E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযুদ্ধই স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামকে বাস্তবায়িত করেছে

২০২১ ডিসেম্বর ২২ ১৫:০৪:০৮
মুক্তিযুদ্ধই স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামকে বাস্তবায়িত করেছে

আবীর আহাদ


বিজয় দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে যে শপথ বাক্যপাঠ করিয়েছেন, সেই শপথবাক্যের মধ্যে  তিনি 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দ এর স্থলে রক্তাক্ত মুক্তিসংগ্রামের কথা বলেছেন। সংবিধানদৃষ্টে প্রধানমন্ত্রী ভুল বলেননি। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন দেশবাসীর কাছে তাঁর এ শব্দচয়নটি চরম সমালোচিত হয়েছে। সংবিধানে যা-ই থাকুক না কেনো, এটাই ঐতিহাসিক ও দার্শনিক সত্য এই যে, বাঙালি জাতির স্মরণাতীতকাল থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত যেসব উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ও সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে, সেসবের মধ্যে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রাম উঠে এসেছিলো। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতিকে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান দেন, তখন থেকেই শুরু হয় সশস্ত্র রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ, যা ১৬ ডিসেম্বর মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথকমাণ্ডে পাকিস্তান বাহিনীর ন্যক্কারজনক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এভাবেই এক রক্তাক্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রাম। আবার এভাবেও বলা যায় যে, জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পধ বেয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই অর্জিত হয় মুক্তি ও স্বাধীনতার বিজয়। এখানে মুক্তিযুদ্ধই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তবে এটাও দার্শনিক সত্য এই যে, মুক্তিসংগ্রাম একটা চলমান প্রক্রিয়া। যতোদিন পর্যন্ত জাতির রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি তথা জাতির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হবে, ততোদিন পর্যন্ত মুক্তিসংগ্রাম চলতেই থাকবে।

কুখ্যাত আলবদর কমাণ্ডার যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা আলী আহসান আল মুজাহিদ একদা জাতীয় সংসদে উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, এ দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি! তার এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের উৎস নিহিত রয়েছে আমাদের জাতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার ( Preamble of the Constitution) মধ্যে । যেমন, আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে বলা হয়েছে :"আমরা বাংলাদেশের জনগণ উনিশশো একাত্তর খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসের ছাব্বিশ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি"।

দেশটা যে ঐতিহাসিক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছে সেকথাটি নেই! এজন্যই আলবদর নেতা আলী আহসান আল মুজাহিদের মতো মানুষেরা সংবিধানদৃষ্টে ঠিকই বলেন যে, একাত্তরে যা ঘটেছিলো তা ছিলো গণ্ডগোলের বছর, পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ইত্যাদি! মুক্তিযুদ্ধের সাথে যাদের সম্পর্ক নেই বা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনেপ্রাণে ধারণ করে না, তারাই কেবল মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে না! ভাসুরের নামের মতো 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটি উচ্চারণ করে না! যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী দেশটি স্বাধীন করেছিলো, এজন্য 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটি বলা যাবে না এবং মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধা 'মুক্তিযোদ্ধদের' অবদানটুকুও স্বীকার করা হবে না! সংবিধানে জনগণ ও শহীদদের কথা থাকলেও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা নেই! আমরা এ জন্য কাউকে দায়ী করছি না। আমরা বিষয়টিকে এভাবেই নিয়েছি, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর দেশকে সাংবিধানিক আইনের শাসনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করতে যেয়ে হয়তো 'মুক্তিযুদ্ধ' ও 'মুক্তিযোদ্ধা' শব্দদ্বয় সংবিধানে আসেনি। জাতীয় নিরিখে তা পরবর্তীতে সংবিধানে আনা যাবে না, সেটাও তো হতে পারে না । সংবিধান তো কোনো কোরানের বাণী নয় যে, তাতে হাত দেয়া যাবে না! ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রয়োজনে সংবিধানে অনেক সংযোজন সংশোধন বিয়োজন প্রভৃতি সাধিত হয়েছে।

অপরদিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ একই অর্থ বহন করে না। তা যদি হতো তাহলে বালাভাষার অভিধানেসবকটি শব্দ মিলে একটাই শব্দ থাকতো। মূলত, মুক্তিসংগ্রাম, আন্দোলন আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। ইংরেজি ভাষায়ও এর ভিন্নতা রয়েছে। যেমন মুক্তিসংগ্রামের ইংরেজি অর্থ Liberation Struggle, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইংরেজি অর্থ Independent Movement এবং মুক্তিযুদ্ধের অর্থ Liberation War বা War of Liberation.

সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দদ্বয়ের স্বীকৃতি না থাকার ফলে অহরহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে এবং মুক্তিযোদ্ধা নয়----এমন ব্যক্তিরা এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদররাও গোঁজামিলের সংজ্ঞার সুযোগে অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর বাহাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর তিরোধানের পর থেকে অদ্যাবধি জিয়া, এরশাদ, খালেদা-নিজামী এবং শেখ হাসিনা সরকার সেই সংজ্ঞাটিকে এড়িয়ে গেছে। খালেদা-নিজামী সরকার বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে গোঁজামিল দিয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে, অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আরেকটি গোঁজামিলের সংজ্ঞায় প্রায় অনুরূপ সংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই দেড় লক্ষ হবে না, কিন্তু বিএনপি-আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়িয়ে নির্ধারণ করেছে দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারেরও উর্দ্ধে । অর্থাৎ বিএনপি-আওয়ামী লীগ আশি/পঁচাশি হাজার অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিয়েছে!

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে আমার নেতৃত্বে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম ২০১৮ সালে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব রেখেছি যে, ইতিহাস ও জাতীয় গৌরবের পবিত্রতার স্বার্থে সংবিধানের যথাযথ স্থানে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দদ্বয় সংযোজন করুন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে একটি বিচার বিভাগ ত সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমিশনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করা হোক, যাতে এ-বিষয়ে আর কোনো বিতর্কের সৃষ্টি না হয়। সেই থেকে দাবি দু'টি তথা ' মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা'র দাবি সর্বস্তরের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। আজ কয়েকটি বছর এসব বিষয়ে বিস্তার লেখালেখি করছি। অনেকেই করছেন। এছাড়া আলোচনা সভা, সংবাদ সম্মেলন, সভা-সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছে। কিন্তু সরকার লা-জবাব! তাদের কিসের এতো দেমাগ, কিসের এতো ড্যামকেয়ার ভাব, তা আমাদের বোধগম্য নয় ।

কিন্তু সরকার তবুও নট নড়ন-চড়ন! তারা চোখ-কান বন্ধ রেখে তাদের গোয়ার্তুমি বহাল রেখেই চলেছে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে নিজেদের সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে তারা ভুয়া সংজ্ঞা তৈরি করে প্রায় প্রতিদিনই যাকে-তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েই চলেছে। অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অর্থ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে তীর মারা, তাদের হৃদয়কে রক্তাক্ত করা, তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতম উপহাস করা, তাদের মর্যাদাকে পদদলিত করা ! জামুকা তথা সরকারের ভাবসাব দেখে মনে হয় যেন, দাবি দু'টি উত্থাপন করে আমরা মহা-অন্যায় করে ফেলেছি! অথচ আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে এ দাবি তুলেছি, যাতে ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তি ও বিতর্ক সৃষ্টি না হয়।

ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের উদ্যোক্তা-নেতৃত্ব। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। আমরা এসব দাবী উত্থাপন করতে যেয়ে বরং আওয়ামী লীগকেই মহিমান্বিত করতে চেয়েছি, যাতে ইতিহাসে আওয়ামী লীগের মুখ উজ্জ্বল থাকে, কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটাকে তাদের ওপর খবরদারি করার মতো মনে করে আমাদের ন্যায্য দাবিকে কোনোরূপ পাত্তাই দিচ্ছে না!

ইতিহাসে কাঠগড়া বলতে একটি আসন আছে। একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় মহাদুর্নীতি, লুটপাট, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার ধ্বংস ইত্যাদি মহা-অপকর্মের পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদান অস্বীকার ও তাদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করার অভিযোগে অবশ্যই বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তারপরও তাদের যদি শুভবুদ্ধির উদয় না হয় তাহলে ইতিহাসে তাদের অবস্থান নিশ্চয়ই সুখকর হবে না।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test