E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রাষ্ট্রধর্ম বলতে কিছু নেই, লক্ষ্য ‘আইনের শাসন’

২০২২ এপ্রিল ১৯ ১৩:৫৮:৪৪
রাষ্ট্রধর্ম বলতে কিছু নেই, লক্ষ্য ‘আইনের শাসন’

আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রধানতম রাষ্ট্রীয় দর্শন হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে পদদলিত করে ক্রমান্বয়ে দেশকে একটা বিশেষ ধর্মের দেশে মণ্ডিত করা হচ্ছে! সেই ধর্মের জঙ্গিত্বের ছোবলে অন্যান্য ধর্মের লোকজন আক্রান্ত হচ্ছে। সংগত কারণে বলতে হয়, ১৯৭১ সালে আমরা কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি; বিশেষ কোনো ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেও নয়। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে আমাদের চেতনায় কোনো ধর্মীয় অনুভূতি ছিলো ন। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নিরেট বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টানসহ বিভিন্ন পাহাড়ি উপজাতি ও ণৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সেই চেতনার নির্জাস ছিলো: জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু! বহু মানুষ, বহু মত, বহু পথ ও বহু চিন্তার কোনো দেশে বিশেষ কোনো ধর্ম প্রাধান্য পেতে পারে না। তাছাড়া রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না। রাষ্ট্র তার ভুখণ্ডে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মকে সমদৃষ্টিতে সমমর্যাদায় পালন করার নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে। কারণ রাষ্ট্র নামাজ পড়ে না, রোজা রাখে না, হজ্ব পালন করে না, পূজা-অর্চনা করে না, প্রসাদ খায় না! রাষ্ট্রের কোনো তসবীহ, পৈতা নেই। সে কথা বলতে পারে না। হাঁটতে পারে না। তাকে সবাই মিলে চালিয়ে নিতে হয়। আর এই 'সবাই' হলো সেই রাষ্ট্রের জনগণ কোনো মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান, পাহাড়ি উপজাতি ও কোনো ণৃগোষ্ঠী নয় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সেই রাষ্ট্রের সব মানুষ।

সুতরাং রাষ্ট্রের বৈশিষ্টে কোনো সাম্প্রদায়িকতা থাকে না। ধর্মও নেই। বা থাকে না। রাষ্ট্রের কাছে সেই দেশের সব নাগরিক তথা আস্তিক-নাস্তিক ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ সমান। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারী সব নাগরিকের জানমাল, মানমর্যাদা, ধর্মবিশ্বাস ও মতবাদ এককথায় মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এর অর্থ, রাষ্ট্রের নিশ্চিত একটা লক্ষ্য বা ধর্ম আছে এবং থাকা উচিত। আর সেই ধর্মটি হলো ন্যায়বিচার। সবার প্রতি ন্যায়বিচার : ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই রাষ্ট্রের ধর্ম।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতাকে কবর দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ চলবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শের ভিত্তিতে। এখানে বিশেষ কোনো ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হতে পারে না। কোথাকার কোন হুমো এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে আমাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে বিষ ঢেল দিয়ে গেছেন। সেই বিষে আক্রান্ত হয়ে আমাদের শাশ্বত বাঙালি সমাজে সাম্প্রদায়িকতা জেকে বসেছে। এক ধর্মের লোকেরা আরেক ধর্মের ওপর চড়াও হচ্ছে। ধর্মের নামে সমাজে হানাহানি মারামারি কাটাকাটি হচ্ছে। মুসলমান নামধারী একদল ধর্মান্ধ বিশেষ করে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর উপর্যুপরি হামলা চালাচ্ছে।

ইসলাম বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম একথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ইসলাম বাংলাদেশের মাটি থেকে জন্ম নিয়েছে! অথচ পৃথিবীবাসী জানেন যে, ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিলো আরবদেশে হালের সৌদি আরবে। আরবদেশে কোথাও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আছে বলে আমাদের জানা নেই। ইসলামী সমাজ ও ইসলামী আদর্শ মদিনা সনদে অথবা আল-কোরআনের কোথাও " রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম " বলতে কোনো কিছু নেই। এমনকি মক্কা বিজয়ের পর মহানবী যে ১০ বছর দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, সেখানেও রাষ্ট্রধর্মের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। মহানবী পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলেও রাষ্ট্রধর্ম বলতে কিছুই ছিলো না। তাছাড়া ইসলামে ধর্ম পালনে জবরদস্তিও নেই। এ জন্য পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, লা-কুম দ্বীনাকুম ওয়ালিয়েদ্বীন যার যার ধর্ম তার তার কাছে এবং লা-ইকরা হা ফি-দ্বীন ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। এছাড়া পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে: কোন ধর্ম ঠিক, কোন ধর্ম বেঠিক, তা নির্ণয়ের ভার আল্লার ওপর। কোরআনের এসব আয়াতদৃষ্টে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ধর্মবিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হবে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে বিশেষ কোনো ধর্মদ্বারা নয়। তাই বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বলে যা সংযোজিত রয়েছে তা ইসলাম, পবিত্র কোরআন, মহানবী, খোলাফায়ে রাশেদিনসহ সভ্য জীবন-জগত, মনুষ্যত্ব ও আইনের পরিপন্থী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের পরিপন্থী।

অপরদিকে প্রতিটি ধর্মের মূলে আল্লাহ্ ঈশ্বর ভগবান গড নামক যে সত্তার অস্তিত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে আসা হয়েছে, সেই তিনি নিজেই ধর্মনিরপেক্ষ। তার নিজের কোনো ধর্ম নেই। সব ধর্মই তার ধর্ম। সব ধর্মের অনুসারীরা তার কাছে সমান অধিকার পেয়ে থাকে। তাঁর প্রধানতম ধর্ম হলো সৃষ্টি করা এবং সৃষ্টিশীল জগতকে প্রতিপালন ও নিয়ন্ত্রণ করা। প্রচলিত কোনো ধর্মের প্রতি বা ধর্মহীনদের প্রতি তার কোনো পক্ষপাতিত্ব বা অনুরাগ-বিরাগ নেই। তিনি তাঁর কর্ম, চিন্তা ও চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ। তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্বের সব মানবগোষ্ঠীসহ সমগ্র প্রাণীকূল সমান। তিনি সবার জন্যই নিবেদিত।

উদাহরণস্বরূপ : রাম, রহিম ও জন এ-তিন ধর্মাবলম্বী তথা হিন্দু মুসলমান ও খ্রিস্টান সবাই সমভাবে তাঁর করুণা লাভ করে থাকেন। যেমন একটি জনপদে বসবাসকারী রাম রহিম ও জনদের জমিতে ফসল উৎপাদনের সময় যখন বৃষ্টির প্রয়োজন হয়, তখন সৃষ্টিকর্তা ঐ জনপদে বৃষ্টি বর্ষণ করে থাকেন। সৃষ্টি কর্তার এ-বৃষ্টিবর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ম বিবেচনা করেন না। যেমন সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় চীনের ইয়ারলুং জাঙপু নদী নেপাল-ভুটানের উত্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারত-বাংলাদেশ পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নাম ধারণ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার পথপরিক্রমায় বৌদ্ধ, হিন্দু, খৃস্টান, মুসলমান, উপজাতি ও ধর্মহীন সম্প্রদায়ের জনপদকে জল ও পলি দিয়ে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন, সে-ক্ষেত্রে তো বিশেষ কোনো ধর্ম বা ধর্মানুসারীদের কথা তিনি কোনোই বিবেচনায় আনেননি! তেমনি সৃষ্টিকর্তার যদি নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকতো তাহলে তিনি তো তার ধর্মের অনুসারীদের ওপরই তার যাবতীয় কৃপা বর্ষণ করতেন। তেমনি পৃথিবীর সব ধর্ম-বর্ণের মানব জাতি বাতাসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অক্সিজেন গ্রহণ করে জীবনে বেঁচে আছে, সেই বাতাস ও অক্সিজেন সৃষ্টি করেছেন ঐ সৃষ্টিকর্তা মানবজাতিসহ অন্যান্য প্রাণীকূলের জন্য। অনুরূপ সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, নদী-সাগর, বৃক্ষ-তরুলতা প্রভৃতি সৃষ্টি করে প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। সৃষ্টিকর্তার যদি নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকতো তাহলে তো তাঁর ধর্মের অনুসারীদেরকেই যাবতীয় করুণা করতেন! কিন্তু তিনি গোটা মানবজাতিসহ প্রাণিজগতের সব প্রাণীকে অকৃপণভাবে আরো যা-কিছু আছে তা উজাড় করে দিয়েছেন। তিনি সবার প্রতি ন্যায়বিচার করে থাকেন।

বিশেষ করে সৃষ্টিজগতের একমাত্র জ্ঞানী প্রজাতি মানবজাতির ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে তিনি যে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখেন তার প্রমাণ পবিত্র কোরআনের এরকম একটি বাণীতেও মূর্ত হয়ে উঠেছে, যেমন : মুসলমান ইহুদি খৃস্টান সেবিয়ানস মেজিয়ান স্ক্রিপচার্স পলিথিস্ট, আর যারা আছে, যারা সৎপথে চলে, তাদের কোনো ভয় নেই, নিশ্চয়ই তারা পুরস্কৃত হবে। এ-মহান বাণীদৃষ্টে প্রমাণিত হয় যে, মহান সৃষ্টিকর্তা বিশেষ কোনো ধর্ম বা ধর্মানুসারীদের প্রতি নয় সব সৎ মানুষ তাঁর কাছে আদরণীয়, তারা যে-ধর্মের বা ধর্মহীন অনুসারী হোক না কেনো!

পরিশেষে আমাদেরকে এ সিদ্ধান্তেই আসতে হবে যে, রাষ্ট্রের একটি ধর্মবিশ্বাস থাকতে হবে, তবে সেটি কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্ম নয়, সেটি হবে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার ধর্ম।

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২০ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test