E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মহান মে দিবস : সংগ্রাম চলছেই

২০২২ মে ০১ ১৬:৫১:৩২
মহান মে দিবস : সংগ্রাম চলছেই

রণেশ মৈত্র


বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল খোদ আমেরিকার বুকে যে নগরীতে শ্রমিকেরা দৈনিক আট ঘন্টা কাজের স্বীকৃতির দাবীতে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন পুঁজিবাদীদের অস্ত্রের আঘাতে আজ থেকে ১৩৬ বছর আগে ১৮৮৬ সালে। 

রক্তঢালা পহেলা মে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল-দাবিটির যৌক্তিকতা সম্পর্কে তেমন একটা দ্বিমত না থাকায় দিবসটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর দিবস হিসেবে স্বীকৃতিও অর্জন করেছিল। সেই স্বীকৃতি আজও বহাল আছে ইউনিয়ন সংগঠন ও পার্টিগুলি সাধ্যমত মর্য্যাদায় লাল পতাকা হাতে নিয়ে, অনেকে আবার লাল টুপি পরেও সকাল থেকে শহরগুলিতে মিছিল করেন-শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য প্রতিষ্ঠায়। আট ঘন্টা কাজ ও অপরাপর ন্যায়সঙ্গত দাবীর স্বীকৃতি দাবী করে মিছিলে মিছিলে রাপথ প্রকম্পিত করেন। পরবর্তীতে থাকে আলোচনা সভা ও দেশপ্রেমিক সঙ্গীতের আসর।

দিনটি শ্রমিক শ্রেণীর জন্য পরাজয়ের দিন নয়-বিজয়ের দিন-অর্জনের দিন-ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের দিন। মনে রাখা দরকার এই সংগ্রামটি সংগঠিত করতে প্রত্যয়বদ্ধ কেন হয়েছিলেন আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণী। মার্কিন পুঁজিপতিরা যুথবদ্ধভাবে দিবারাত্রই প্রায় কাজ করতে বাধ্য করতো তাদের নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রায় প্রতিদিন এক দিনের বেতনের বিনিময়ে। এই অত্যাচার শ্রমিকদের স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছিল-পরিবারিক সমস্যা-সংকট সৃষ্টি করছিল। তাই তাঁরা স্থির করলেন প্রতিদিন তাঁরা আট ঘন্টা কাজ করবেন তার বেশী নয়। ক্ষুব্ধ মলিকেরা এবং সরকার এই দাবী মানতে নারাজ। শ্রমিক শ্রেণীও এই ন্যায় সঙ্গত দাবী ছাড়তে নারা এবং তাঁরা এই দাবী আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচী নিতে বাধ্য হলেন। ওই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে দমনের লক্ষ্যেই পুলিশের গুলিতে আমেরিকার যে নগরীর রাজপথ শ্রমিকদের রক্তে লাল হয়েছিল।

কিন্তু সে রক্ত বৃথা যায় নি। বহু দেশের পুঁজিপতিরা কালক্রমে আনুষ্ঠানিকভাবেই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন দিনে আটঘন্টা কাজ করার দাবী।

দ্বিতীয় বিজয় যেটি ঘটেছে সেটি হলো শ্রমিক শ্রেণী এই দাবীকে কেন্দ্র করে সর্বত্র ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং পৃথিবী ব্যাপী তাঁরা পহেলা মে তারিখে “মে দিবস” ও “আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য দিবস” উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বহু আগেই তা কার্য্যকর করেছেন এবং নানা দেশে শ্রম-আইনে তা লিপিবদ্ধ করে পুঁজিপতিরা এই আইন মানতে বাধ্য থাকবেন এবং না মানলে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে-এমন বিধানও রাখা হয়েছে।

সর্বোপরি, ১ মে কে ‘মে দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের সরকার মে দিবসের ছুটি ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও একটি।

মে দিবস শুধুমাত্র আট ঘন্টা কাজের দাবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। ক্রমে এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রতিটি কারখানার শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন দেশে বাজার দর অনুযায়ী ন্যুনতম মজুরী, আবাসন, পরিবারের সসদ্যদের চিকিৎসা সুযোগ, মাতৃত্ব ছুটি, উৎসব ভাতা, সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা প্রভৃতি ন্যায়সঙ্গত মানবিক দাবী। এই দাবীগুলি কোন কোন পুঁজিবাদী দেশে পূরোপূরি মেনে নেওয়া হলেও আজও তার সংখ্যা কম-কিছু কিছু দেশে দাবীগুলির আংশিক মেনে নেওয়া হয়েছে-আবার কোথাও কোথাও আদৌ মানা হয় নি। নীতিগতভাবে কোথাও কোথাও মানলেও তা পূরোপূরি কার্য্যকর করা হয় নি। তবে কম-বেশী লড়াই সর্বত্রই চলছে।

শ্রমিক শ্রেণী মালিকপক্ষের শোষণের শিকার আজ সকল দেশেই। তাই যতদিন এই শোষণ বজায় থাকবে ততদিন এ জাতীয় সংস্কার মূলক দাবী আন্দোলনও বজায় থাকবে। আসলে দরকার শোষণ মুক্তি এবং এই দাবীটি বোধগম্য কারণেই পৃথিবীর কোন দেশের পুঁজিবাদীরাই মেনে নিতে নারাজ।

তাই ধীরে ধীরে পুঁজিবাদের শৃংখল মুক্তির আন্দোলন পৃথিবীর দেশে দেশে গড়ে উঠতে থাকে। স্বভাবত:ই মার্কসবাদী পস্থাই যে শ্রমিক শ্রেণীর শৃংখলমুক্তি এবং পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ঘটাতে পারে-শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সে ধারণা স্পষ্ট হতে থাকে।

রুশ বিপ্লব

মার্কসীয় তত্ত্বকে ধারণ করে ১৯১৭সালের ৭ নভেম্বর মহামতি লেণিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সেখানকার শ্রমিক শ্রেণী ও মেহনতি মানুষের চরম শত্রু জায়ের শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি ক্ষমতা দখল করে। এই আন্দোলনই রুশ বিপ্লব হিসেবে পরিচিত। রুশ বিপ্লব রুশ সমাজ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছিল তখন। এই যুদ্ধে বিশ্ব পুঁজিবাদের একটি অংশ পরাজিত হয়। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক ঐক্য গড়ে ওঠে এই ঐক্যের সপক্ষে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণী সমর্থন জানান সমর্থন জানান ম্যধবিত্ত পুঁজিবাদী সম্প্রদায়ও।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শক্তির পরাজয় ঘটে। বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদও অতিসয় দুর্বল হয়ে পড়ে, ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম নতুন মাত্রা অর্জন করে এবং ভারত সহ এশিয়া-আফ্রিকার স্বাধীনতাকামী বহু দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এই পরিস্থিতির মধ্যে অর্থাৎ পুঁজিবাদের পরাজয়ে জনিত শূন্যতার সুযোগে আমেরিকা সেই শূন্যতা পূরণে উঠে পড়ে লাগে। মুখে গণতন্ত্র, স্বীধনতার কথা বলে নতুন পদ্ধতিতে পুনরায় বিশ্বব্যাপী শোষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। শ্রমিক শ্রেণী ও মধ্যবিত্তের দুর্বলতা ও দোদুল্য মানবতার কারণে আমেরিকা বিপুল শক্তি নিয়ে পুঁজিবাদ রক্ষায় ব্রতী হয়। এইভাবে নয়া-ঊপনিবেশবাদ গড়ে ওঠে।

ইতোমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্রুত একটি শোষণমুক্ত উন্নত দেশে পরিণত হয়-প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিক শ্রেণীর আধিপত্য। বিশ্বে নতুন ইতিহাস রচিত হয়। শোষিত, নির্য্যাতীত শ্রমিক শ্রেণী ও মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজ বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলে। সকল দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বোত্তম বন্ধু হিসেবে নি:স্বার্থভাবে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশের, ভিয়েতনামের এবং আরও বহু দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাত্মক সমর্থন ও ভারত সহ সকল গণতান্ত্রিক দেশের বিপুল সাহায্যে সাফল্য অর্জন করে। সীমিত পরিমাণে হলেও বা পূর্ণাঙ্গভাবে না হলেও শ্রমিক শ্রেণীর শোষণমুক্ত দাবী ধীরে ধীরে সর্বত্র প্রসারিত হতে থাকে। এখন পরিস্থিতির মধ্যে ১৯১৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। গড়ে ওফে শান্তি ও স্বাধীনতার বার্তা নিয়ে জাতিসংঘ অপর দিকে যুদ্ধ ও সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী শ্লোগান ধারণ করে গড়ে ওঠে বিশ্ব শান্তি পরিষদ-সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নতুন কোন বিশ্ব বা আঞ্চলিক যুদ্ধ যাতে কেউ না বাধাতে পারে সেই লক্ষ্যে। গোটা বিশ্বের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহ যোগ দিলেন বিশ্ব শান্তি পরিষদ ও তার সৃষ্ট শান্তি আন্দোলনে ও বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সংগ্রামে।

তারা একদিকে সামরিক অস্ত্র অপরদিকে ধর্মের অস্ত্র-দুহাতে এই দুই অমোঘ অস্ত্র নিয়ে সমাজতান্ত্রিক শক্তি-শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ও গোপনে নানা দেশে তৎপরতা শুরু করে। লক্ষ্য সমাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ও শ্রমিক শ্রেণীকে বিভক্ত করা। গণতন্ত্রে উচ্ছেদ সাধনেও তারা সচেষ্ট।

এই উদ্দেশ্য কার্য্যকর করার পথে প্রধানতম বাধা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সোভিয়েত সরকার। একটানা ৭৪ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় থাকলো বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সে দেশের শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি, বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীর অকৃত্রিম বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিষ্ট পার্টি। এই দীর্ঘ সময় ধরে শাসনকালে ওই সরকার বিশ্বব্যাপি যেমন বহু কল্যাণকর কাজ করেছে-সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের অপররিসীম কল্যাণ সাধন করেছে, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব, বেকারত্বের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে-তেমনই আবার এই কাজ করতে গিয়ে কিছু ভুল ভ্রান্তি হওয়াতে অস্বাভাবিক ছিল না-তা হয়েছেও।

দু’একটি উদাহরণ দিই। ১৯৮১ সালে মস্কো সফরে গিয়ে আমার যা চোখে পড়েছে তা হলো অভাব মুক্ত যুব সমাজ আরও ভাল থাকার আজও ভাল পোষাক পরিচ্ছদের আকাংখা থেকে আমেরিকান জিনসের প্যান্ট কোর্ট পছন্দ করলেও সরকার তা আমদানী না করায় তারা একদিকে চোরাকারবারি বাধা, সরকারের অক্ষমতা বা দুর্বলতা মনে করে ধীরে ধীরে সরকার বিরোধী হয়ে ওঠে। টুথপেষ্ট জাতীয় অনে নিত্যপ্রােজনীয় জিনিষের মান আসানুরুফ ভাল না থাকা, সরকারের খারাপ কাজেরও সমালোচনা করার অধিকার না থাকা, সংবাদপত্রে কোন সমালোচনামূলক খবর প্রকাশের সুযোগ না রেখে একতরফাভাবে সরকারের গুণকীর্তনের মাধ্যমে পত্রিকা এবং সকল প্রচার মাধ্যমকে সরকারি প্রেসনোট প্রচারের হাতিয়ারে পরিণত করা প্রায় একবিশ শতাব্দীতে পৌছে যুব সমাজকে সরকার বিরোধী মনোভাব গড়ে তুলছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হলো মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের গোপন ও প্রকাশ্য পরিচালিত নানাবিধ চক্রান্ত। সি.আই.এ. ঢালতে লাগলো অজ¯্র ডলার। দীর্ঘ দিন ধরে পরিচালিত এ সকল চক্রান্তের সঙ্গী হয়েছিল সোভিয়েত গোয়েন্তা বাহিনীর একাংশ-আজকের পুতিন ও ঐ গোয়েন্দা বাহিনীই একজন কর্মকর্তা ছিলেন। পরিণতিতে সমাজতান্ত্রিকবিশ্বে ১৯৯১ সালে মহা বিপর্য্যয় ঘটে গেল। পুঁজিবাদ সমর্থক সরকার গঠিত হলো। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অপরাপর দেশেও অনুরূপ ঘটনা ঘটলো। এই বিপর্য্যয়ের মুখে শ্রমিক শ্রেণী হলো সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন দেশগুলিকেও নানা গণতন্ত্র বিরোধী শক্তির উত্থান ঘটলো।

উদাহরণ আই.এস.আই নামক এক ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের উত্থান বিশ্বব্যাপী আতংক সৃষ্টি করেছে। ঐ সন্ত্রাসীরা নানা নামে বাংলাদেশেও গোপনে সক্রিয়। জামায়াতে ইসলামী তার বৈধতা অর্জন করলো-অসংখ্য সন্ত্রাসী ঘটনা দেশব্যাপী ঘটিয়ে যাওয়া সত্বেও নতুন জঙ্গী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম প্রগতিশীল শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ বঙ্গবন্ধুর ম্যূরাল স্থাপনে বিরোধিতার বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধিতা, মন্দির, মসজিদের, পূজা অর্চনা, ঈদের জামাত ও পহেলা বৈশাখের মত নির্মল অনুষ্ঠানাদি আজ তাদের আক্রমণের আজকের সীমিতভাবে অসংখ্য পুলিশ প্রহরায় করতে হচ্ছে।

শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বহিংপ্রকাশ এগুলি কিন্তু সামরিকভাবে বিভ্রান্ত শ্রমিক সমাজ এই ষড়যন্ত্র সমাজে সজাগ হতে পারেন নি-সক্রিয় হতে পারেন নি, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও যুব সমাজ।

কিন্তু এ অবস্থা সাময়িক। মে দিবসের চেতনা আবার বিশ্বকে জাগাবে। এখনও ভিয়েতনাম সহ কতিপয় এশিয়ান, লাতিন আমেরিকান ও ইউরোপীয় আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test