E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৭১ সফল করতে আর একটি মুক্তিযুদ্ধ চাই

২০২১ ডিসেম্বর ২৭ ০৮:৫৭:২৮
৭১ সফল করতে আর একটি মুক্তিযুদ্ধ চাই

রণেশ মৈত্র


১৯৭১ এ আমরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সমগ্র বাঙালি জাতি করেছে। করেছে ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে। সেই মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছিল। সেই মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির এক অসাধারণ, ঐতিহাসিক এবং সারা দুনিয়াকে তাক-লাগানো গৌরবোজ্জ্বল বিজয় অর্জন করেছিল।

কেন? মোটাদাগে আমরা জানি পাকিস্তানী (পশ্চিম পাকিস্তানী) শাসকগোষ্ঠীর সীমাহীন অত্যাচার ও নির্য্যাতন সমূহের হাত থেকে লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন নাম দিয়েছিল বাংলাদেশ-যেন দেশটা বাঙালিরাই শাসন করে, বাঙালিরাই শিক্ষকতা করে, বাঙালিরাই জজ ম্যাজিষ্টেট হয়, বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা হয়....ইত্যাদি।
কিন্তু ভাবতে হবে সূক্ষভাবে ইতিহাসের (প্রকৃত ইতিহাসের) দিকে সুতীক্ষè নজর দিয়ে। আমরা যদি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কারণ ও উদ্দেশ্য সমূহ সঠিকভাবে ধরতে বা উপলব্ধি করতে না পারি তবে প্রকৃত অর্থে আমাদের আকাংখিত এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত সোনার বাংলা প্রকৃত প্রস্তাবে গড়ে তুলতে পারব না।

কিন্তু যে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাঙালি নর-নারী-শিশু অকাতরে প্রাণ দিয়ে, কোটি খানেক বাঙালি এক কাপড়ে, রিক্ত হস্তে জীবন বাঁচল-সেই বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে বার বার ফিরে যেতে বঙ্গবন্ধুর কাছে সঠিক দিক নির্দেশনা নিতে ও লক্ষ্যসমূহ নতুন করে স্মরণে আনতে ও সেগুলি বাস্তবায়িত করতে।

রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাউদ্দিন আহমেদ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অথ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, মনোরঞ্জন ধর যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে তাঁর দৈহিক নেতৃত্ব-বঞ্চিত হয়েও তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভা গঠন করে কতিপয় সুনির্দিষ্ট আদর্শ বাস্তবায়নে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিচালনার দায়িত্ব শত প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে পালন করেছিলেন অবিশ্বাস্য সাফল্যের সাথে সেই সুমহান আদর্শগুলিকে আজ নতুন করে দৃঢ়তার সাথে আমাদেরকে, নতুন প্রজন্মকে আঁকড়ে ধরতে হবে।

পাকিস্তান আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, সভ্যতা, ঐতিহ্য প্রভৃতি সকল কিছুই যা হাজার বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গড়ে তুলেছিল-তার সকল কিছুই নির্মমভাবে ধ্বংস সাধনে প্রবৃত্ত হয়েছিল। বাঙালির জীবনকে সর্বতোভাবে দুর্বিষহ করে তুলেছিল।

জলদ গম্ভীর সুরে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ, ১৯৭১, বাধ্য হয়ে অসহযোগের ডাক দিলেন-একাট্টা হয়ে বাঙালি তা পরিপূর্ণভাবে পালন করেছে, “যার হাতে যা আছে-তাই নিয়ে শত্রু নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়ো” এমন আহ্বান বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে লাখো মানুষের সামনে উচ্চারিত হওয়ামাত্র সমগ্র জাতি তা লুফে নিয়েছে।

ছাত্র সমাজ, বিশেষ করে ছাত্রলীগ, ছাত্র লীগ ও নারী সমাজ শত্রু নিধনের প্রত্যয় নিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছে। সমগ্র বাংলাদেশ যে আগুনের উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।

বঙ্গবন্ধু একা নন। কমরেড মনিসিংহ অধ্যাপক মোজ্জাফর আহম্দে তাঁদের কমিউনিষ্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তার সকল শক্তি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নতুন ও সংগ্রামী আদর্শকে ধারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশ বিদেশে ছুটেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাাতিক সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, তাঁর সরকার ও ভারতের কোটি কোটি মানুষের সীমাহীন ও উদার সহযোগিতা আজও ভুলবার নয়। তাঁদেরও সমর্থন ছিল বাংলাদেশটা সোনার বাংলায় পরিণত হোক।

আস্পষ্ট কথামালায় আটকে না থেকে আবারও ছুটে যাই বঙ্গবন্ধুর কাছে। মওলানা ভাষানী, তাজউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখের কাছে।

মুজিবনগর সরকার তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয়ে চলাকালে এক পর্যাযে এসে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখকে নিয়ে মুজিবনগর সরকারের একটি শক্তিশালী উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করেন এবং তার পর থেকে বৈদেশিক ক্ষেত্রে বিপুল সমর্থন ও সহযাগিতা আনতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার নেতৃত্বধীন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি থেকে, সমগ্র বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের পক্ষ থেকে যা প্রধানমন্ত্রী তদাজউদ্দিন আহমেদ ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে এবং লাখো মুক্তিযোদ্ধা এবং সমগ্র দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ও ত্বরান্বিত ও সুনিশ্চিত করেছিল।

বঙ্গবন্ধুর সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার কথা বাদই দিলাম। তাঁর লিখিত তিনটি মূল্যবান গ্রন্থ “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”, “কারাগারের রোজনামচা” ও “দেখে এলাম লাল চীন” পাঠ করলে জানা যাবে সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কেমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি ঐ গ্রন্থসমূহে জোর দিয়েছিলেন ধনিকশ্রেণীর স্বার্থকারী পুঁজিবাদী অর্থনীতি পরিত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে, সাম্প্রদায়িকতাকে বিদায় দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে, কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি সাধন, আধুনিকায়ন ও ধনী কৃষকদেরকে খর্ব করতে জমির সিলিং নির্ধারণ করতে, বৃহৎ শিল্প ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে তুলে শ্রমিক শ্রেণীর উপর শোষণের মাত্রার অবসান ঘটিয়ে তাদের শ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য ও নিয়মিত পরিশ্রমিক পাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করতে, বেকারত্বের চির অবসান ঘটাতে, একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন করতে, নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীভূত করতে দেশের যুবসমাজকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে, আইন-শৃংখলা সুপ্রতিষ্ঠিত করে আইনের শাসন যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠা করতে, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদসহ সকল সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে একটি আত্মমর্য্যাদা সম্পন্ন স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। সোনার বাংলা বলতে সুনির্দিষ্টভাবে এগুলিকেই বুঝাতে চেয়েছেন।

সেকালের ইতিহাস-গড়া উদ্দাম বাঁধভাঙ্গা ছাত্র আন্দোলন, যুব আন্দোলন নারী আন্দোলন, কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন ইতিহাস পাঠেও জানা যাবে, প্রকৃত প্রস্তাবে কেমন ধারার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই সংগ্রাম ও আত্মদান ঘটেছিল । সম্মিলিত ছাত্র সমাজের ১১ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা মিলিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু ও আন্দোলনকারী সকল মহল কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন তা স্পষ্টভাবে বুঝা যাবে।

সংক্ষেপে রেস বিষয়গুলি আগেই উল্লেখ করেছি। এখন দেখা দরকার সোনার বাংলার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঘোষিত কর্মসূচী আজ স্বাধীনতার পাঁচ দশকে কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। অর্জনের দিকটা ৫০ বছল আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য। যেমন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। রাস্তাঘাট, সেতু, বাজার-বিপণী, চোখ ধাঁধানো দালান কোঠা, দামী দামী বাড়ী-গাড়ী অনেক বেড়েছে। বস্তুত: সাদা চোখে দেখলে দেশটাকে মোটামুটি উন্নত দেশের কাছাকাছি বলা যাবে। ওষুধ ও গার্মেন্টস শিল্পে যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু এই উন্নয়নগুলির যা কিছু সুফল তা ধনিকদের ঘরেই পৌঁছেছে। মাথা পিছু আয় বৃদ্ধির যে হিসাব সরকারিভাবে প্রকাশিত হয় তাতো ৯০ ভাগ মানুষেই পান না-১০ ভাগের ঘরের জমা হয়েছে। ৯০ ভাগ মানুষ বঞ্চিত।

বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক ধারার চিন্তা থেকে ব্যক্তিমালিকানার শিল্প কারখানা জাতীয়করণ করেছিলেন স্বহস্তে। কিন্তু তাঁকে সপরিবারে নির্মম হত্যার পর জিয়াউর রহমান ঐ জাতীকরণকৃত শিল্প কারখানাগুলি বিজাতীয়করণ করে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করেন জলের দামে। এভাবে জলের দামে পাওয়া শিল্প কারখানাগুলি কিন্তু চালু করা হলো না-জমি যন্ত্র সবই তারা বাজার দরে বিক্রী করে বিপুল অর্থের মালিকানা অর্জন করেন-অপরদিকে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক হয়ে পড়েন বেকার। বাদ-বাকী কলকারখানা আজও বন্ধ এবং শ্রমিকেরা বেকার।

কৃষিক্ষেত্রে জমির মালিকদের জন্য কোন সিলিং এর অস্তিত্ব জিয়া-এরশাদের আমলে উঠিয়ে দেওয়ায় জমির বড় বড় মালিকের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কোটির অধিক ভূমিহীন কৃষক বছরে প্রায় ছয় মাস মত বেকার থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্যবসায়-বাণিজ্য ক্ষেত্রে অসংখ্য সিণ্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের দৌরাত্ম্যে আমদানীকৃত বা দেশে উৎপাদিত পণ্যাদির মূল্য প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত জীবনে ত্রাহি ত্রাহি রব।

চিকিৎসা খাতটি মারাত্মকভাবে দুর্নীতি গ্রস্থ তেমনই দুর্নীতি গ্রস্ত আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার দেশের ও মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্র কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। যে কোন মূল্যে দুর্নীতির মূলোৎপাটন না ঘটাতে পারলে সংকটের গভীরতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

নারীসমাজের জীবনে বেশ কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। তাদের একটি অংশের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হওয়াতে তাদের জীবনধারায় লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এর সুফল ভোগ করার ক্ষেত্রে নারী নির্য্যাতনের ভয়াবহ প্রসার ও নারী নীতির ইসলামীকরণের হেফাজতী দাবী এক মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করেছে।

বাহাত্তরের সংবিধান বঙ্গবন্ধু প্রণীত এবঙ গোটা বিশে^র প্রসংশিত। জিয়া-এরশাদ বিসমিল্লাহ্ ও রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করে এবং জামায়াত-হেফাজত সহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলকে বৈধতা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকেই পরিত্যাগ করা হয় নি-দেশে সাম্প্রদায়িকতার উৎপাত দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে-দেশের রাজনীতি যেন পাকিস্তানী ধারার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ পথ পরিত্যাগ করে বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুজ্জীবন না করে সমূহ বিপদ অনিবার্য্য।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test