E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমাদের শাহবাগ

২০১৪ মার্চ ১২ ১৪:৫৩:৩৮
আমাদের শাহবাগ

তামান্না সেতু : পৃথিবীতে মূলত দু’জাতের মানুষ আছে ।

 

এদের ভেতরের এক জাত – শীতের রাতে রাস্তায় হাঁটার সময় নগ্ন বালকের দিকে নিজের গায়ের চাদর খুলে দেয়। ফুটপাতে খাবার সময় সামনে বসা ছোটো বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করে – “ মামু দুপুরে খাইছ? দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলবে– এই আমার মামুরে বিস্কুট দাও। বাসায় যেয়ে ভাববে– এভাবে কতদিন? বিকেলে বন্ধুদের বলবে– এই এলাকার পথ শিশুদের জন্য কিছু করলে হয় না? সন্ধায় ১০ বন্ধু মিলে খাতা কলম নিয়ে কি করা যায় তার হিসেবে বসবে। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাববে– টাকা কই পামু, টাকার কামতো অন্য কিছু দিয়ে হবে না। পরদিন সকালে আবার সব বন্ধুদের নিয়ে মিটিং। মিটিং এর পর মিটিং– ২০ জনের দায়িত্ব নেয়া সম্ভব না, ওকে ৫ জনের নেই। পড়াশুনা এদের মোটামুটি চাঙ্গে, বাবা মা যা টাকা দেয় তার অর্ধেক যায় বাচ্চাগুলার পিছনে। মাসের শেষে গার্ল/বয় ফ্রেন্ডের কাছে হাত পাতে। ৫ টা শিশুর হাসি মুখ দেখে হাসে, বাকি যে ১৫ টার দায়িত্ব নিতে পারল না তাদের কথা রাত জেগে ভাবে। এ সকল ছোট ভাবনার পর সমস্ত দেশের যে নগ্ন রুপ তারা দেখেছে তা এক দীর্ঘশ্বাস হয়ে বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড ছড়াতে থাকে ।

দ্বিতীয় যে জাত, তাদের নিয়ে আজ আমার আলোচনা বা চিন্তা নয়। তারা নিজেরা নিজেদের নিয়ে এতো বেশি ভাবে যে অন্যদের তাদের নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন নেই।

প্রথম যে দল তাদের সকলের কিছু কমন দুঃখ, অনুভূতি, আনন্দ আছে। কারণ তারা সকলেই একই মায়ের সন্তান। তাদের কষ্ট, আনন্দ, গৌরব, লজ্জা, আত্মসম্মান, আত্মসমালোচনা সব কিছু একটা ভ্রমরের ভেতর। সেই ভ্রমরের নাম- মুক্তিযুদ্ধ ।

এই মানুষগুলো বা এই শক্তি ছাড়াছাড়াভাবে সমস্ত দেশে ঘুরে বেরাচ্ছিল বুকে অনেক কার্বনডাই অক্সাইড নিয়ে, হাজারো প্রশ্ন নিয়ে, ক্ষোভ নিয়ে, প্রতিবন্ধকতা জেনে, ইচ্ছার অভাব জেনে।

৫ই ফেব্রুয়ারি, সাল ২০১৩।

তাদের সেই প্রাণ ভ্রমরটা উড়তে উড়তে শাহবাগের মোড়ে এসে বসে পরল কিছুটা আহত আর ডানা ভাঙা অবস্থায়। কারণ যে মায়ের প্রাণ তার ভেতর সে ধারণ করে সেই মায়ের অসম্মানের, অপমানের বিচারটি লজ্জাজনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।

প্রাণ ভ্রমর যদি ডানা ভেঙ্গে পরে তবে তার সমস্ত ছড়িয়ে থাকা দেহগুলো কি আর ছড়িয়ে থাকতে পারে?

আমরা সকলে যে যার জায়গা থেকে দৌড়ে এলাম শাহবাগে, ভ্রমরটিকে বাঁচাতে, নিজেকে বাঁচাতে। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে এলাম সমস্ত দেশ থেকে।

তারপর কি আশ্চর্য– যখন প্রতিটি মানুষ পাশের মানুষটির দিকে তাকাচ্ছিলাম– দেখালাম সবাই সবাইকে আমরা চিনি। কিছু গান আমরা সবাই গাইতে পারি! কিছু কবিতা! কিছু ইচ্ছা! কিছু কষ্ট আমাদের এক!!!

কি আশ্চর্য, আমরা ভেবেছিলাম– আমরা বুঝি খুব কম সংখ্যক! ভেবেছিলাম– আমাদের পাশে বুঝি কেউ নেই।

কি আশ্চর্য– আমরা এতো! আমরা তো তাহলে সব পারবো। আমাদের মা আর কাঁদবে না, গলির ১৫ টা ছেলে আর কাঁদবে না, পুরো দেশটাকে আমরা আর কাঁদতে দেব না।

আমার কাছে এই হোল আমাদের শাহবাগ।

আজ সেই শক্তির জেগে ওঠার ১ বছর হবার আর মাত্র কয়টা দিন।

আমাদের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব অনেক রকম ভাবেই আমরা করতে পারি, প্রমাণ দিতে পারি। তবে সবচেয়ে বড় যে পাওয়া তা হোল– আমরা বাংলা মায়ের সন্তানেরা আজ একসাথে হাতে হাত রেখে মায়ের সামনে দেয়াল হয়ে, ফুলের বাগান হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কারো শক্তি নেই এই দেয়াল অতিক্রম করে ।

আজ আমাদের গানের আওয়াজ মাইক ছাড়াই আমেরিকা, আফ্রিকা, আন্দামান, আরব সাগর কাঁপিয়ে দেয় ।

আমরা আজ মাথা উঁচু করে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে গাই -

মাগো ভাবনা কেন

আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে

তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি

তোমার ভয় নেই মা

আমরা প্রতিবাদ করতে জানি

আমরা হারব না, হারব না

তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়ব না

আমরা পাথর দিয়ে দূর্গ ঘাটি গড়তে জানি

তোমার ভয় নেই মা

আমরা প্রতিবাদ করতে জানি ।

আমরা অপমান সইব না

ভীরুর মত ঘরের কোণে রইব না

আমরা আকাশ থেকে বজ্র হয়ে ঝড়তে জানি

তোমার ভয় নেই মা

আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।

আমরা পরাজয় মানব না

দূর্বলতায় বাঁচতে শুধু জানবো না

আমরা চিরদিনই হাসি মুখে মরতে জানি

তোমার ভয় নেই মা

আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।

লেখক: বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত

(এমএইচ/জানুয়রি ২৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test