, মুজিব ভাই বসা। সামনে বসে আছেন এক মহিলা তারকিশোরীকন্যাকে নিয়ে। তবে দুজনের কাউকেই চিনি না। আর এক কোনায় বসেআছেন আমার বাল্যবন্ধু ব্যরিষ্টার আমীর-উল-ইসলাম। তিনিই এসেছেন আমারসঙ্গে দেখা করতে। তাঁর দিকে পা বাড়াতেই মুজিব ভাই একটু দাঁড়াতে বলে ভাবিরদিকে ইশারা করে বললেন, ’আপনার ভাবি।’ আমি তাঁকে সশ্রদ্ধ সালাম জানালাম।আর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ’আমাদের মেয়ে হাসিনা।’ বলেই মেয়েকে বললেন, ‘ইনি তোমার চাচা, রণেশ মৈত্র। পাবনার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা।বয়সে জুনিয়র হলেও আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। সালাম করো।’ হাসিনা এগিয়ে আসতে নিলে বললাম, ‘তুমি অনেক বড় নেতার মেয়ে, নিজেও ভাবিষ্যতে বড় হবেআশা করি। সেইভাবে নিজেকে গড়ে তোল।’অত:পর ব্যরিষ্টার আমীর-উল ইসলামের সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি আমারআটকাদেশ বে-আইনি দাবি করে হাইকোর্টে রিট করতে চান। সম্মতি চাইলে তা দিলাম। আটকাদেশটি প্রয়োজন বলায় পকেটে থাকা আটকাদেশটি ডেপটুটিজেলারের মাধ্যমে দিলাম। বাইরের কিছু খবরাখবর আকার ইঙ্গিতে শুনলাম।

মুজিব ভাই আমীর-উল-ইসলামকে বললেন, ‘শোন আমীরুল, টাকা যা লাগে আমি দেব,তুমি রিটটা ভালো করে করবে। দরকার মনে করলে বড় কোনো সিনিয়রআইনজীবীকেও সঙ্গে নিও। উনার দ্রুত মুক্তি পাওয়া খুবই প্রয়োজন।’ হেসে আমীর-উল বললেন, ’টাকা লাগবে না, রণেশ আমার বাল্যবন্ধু, একসঙ্গে অতীতে জেল খেটেছি। ওর কেস অবশ্যই ভালোভাবে করব।’ বলেই একটিওকালতনামাতে সই নিলেন। ডেপুটি জেলর আইন সম্মতভাবে প্রতিস্বাক্ষর করেআমীর-উলকে দিলেন। আসলেও তিনি একটি পয়সাও না নিয়ে খেটেখুটে রিটটিকরে কয়েক মাসের মধ্যেই উচ্চ আদালতের নির্দেশে আমাকে মুক্ত করেন। ওইদিনইন্টারভিউ এর পর রাতে দেখি বিশাল এক ভুড়িভোজের ব্যবস্থা। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুরসাক্ষাতকার উপলক্ষে ভাবি নিজ হাতে রান্না করে এনেছিলেন বিস্তর আইটেম। ছিলসবই অত্যন্ত সুস্বাদু। মনে আছে ইলিশ মাছের পাতুরির কথা যেন আজও জিভেলেগে আছে। ভাবি যে এত ভালো রান্না করতে জানতেন তা আদৌ জানতাম না।আমি লিচু থেকে শুরু করে মৌসুমী নানা ফল দেখেছিলাম যা আমার ভাগ্যেও প্রচুরপরিমাণে জুটে গেল।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্যন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

২৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test