E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আওয়ামী লীগ সরকার আমলাতন্ত্রের শেকলে বন্দী!

২০২২ এপ্রিল ২৭ ১৫:১৯:৫১
আওয়ামী লীগ সরকার আমলাতন্ত্রের শেকলে বন্দী!

আবীর আহাদ


প্রধানমন্ত্রীর আশ্রায়ণ প্রকল্প সীমাহীন বেহাল অবস্থার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বীর নিবাসেরও অবস্থা তথৈবচ। এর সাথে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী আমলাদের অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতি কারণে জরাজীর্ণ অবস্থার মধ্যে পড়ে পুরো দুটি প্রকল্প বলা চলে সীমাহীন অব্যবস্থাপনার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। তবুও আমলারা বহাল তবিয়তে আছেন। পদ্মা সেতুতে বারবার ভারি ফেরি দিয়ে আঘাত-করা দায়ী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন ছোট বড়ো ও মেগা প্রকল্প ও কেনাকাটায় প্রকৃত ব্যয়ের চাইতে শত শত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাজার গুণ বাড়তি মূল্য দেখিয়ে তা আত্মসাত করা হলেও এর সাথে জড়িত আমলাদের কোনোই জবাব দিতে হচ্ছে না! আত্মসাতকৃত অর্থ দিয়ে দেশে-বিদেশে অতি রাজকীয় জীবন যাপন করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নেয়া হয় না! তাদের আয়ব্যয়ের হিসেব দাখিল করার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তারা তা প্রদর্শন করেন না! জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, বিশেষ করে এমপি ও মন্ত্রীরা সরকারি প্রটোকলে আমলাদের অনেক ওপরে অবস্থান করলেও তারা তাঁদের গুরুত্বঽই দেন না। উপরন্তু তাঁদেরকে অবহেলা অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে চলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হলেও তাঁদের সাথে আমলাতন্ত্রের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের দেখাদেখি পুঁচকে কেরানিরাও চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। কতিপয় সচিব ও  অন্যান্য ঊর্ধতন কর্মকর্তা জালিয়াতির আশ্রয়ে মুক্তিযোদ্ধা হতে গিয়ে ধরা খেয়েও বহাল তবিয়তে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে বেআইনি ও নৈতিকতাহীন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বেশ কিছুদিন আগে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের সাথে ওখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরোধের সূত্রে এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতি সরকারের একজন সিনিয়র সচিবের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রতি  ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য প্রকাশিত হলেও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর আচরণবিধির লংঘনসহ প্রভৃতি কার্যকলাপ সংঘটিত হলেও আমলারা ধরাছোঁয়ার ঊর্ধে অবস্থান করছেন। এভাবে আমলারা দিনকে দিন দুর্নীতি লুটপাটসহ অযাচিতভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গোটা দেশটাকে তাদের অশুভ হাতের মুঠোয় নিয়ে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করেছে। তারাই আজ দেশের একচ্ছত্র শাসক হিশেবে সরবে আবির্ভূত হয়েছে! রাজনৈতিক সরকার যেনো তাদের হাতের পুতুল! তারা  দিনদিন সরকারকেই যেনো শেকলে বন্দী করে ফেলছে! দেশের চাকররাই আজ শাসকের আসনে অধিষ্ঠিত!

যেকোনো দেশে গণবিরোধী দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র সে-দেশের জন্য অভিশাপ। সেই আমলাতন্ত্রকে কোনো রাজনৈতিক সরকার প্রশ্রয় দিলে সরকার ও আমলাতন্ত্রের স্বার্থোদ্ধার হয় বটে, কিন্তু দেশ ও জনগণের সর্বনাশ ঘটে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সব সভ্যতা ভব্যতা নৈতিকতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আমলাতন্ত্রের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তুলে দিয়ে নিজেদের সর্বনাশ ঘটানোর পাশাপাশি দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল। তারই হাতে এদেশের স্বাধীনতা এসেছে। অথচ এ স্বাধীনতা অর্জনের পশ্চাতে যে মুক্তিযুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, আমলাতন্ত্রের ৯৫% সদস্য ছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। আর দু:খজনক সত্য এই যে, সেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্রকেই স্বাধীন দেশের প্রশাসনে রেখে দেয়া হলো! এখানে অবশ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল মনের উদারতা কাজ করেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, অনেক রক্তপাত ও হিংসা সংঘটিত হয়েছে, আর নয়। সবাই বাঙালি । স্বাধীন দেশটাকে সবাই মিলে এখন এগিয়ে নিয়ে যাই। এ অনুভূতি থেকেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্রকে ক্ষমা করে প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি আরো ভেবেছিলেন, এ অভিজ্ঞ আমলারা তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতাকে স্বাধীনতা-উত্তর ভগ্ন দেশের উন্নয়নে কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশকে একটি শক্তিশালী অবকাঠামোর ওপর দাঁড় করাতে সম্ভব হবে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্রকে বহাল রাখলেও তাদেরকে তিনি যথাযথ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। তাদের অপরাধ কর্মকে শায়েস্তা করার জন্য পিও-০৯ নামক একটি চাকরিবিধি প্রণয়ন করেছিলেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর উদারতা ও চিন্তাকে তাঁর সরকারের দুর্বলতা ভেবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্র খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংগঠিত হয়ে, বঙ্গবন্ধু সরকারকেই উৎখাতের লক্ষ্যে পরাজিত দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে দেশের মধ্যে নানান অরাজকতা সৃষ্টিসহ খাদ্য সংকটকে পুঁজি করে দেশের মধ্যে একটি কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। ৭৪ সালের সেই দুর্ভিক্ষের ধারাবাহিকতায় ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এবং ৩রা নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতি ও বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চারনেতা হত্যার পশ্চাতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্র অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

শেখ হাসিনার সামনে এমন জ্বলজ্বলে ইতিহাস থাকলেও তিনি সেটাকে পাত্তা না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতোমধ্যে আওয়ামীবিরোধী মনোভাবে গড়েওঠা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রকেই পরম বিশ্বাসে কাছে টেনে নিয়েছেন। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রশাসনকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাসহ দুর্নীতিমুক্ত করার তাঁর শত আহ্বান ও নির্দেশের প্রতি আমলাদের কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা তাঁর সরকারের একশ্রেণীর দুর্বৃত্তপরায়ণ রাজনৈতিক শক্তির যোগসাজশে সরকারের নানান উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটার মধ্যে সাগরচুরির মহোৎসব ঘটিয়ে চলেছে। চলমান করোনাকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি, অনৈতিকতা, অব্যবস্থা ও লুটপাটের যে হোলিখেলা চলেছে, কী এমন অবস্থার সৃষ্টি হলেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নিতে পারছে না। আসলে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও আমলাতন্ত্রকে প্রশ্রয় দিলে অবস্থাটা এমনই হয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আমলাতন্ত্রের সাথে আপোস করে এ সরকার সবচাইতে বড়ো ভুলটি করেছেন বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে। আসলে ঐ আমলাতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজাকার সন্তানদের তথাকথিত আন্দোলনের অজুহাতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে বঙ্গবন্ধু ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চরমভাবে অপমান করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে খোলামেলাভাবে রাজাকারি প্রশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা হয়েছে। এখন বলা চলে বাংলাদেশের প্রশাসন চলছে রাজনৈতিক সরকারের নেতৃত্বে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী গুটিকয়েক আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বে। মূলত: দুর্নীতি লুটপাট এবং অযোগ্যতা ও অদক্ষতার কারণেই রাজনৈতিক সরকার ধুরন্ধর আমলাতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকে। তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক সরকারের দর্শন নয়, আমলাতন্ত্রের দর্শনই মুখ্য ভূমিকা পালন করে । এখানেই আওয়ামী লীগ সরকারের চরমতম পরাজয়।

দেশ দু'টি ভাগে বিভক্ত । মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বিপক্ষ শক্তির প্রতি বিশাল মনের উদারতার কারণে নমনীয় হলেও বিপক্ষ শক্তি মনের দিক থেকে বংশপরম্পরায় এখনো প্রতিহিংসা পরায়ণ। তারা বংশানুক্রমিক বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে এখনো মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। এটা বিজ্ঞজনেরা সবাই বুঝলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারেননি বলে মনে হয়। দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষ থাকতে কেনো যে তিনি সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিশেবে বেছে নিলেন একজন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ-করা প্রয়াত কর্নেল আবদুল মালেকের পুত্রকে! অপরদিকে জনগুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিশেবে বেছে নিয়েছিলেন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একজন দালালের পুত্রকে! চলমান করোনা সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে এই মন্ত্রী ও মহাপরিচালকের অদক্ষতা অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে সরকারকে দেশ-বিদেশের কাছে কতো যে নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে এবং হচ্ছে, তারপরও সরকারের হুঁশ হচ্ছে না ! এই মন্ত্রী ও মহাপরিচালকসহ প্রশাসন ও বিভিন্ন অঙ্গনে অবস্থানরত দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। শাহেদ আরিফ সাবরিনার মতো পুঁচকে অপরাধী বিচ্ছিন্নভাবে বলির পাঁঠায় গেলেও নেপথ্যের গডফাদার ও পৃষ্ঠপোষক তথা আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা দরবেশরা যে বহাল তবিয়তে থাকবে তা সবাই জানে।

যেকোনো দেশের দুর্নীতিবাজ-লুটেরা রাজনৈতিক দল ও শাসকদের জন্য আমলাতন্ত্র কিছুকালের জন্য আশীর্বাদ হলেও দিনের শেষে আমলাতন্ত্রই সেই রাজনৈতিক দল ও শাসকদের পতনের মূল কারণ হিশেবে আত্মপ্রকাশ করে। এজন্য দেশপ্রেমিক শাসকরা দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রকে কোনোভাবেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। কিন্তু দু:খজনক সত্য এই যে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বর্তমান অদূরদর্শী সরকার আজ বহুদিন যাবত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের হাতে বন্দী হয়ে দিশাহীন অবস্থার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে! অবস্থা মনে হয় এমন জায়গায় চলে গেছে, যার ফলে আমলাতন্ত্রের ভয়ে আওয়ামী লীগ সরকার আজ স্বাধীনতার সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদায় মূল্যায়ন করতে পারছে না। আওয়ামী লীগের এ রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব মেনে নেয়া যায় না। এটা দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ অশনি সংকেত। এই ভয়াবহ অশনির কবল থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হলে অবশ্যই আমলাতন্ত্রের কালো হাত ভেঙে দিতে হবে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দুর্নীতিবাজ আমলাদের কঠোর বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এ বার্তা দিতে হবে যে, দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতেই হবে। প্রশাসনের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সৎ মেধাবী ও ত্যাগী লোকদের বসাতে হবে। এছাড়া গণবিরোধী দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের আর কোনো পথ খোলা নেই।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test