E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পালাবি কোথায়?

২০২২ মে ৩১ ১৪:৫৪:০৩
পালাবি কোথায়?

চৌধুরী আবদুল হান্নান


অনেক সিনেমার শেষ দৃশ্যে যখন জনতা ভিলেনকে তাড়া করে নাস্তানাবুদ করে, দর্শকদের কাছে তা বড়ইউপভোগ্য হয় । গত ৯ মে তারিখের ঘটনা, শ্রীলঙ্কার একজন এমপি উত্তেজিত জনতার ধাওয়া খেয়ে ঘটনাস্থল থেকে দৌড়ে পালিয়ে কাছের একটি ভবনের ভেতর আশ্রয় নিলে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ভবনটি ঘিরেফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে এবং পরিণতি বুঝতে পেরে তিনি নিজের রিভলবার দিয়ে আত্মহত্যাকরেন। বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রোশে রাস্তায় পদদলিত হয়ে মরার চেয়ে আত্মহত্যা করে ‘সম্মান’ বাঁচানো শ্রেয় মনে করেছেন এমপি অমরাকীর্থি। এমপি অমরাকীর্থি শ্রীলঙ্কার দীর্ঘদিনের দুঃশাসন ও সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা আর অব্যবস্থাপনার প্রতীক হয়ে ইতিহাসে নাম লেখালেন। অমরাকীর্থির আত্মহত্যার এমন কীর্তি ‘অমরকীর্তি’ হয়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরবে।

স্বৈর শাসক আলহাজ হু মু এরশাদ প্রায় এক দশক দেশে দুঃশাসন চালালেন, কত ছলচাতুরি আরমতলববাজি করলেন ক্ষমতা আরও দীর্ঘায়িত করার জন্য। এরশাদ ধার্মিক লোক ছিলেন না কিন্ত নিজস্বার্থে রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চেতনা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ভাবনা ধর্মনিরপেক্ষতা ছেঁটে দিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম অন্তর্ভূক্ত করে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে নির্মমভাবে ছুরি চালালেন। কিন্ত শেষ রক্ষা হয়নি, গণতন্ত্র রক্ষার গণ আন্দোলনের মুখে তিনি ৬ ডিসেম্বর ‘৯০ পদত্যাগের ঘোষণা দিলে দেশব্যাপী বিজয় উল্লাস হয়েছিল ।

এরশাদ ‘বুদ্ধিমান’ , গণবিস্ফোরণের মুখে ওই দিন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত না নিলে পুরো পরিস্থিতিভয়ঙ্কর সহিংসতায় রূপ নিতো জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য শ্রীলঙ্কার এম/মন্ত্রীদের মতো রাস্তায় দৌড়ে পালাতে হতো ।

যুগে যুগে একনায়ক, স্বৈর শাসকদের শেষ পরিণতি আমরা কী দেখি ? ফার্দন্যান্দ মার্কোস, ফিলিপাইনের দশম প্রসিডেন্ট, রাজত্ব করেন দুই দশকেরও বেশি সময় । এক সময়স্ত্রী সাবেক ‘বিউটি কুইন’ ইমেলদার রাজকার্যে অনুপ্রবেশ ঘটে এবং এক পর্যায়ে প্রবল ক্ষমতাধর হয়েউঠেন ।ফলে যা হবার তাই হয়, রাজ্য শাসন করেন রাজা আর রাজাকে রাণী ।

সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ এবং লাভজনক পদে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন নিয়োগ পেতে থাকে। এক সময়সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র হত্যা আর সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগে তীব্র গণ আন্দোলন শুরু হয় । তারা রাষ্ট্রের যে বিপুল অর্থ তসরুপ করে নিজেদের দখলে নেন তার কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না যারসঠিক হিসাব বের করাও সম্ভব হয়নি ।লুন্ঠিত সম্পদের হিসাব নিকাশ যাই হোক, এক সময় মার্কোস-দম্পতির চুরি-কান্ড ‘একটি সরকারের গ্রেটেস্ট রবারি’ হিসেবে গিনেজ বুকে নাম এসেছিল ।

অন্যদিকে আমেরিকায় নির্বাসন থেকে জনপ্রিয় রাজনীতিক বেনিগনো অ্যাকুইনো দেশে গণতন্ত্র উদ্ধার ওমার্কোসের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে অংশ নিতে জীবন নাশের হুমকি থাকা সত্বেও দেশে ফিরতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং ১৯৮৩ সালের ২১ আগস্ট মেনিলা বিমানবন্দরে অবতরণের পর পরই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।এই হত্যাকাণ্ড সরকারের ইন্ধনেই ঘটেছে বলেজনগণের মধ্যে নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে। ফলে গণআন্দোলন হঠাৎ দাবানলের মতো জ্বলে উঠে , সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে মার্কোস হাওয়াই দ্বীপে পালিয়ে যান।

মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি, ইরান শাসন করেন প্রায় চার দশক। তাঁর স্বৈর শাসন, দুর্নীতি, সাভাক বাহিনীর (রাজাকে রক্ষায় নিয়োজিত বিশেষ পুলিশ) অত্যাচারে জনগণ ক্ষেপে যায়, পাহলভিডাইন্যাস্টির শেষ রাজাকে উৎখাত করতে আন্দোলন দ্রুত বেগবান হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালের জানুয়ারীতে ইরানের শাহ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, আমেরিকায় আশ্রয় নেন ।

এমন সময় দীর্ঘদিন ফ্রান্সে নির্বাসনে থাকা রাজনীতিক ও ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি দেশেফিরে ‘ইরানিয়ান রেভুলেশন’ এর নেতৃত্বে আসেন। এত মানুষ তাকে অভিবাদন জানাতে বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিল যে দেখে মনে হয়েছিল এতবড় জমায়েত বিশ্বে আর কোনোদিন কোথাও হয়নি। তিনি রাজতন্ত্র উপড়ে ফেলেন, ইরানে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

শাহকে ফেরত দিতে আমেরিকাকে বাধ্য করতে ইরানে আমেরিকান দূতাবাসের ৫০ এর অধিকআমেরিকান কর্মকর্তাকে জিম্মি করা হয় ।কিন্ত আমেরিকা তাকে ফেরত দেয়নি ।তারপর তিনি পানামাগমন করেন এবং পরে চলে যান কায়রো, সেখানে প্রসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত তাকে রাজনৈতিক আশ্রয়দেন। সেখানেই তিনি ১৯৮০ সালে মারা যান ।

জনরোষ এতটাই তীব্র ছিল যে, ইরানিয়ান রেভুলেশনে পাহলভি রাজতন্ত্র উৎখাতের পর তাদেরপূর্বপুরুষদের স্মৃতি-সমাধিগুলো ভেঙ্গে গণশৌচাগার বানানো হয়েছিল। নিকোলাই চশেস্কু দুই দশকেরও বেশি সময় রোমানিয়া শাসন করেন, তাঁর দীর্ঘদিনের দুঃশাসনে দেশেরজনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বিপুল অবৈধ সম্পদ আহরণ ও গণতন্ত্র হত্যাসহ নানা অভিযোগে তাকেঅভিযুক্ত করা হয়।পরিণতি বুঝতে পেরে স্ত্রী এলেনাকে নিয়ে অনুগত এক পাইলটের সহায়তায় হেলিকপ্টারে করে রাজধানী ত্যাগের উদ্যোক নেন কিন্ত সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারির কারণে হেলিকপ্টারটি অবতরণে বাধ্য হয়। তারা নেমে পালাতে চেষ্টা করেন কিন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।

বিচারে স্ত্রীসহ তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় এবং উভয়কে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশদেওয়া হয়। একজন একজন করে গুলি করে হত্যার উদ্যোগ নেওয়া হলে তারা দুইজন একসাথে মরার ইচ্ছা জানালেতাদের অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করা হয়েছিল। উত্তাল জনতার বিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য পরের দিন তাদেরহত্যার ধারনকৃত দৃশ্য রোমানিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রদর্শন করা হয়েছিল।

জনরোষ কতটা তীব্র হলে এমন ভয়ঙ্কর অবিশ্বাস্য অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তা ভাবার বিষয়। যুগে যুগে একনায়ক স্বৈর শাসকদের পরিণাম এমনই হয়েছে, ইতিহাস সাক্ষী। মানুষ সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হয়েও নিজের কর্মফল বুঝতে পারে না, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়না। মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে আমরা এমন বিভীষিকাময় পৃথিবীর পরিবর্তে এক নতুন পৃথিবীদেখতাম।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test