E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধাদের মনোকষ্ট লাঘবে দেয়া হবে আট দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি 

২০২১ ডিসেম্বর ৩০ ১৬:৩৮:৩৮
মুক্তিযোদ্ধাদের মনোকষ্ট লাঘবে দেয়া হবে আট দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি 

আবীর আহাদ


অতি সূক্ষ্ম ছলেকলেকৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ও তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে! দেশের স্বাধীনতা আনায়নকালী গর্বিত গোষ্ঠীকে মানবেতর জীবনে ঠেলে দিয়ে দেশ উন্নত হচ্ছে বলে যতোই প্রচার করা হোক না কেন প্রকৃতপক্ষে চেতনা ও আদর্শগত দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের দেশটাকে অনেক পিছিয়ে দেয়া হয়েছে! এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারকে ভুলুণ্ঠিত করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও রাজাকারদের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছে!

পৃথিবীর ইতিহাসে এটা একটা বিরল ঘটনা যে, রাষ্ট্রীয় আয়োজনে দেশের স্বাধীনতার সূর্যসন্তানদের ঐতিহাসিক জাতীয় মর্যাদা এবং তাদের শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বকে নিষ্ঠুর পন্থায় অবমূল্যায়িত করা হয়েছে! এর প্রধান প্রমাণ, আমাদের জাতীয় সংবিধানের মূলস্তম্ভ 'প্রস্তাবনা'র কোথাও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দদ্বয় সন্নিবেসিত হয়নি! অপরদিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাকে এড়িয়ে বিভিন্ন সময় নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞা দিয়ে, অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়া হয়েছে! যার ফলে সর্বসাকুল্যে দেড় লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার স্থলে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু'লক্ষ চৌত্রিশ হাজারেরও ওপরে!

সংবিধানদৃষ্টে ভবিষ্যতে এখনি কেউ কেউ রায় দিয়ে বসেছে যে, এ দেশে কোনো 'মুক্তিযুদ্ধ' হয়নি এবং 'মুক্তিযোদ্ধা' বলতে কোনো গোষ্ঠী ছিলো না! ইতিমধ্যে প্রচলিত হয়ে পড়েছে যে, একাত্তরের যুদ্ধটা ছিলো ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, পাকিস্তানীদের মধ্যকার গৃহযুদ্ধ, গণ্ডগোলের বছর, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ইত্যাদি! অথচ ঐ যুদ্ধকে আমরা জ্ঞান করেছি "জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ" নামে। সেই আদর্শ ও চেতনাকে বুকে ধারণ করে আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণোৎসর্গ করেছেন। দু' লক্ষাধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এককোটি সোয়া লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একটি সর্বাত্মক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা অনুল্লেখ থাকার অর্থ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চরম অবমাননা।

সংবিধানের প্রস্তাবনায় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা নেই কেনো এ-প্রশ্ন আমি একদিন করেছিলাম প্রখ্যাত আইনজীবী ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ডক্টর কামাল হোসেনকে। ডক্টর কামাল হোসেন বলেছিলেন, ''মুক্তিসংগ্রামে'র মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ নিহিত। আমরা সেদিন সংবিধান প্রণয়ন কমিটিসহ গণপরিষদ সদস্যরা বিষয়টিকে এভাবেই ভেবে নিয়েছিলাম।" আমি তখন ডক্টর কামাল হোসেনকে বলি, যদি মুক্তিসংগ্রামই 'মুক্তিযুদ্ধ' হয় তাহলে বাংলা ভাষার অভিধানে মুক্তিসংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দগুলোকে একটি শব্দে মণ্ডিত করা হলো না কেনো? এমনকি ইংরেজি ভাষায়ও এগুলো পৃথকভাবে বর্ণিত হয়েছে, যেমন Liberation Struggle, Independence Movement ও War of Liberation বা Liberation War না করে যেকোনো একটি শব্দে এগুলোকে লিপিবদ্ধ করা হলো না কেনো? তখন তিনি বলেন, সেসময় তাড়াহুড়ো করে সংবিধান রচনা করতে গিয়ে ঐভাবে হয়তো আমরা চিন্তা করিনি। তবে সংবিধান কোরানের বাণী নয় যে, তা পরিবর্তন করা যাবে না। এ পর্যন্ত জাতীয় এমনকি ব্যক্তির প্রয়োজনে সংবিধানে অনেক সংশোধনী এসেছে। তোমাদের দাবিটি সঠিক। সুতরাং এগুলো সংবিধানে লিপিবদ্ধ করতে কোনো বাধা নেই।

এধরনের জাতীয় অসঙ্গতি ও ভুল নিরসনের লক্ষ্যে আমরা একাত্তরের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠন করে 'মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে আন্দোলন করে আসছি। আমাদের উপর্যুপরি দাবির প্রেক্ষিতে সরকার মুক্তিযোদ্ধা তালিকার অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের কথা বলে তাদেরকে পাকাপোক্ত মুক্তিযোদ্ধা বানানোর পাশাপাশি দীর্ঘকাল ধরে যাকেতাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েই চলেছে! কিন্তু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদ কার্যক্রম আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না! মূলত: সর্বাগ্রে দরকার সাংবিধানিক স্বীকৃতি। সাংবিধানিক স্বীকৃতির মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাবতীয় জাতীয় মর্যাদার সুষ্ঠু সমাধান নিহিত। এই দাবি দু'টি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দু:খ-কষ্টের মধ্যে বসবাস করতে করতে একদা চিরতরে ধরাধামের অন্তরালে হারিয়ে যেতে হবে।

স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজ জীবনের শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তারা নানান রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত। সঠিক চিকিৎসা সেবা থেকে তারা বঞ্চিত। অনেকেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। পরিবার-পরিজনসহ তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আর্থিক কারণে অনেকেই সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেননি। যদিও বা কষ্টের ভেতরে থেকেও কিছু মুক্তিযোদ্ধা সন্তান উচ্চশিক্ষা নিতে পেরেছে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পরশ্রীকাতর আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রতিহিংসাসহ বিশাল অঙ্কের ঘুষ দিতে না-পারার কারণে সবরকম যোগ্যতা থাকা সত্বেও তাদের অনেকের চাকরি হয়নি। কোনো সরকার এমনকি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারও মুক্তিযোদ্ধা কোটা যথাযথভাবে প্রয়োগ করেননি। উপরন্তু হৃদয়বিদারক বিষয়টি হলো, তাদের হাতেই বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি বাতিল হয়েছে! এমনকি তাদের হাতেই বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটিও বাতিল হয়েছে! পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত। নতুন আরেক উৎপাত শুরু হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা রাজাকার অপশক্তি ও মহলবিশেষের প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার শিকার হয়ে হত্যা হামলা মামলাসহ নানাবিধ অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। জাতীয় সংবিধানে তাদের অবদানের স্বীকৃতি নেই। বিশাল সংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা অকারণে তাদের বীরত্বে ভাগ বসিয়ে চলেছে; রাষ্ট্রীয় ভাতাসহ সবরকম সুযোগ সুবিধা সবার আগে তারাই ভোগ করছে! ফলশ্রুতিতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সার্বিকভাবে চরম মনোকষ্ট নিয়ে আহাজারি করে মরছেন! কোনো সরকার ও রাজনৈতিক দল এসব বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি! সবাই মনে হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি একধরনের পরশ্রীকাতরতায় ভুগছেন!

উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোকষ্ট লাঘবের জন্যে আমরা সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে ৮ দফা দাবিসম্বলিত একটা স্মারকলিপি প্রস্তুত করে সারা দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করছি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাক্ষর নিয়ে আমরা সেই স্মারকলিপিটি প্রধানমন্ত্রী সমীপে পেশ করতে চাই। এ লক্ষ্যে সর্বস্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে আসতে হবে। আমরা আশা রাখি, বিপুলসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বাক্ষরিত স্মারকলিপির দাবিসমূহ সরকার উপেক্ষা করতে পারবেন না। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু-কন্যার প্রতি আমাদের সেই দৃঢ় আস্থা রয়েছে।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test