E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভারতে সাম্প্রদায়িকতা

২০২২ মে ০৪ ১৪:৩৭:০৫
ভারতে সাম্প্রদায়িকতা

রণেশ মৈত্র


পৃথিবী আজ একবিংশ শতাব্দীর ২২ তম বছর অতিক্রম করছে। প্রত্যাশিত অর্জন অন্তত: বিংশ শতাব্দীর অর্জনের ধারে কাছেও যেতে পেরেছে এই সময়কালেই কি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, কি স্বাস্থ্যখাতে বা শিক্ষাক্ষেত্রে কী-মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শিক ক্ষেত্রে এর একটি খাতেও কি পৃথিবী এগুতে পেরেছে যা নিয়ে মানুষ গর্ব করতে পারে?

না, তেমন কিছু তো ঘটেই নি বরং যা যা ঘটেছে এবং ঘটছে তা নি:সন্দেহে সমাজ সচেতন ও দায়িত্বশীল মহলের কাছে মারাত্মকভাবে উদ্বেগজনক যার প্রমাণ আমরা পেলাম ভারতের ৫ রাজ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠিত নির্বাচনী ফলাফল। যে ফলাফল ঘটেছে-তা আদৌ প্রত্যাশিত ছিল না ভারতের বছরব্যাপি অভূত পূর্ব কৃষক আন্দোলন, এই আন্দোলনে কৃষকদের অনেকের আত্মাহুতি, খোলা আকাশের নীচে বছরব্যাপী রোদ, বৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে বিপুল সংখ্যার অসুস্থ হয়ে পড়লেন তবু নরেন্দ্র মোদীর কৃষক বিরোধী গণ-বিরোধী নীতির ফলে যে আন্দোলনের তীব্রতা এবং সকল গণতান্ত্রিক শক্তির সমর্থনের ফলে দীর্ঘ এক বছর পরে ওই কেন্দ্রীয় সরকার নিঃশর্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেন তাঁদের কৃষক স্বার্থে বিরোধী আইন দুটি হিজাব বিতর্কের মাধ্যমে যে মুসলিম সমাজ বিশেষ করে মুসলিম নারী সমাজ অত বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়লেন, যে নারী নির্য্যাতন ধর্ষণ অপরাধে এক বিজেপি বিধায়ক যাবজ্জীবন কারাদ-ের শাস্তি পেলেন, যে বিজেপির আমলে কোভিড-১৯ এর ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থান অধিকার করলো গোটা পৃথিবীর ক্ষেত্রে সেই বিজেপি এবারও বিধান সভার নির্বাচনে উত্তর প্রদেশের মত বৃহত্তম ভারতীয় রাজ্যে পুনরায় গতবারের চাইতে অধিকতর (শতাংশ) ভোট পেলো-তা রীতিমত বিস্ময়কর।

কলকাতার সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দ বাজার বিগত ১১ মার্চের সংখ্যায় লিখেছে:- মাত্র ১০ দিন আগে লখিমপুর খেরির মহাসনে নিজ বাড়ীতে বসে একের পর এক চ্যানেলে সাক্ষাতকার দিলেন পবন কাশ্যবা। চার বছর আগে খুন হওয়া কৃষক সাংবাদিক শিক্ষক এবং এলাকার সমাজসেবক প্রবল জনপ্রিয় পবন কাশ্যপের ভাই। মুখোশ উন্মোচন করলেন বিজেপির আইন শৃংখলা বিষয়ক দাবীর অসারতা উল্লেখ করে। তাতেও কাজ হলো না। সংশ্লিষ্ট বিধান সভা আসনে বিজয় মাল্য বিজেপির প্রার্থী গলায়ই ঝুললো।

শুধু লখিমপুর নয়, ২০২০ সালে দলিত কিশোরীকে নির্মম নির্য্যাতন এবং হত্যার ঘটনায় কুখ্যাত হয়ে যাওয়া হাথরস উন্নাও এ কিশোরী নির্য্যাতনের অভিযোগে সেখানকার বিজেপি বিধায়কও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হলেন। এ জাতীয় একের পর অসামাজিক ঘটনা সাম্প্রদায়িক বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে চাপে ফেলবে বলেও স্বাভাবিকভাবেই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু কার্য্যক্ষেত্রে ইউ.পি.তে, এমন কি, উন্নাও হথিরসেও এসবের কোন প্রভাব পড়তে দেখা গেল না। এমন কি, ঐ নির্বাচনী এলাকায় কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াংকা গান্ধী নির্য্যাতীতার মাকে নিজ দলীয় প্রার্থী করেও ভোটে বিজয়ের মুখ দেখতে পেলেন না।

আনন্দবাজারের সাংবাদিকের বিশ্লেষণে কৃষ নারী-পুরুষের ন্যায্য দাবীতে বছর ব্যাপী তুমুল আন্দোলন, রাজ্যের নানা স্থানে বিজেপি কর্মী নেতাদের দ্বারা নারী-নির্য্যাতন সত্বেও,ত হিসেবে দেখা যায়, বিজেপি ব্যাপক সংখ্যক নারী ভোট তাদের বাক্সে পেয়েছে। এমন কি, হিজাব ঘটনার পরেও, যা অতি সাম্প্রতিক ঘটনা, মুসলিম ভোটারদের বিশেষ করে মুসলিম নারী ভোটারদের ভাল অংশ ভোট বিজেপির অনুকূলেই গেছে।

বিস্ময়করই বটে। তবে উত্তরপ্রদেশ অন্যান্য ৪টি প্রদেশের বাম-বিরোধী নারী নির্য্যাতন, সাম্প্রদায়িক উস্কানী এগুলির সমর্থক হয়ে পড়েছেন ওই অঞ্চলের মানুষ। তাঁরা কি তা হলে এসবের ঘৃণা করেন না? এমনটা হতেই পারে না। বছরব্যাপী কৃষক আন্দোলন ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় যার সমর্থক ছিলেন গোটা ভারতীয় নারী নির্য্যাতন কোন মানুষই সমর্থন করতে পারেন না, অনগ্রসরতার কারণেই হোক বা অতিমাত্রায় ধর্মান্ধতার কারণেই হোক, হিজাব বিতর্ক নিঃসন্দেহে মুসলিম সমাজকে বিশেষত: মুসলিম নারী সমাজকে ক্ষুব্ধ করেছে। তবুও এমন ফল ঘটলো কেন ইউ.পি.তে? এতো রীতিমত বিস্ময়কর।

আমার বিবেচনায় ভারতে, দুঃখজনক হলেও সত্য, হিন্দুত্ববাদ যে ব্যাপক প্রসারতা অর্জন করেছিল সেই বাবরি মসজিদ-রামমন্দির ইস্যুকে কেন্দ্র করে, শত নিন্দাবাদ সত্বেও ওই এলকার হিন্দু সমাজ আজও বিজেপিসে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত রক্ষক বলে মনে করে যেমন পাকিস্তানে মুসলিম লীগ জামায়াতে ইসলামীকে ইসলাম ধর্ম রক্ষাকরী প্রকৃত দল বলে মনে করতো। এর প্রকাশ দেখা গিয়েছিল হযরত বাল ইস্যুতে, কাস্মীর ইস্যুতে ইত্যাদি। কিন্তু তারাই প্রমাণ করেছে তারা ইসলাম বিশ^াসী প্রকৃত দল নয়-তারা ইসনলামের নাম ব্যবহার করে রাজনীতি করে ক্ষমতায় যেতে এবং একই প্রচার ঘটিয়ে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে। বিজেপি জামায়াত মুসলিম লীগ হেফাজত ইসলামে তাই কোন নীতিগত মতোনৈক্য নেই। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ বলে এই অপশক্তিগুলির ভূমিকায় তা প্রমাণিত হয়েছে।

অপরাপর কারণ সম্ভবত: এই যে বৃটিশ ভারতে বৃটিশ সাম্প্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস সহ যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দলগুলি প্রায় শতাব্দীব্যাপী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম অকুতোভয়ে পরিচালনা করেছিল-ভারতের মানুষ আজ প্রায় তা বিস্মৃত। ক্ষুদীরাম সহ অসংখ্য দেশ প্রেমিকের আত্মাহুতি, কংগ্রেস, সি.পি.আই সহ অসংখ্য দলের নেতা কর্মীদের যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, মহাত্মাগান্ধী, পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু, মওলানা আবুল কালাম আযাদ, কমরেড এস এ ডাঙ্গে, পিসি খোশী, কল্পনা দত্ত, কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ, কমরেড বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, কমরেড জ্যোতি বসু প্রমুখ যে জেল জুলুম, নির্য্যাতন সহ্য করেছিলেন শুধূ দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য। সেই উজ্জ্বল ইতিহাস ও অমর আদর্শকে ধরে রাখার মত দলগুলি আজ দুর্বল শক্তিহীন।

সে কারণেই দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরু, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সহ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নিজস্ব এলাকা আজ কাংগ্রেসের হাত ছাড়া। শুধু ইউপিই বা কেন সমগ্র ভারতেই কংগ্রেস তথা অসাম্প্রদায়িক দলগুলি আজ অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর পেছেনে তাঁদের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের মৃত্যু দায়ী এমন দাবী হাস্যকর। কাজের দ্বারা-কথার দ্বারা-নানাবিধ পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশনার দ্বারা সে ইতিহাস ও আর্দকে তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়েছেন। কংওগ্রেস যে পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছে তাও তাদের জনপ্রিয়তা ও দলীয় গণতন্ত্র হ্রাসের এবং গতানুগতিক পথচলার বড় কারণ।

এর পরে দেখা যায়, সকল গণতান্ত্রিক শক্তি ভারতে অনৈক্যে ভুগছে। বি.জে.পি ও সাম্প্রদায়িখত হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে আদর্শিক লাড়াই কার্য্যকর ও ঐক্যবদ্ধভাবে গড়ে তুলতে তাঁরা সমর্থ হন নি। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা গেছে তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে দুর্বলচেতা-সাহস নিয়ে দৃঢ়তার সাথে তাঁরা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এবং ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টারও অভাব আবার কখনও কখনও তার প্রতি আপোষকামিতা ও দুর্বলতা দেখিয়েছেন-যার ফলে মানুষ অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না আনতে পারলেও তাদের কখনও কি ভূমিকা হবে তা নিয়ে নি:সংশয় নন।

এছাড়া রয়েছে, অজস্র আঞ্চলিক দলের উত্থান-যা দীর্ঘ দিন ধরেই সর্বভারতীয় রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে চলেছে। কিন্তু এই অস্থিতিশীলতা ও তার ফলে সৃষ্ট গণতান্ত্রিক রাজনীতির শূন্যতা সমগ্র ভারতকেই অকেটা হ্রাস করে চলেছে।

সর্বাধিক বিপর্য্যয় লক্ষ করা যায়, ভারতের কমিউনিষ্ট আন্দোলনের শক্তির হ্রাসের ফলে। কয়েক দশক আগে পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, কেরালা, বিহার, তেলেঞ্চানা প্রভৃতি রাজ্যে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের যে শক্তিশালী বিকাশ ঘটেছিল এবং তা ভারতের গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যে বিপুল আশাবাদের সৃষ্টি করেছিল তার করুণ অবস্থা ও ভারতের জনগণের ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণে হয়েছে। মোট কথা, ভারতের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনতি তার বিপুল ঐতিহ্য আজ হারানোর পথে।

আশাবাদের কথা, ইউ.পির ভোটে এবার বিজেপির চাইতে কম আসন পেয়েছে, পাঞ্চাবে কেজারিওয়ালের আমি আদনি পার্টি নামক বিজেপি বিরোধী গণতান্ত্রিক দল বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করে ক্ষমতাসীন হচ্ছে এবং পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল পর্য্যায়ে ধাপে ধাপে কমিউনিষ্টরা কিছু কিছু আসনে বিজয় বা অধিকতর সংখ্যক ভোট অর্জন করছে। কিন্তু এগুলি সুখবর হলেও আদৌ তা যথেষ্ট নয়। বরং এই কিছুটা অনুকূল ফলাফল ইঙ্গিত দিচ্ছে আগামী দিনে অপরাপর বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের লোক সভা নির্বাচনে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ভোটকে ক্ষমতাচ্যুত করার অপরিহার্য্য প্রয়োজনীয়তাকে প্রকৃত অর্থে সচেষ্ট হতে চাইলে অবিলম্বে সকল বি.জেপি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণতান্ত্রিক ও বামশক্তিকে সকল সংকীর্ণতা পরিহার করে এখন থেকেই ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠন করে বিজেপি ও তার প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য মিত্রদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা অসাম্প্রদায়িক শীক্তকে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে হলে এর কোন বিকল্প নেই।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test