E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নেতাজীকে নিয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিচারণ

২০২২ জুন ০১ ১৪:৪৭:৫১
নেতাজীকে নিয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিচারণ

আবীর আহাদ


ভারতীয় উপমহাদেশে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এক অনন্য বিশ্বস্ত ইতিহাসবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন উপাচার্য, কলকাতাসহ ভারতের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক ও গবেষক হিশেবে তিনি ভারত-বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাস নিয়ে বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজনীতিক মহাত্মা গান্ধী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, সি আর দাস, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, হুমায়ূন কবীর, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি প্রমুখের সাথে গভীরভাবে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁদের সান্নিধ্যও পেয়েছেন। সম্পর্কে তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মামা। বিশেষ করে রাজনৈতিক কারণে আর্থিক প্রয়োজনে নেতাজীকে তিনি মাঝে মাঝে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতেন।

"ভারতের মুক্তিসংগ্রাম: জীবনের স্মৃতিদীপে" গবেষণা গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন: "সুভাষ বসুকেও এইরূপ অর্থ সাহায্য করেছি। সুভাষ আমার এক ভাগিনিয়ের সঙ্গে কটকে এক ক্লাসে পড়ত। সেই সুবাদে কলকাতায় আমাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসত। আমার স্ত্রীকে মামী বলে ডাকত। সুভাষ পরবর্তী জীবনে কোন বিপ্লবী সমিতির সঙ্গে কীভাবে জড়িত ছিল তা আমি ঠিক জানি না। কিন্তু অভয়-আশ্রমের ন্যায় তাঁকেও অর্থ সংগ্রহ করে দিতাম।

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের বড়দিনের ছুটিতে কলকাতা এসেছিলাম। সুভাষ তখন জেলের কয়েদী। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য সরকার তাঁকে এলগিন রোডে নিজের বাড়িতেই পাঠিয়ে দিয়েছিল। বাড়ির দরজায় দুই সৈনিক পাহারা দিত, কারণ সুভাষের বাড়ির বাইরে যাবার অনুমতি ছিল না। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের প্রথম পাঁচ-ছয় দিনও ছুটি ছিল। এই সময় আমার ঢাকার এক ছাত্র এসে বলল যে, সুভাষ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। নির্দিষ্ট সময়ে আমি এলগিন রোডের বাড়ি গেলাম। দরজায় দু'জন শান্ত্রী পাহারাওয়ালা ছিল। তারা আমাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করল না। আমি দোতলায় উঠে দেখলাম সিঁড়ির মাথায় সুভাষের ভাইপো দাঁড়িয়ে আছে। সে আমাকে একটি বদ্ধ দরজার সামনে নিয়ে বলল, আপনি এই দরজা খুলে ভিতরের প্রথম ঘর পার হয়ে দ্বিতীয় ঘরে যাবেন, আমার আর এর বেশি যাওয়ার অধিকার নেই।' আমি ঘরে ঢুকে দেখি সুভাষ শুয়ে আছে।

কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বলল, আমার কিছু টাকার দরকার, সেই জন্যই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি। আমি বললাম, তুমি এখন টাকা দিয়ে কি করবে? সুভাষ ঈষৎ হেসে জবাব দিল, এ প্রশ্ন তো কোন দিন জিজ্ঞাসা করেননি! আমি বললাম, তোমার শরীর খুব খারাপ, টাকা সংগ্রহের মানে তুমি কিছু করবার মতলবে আছ! সেই জন্যই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সুভাষ বলল, যতটা শুনেছেন আমার শরীর ততটা খারাপ নয়। আমি বললাম, এ সংবাদে খুব খুশী হলাম। তারপর কিভাবে কার হাত দিয়ে টাকা পাঠাব তার ব্যবস্থা করে উঠলাম। দরজা পর্যন্ত গিয়েছি, এমন সময় সুভাষ ডাকল, শুনুন শুনুন। আমি ফিরে গেলে বলল, মামীকে আমার প্রণাম জানাবেন।' আমি এটা সাধারণ মামুলি কথা মনে করে চলে এলাম। ঢাকায় ফিরে যেদিন সংবাদপত্রে দেখলাম সুভাষ গৃহত্যাগ করেছে তখনই আমার মনে হল আমার স্ত্রীকে প্রণাম জানানোর অর্থ সে বহু দিনের জন্য বিদায় নিয়ে গেল। তখন জানতাম না যে, আমার এই আশঙ্কা নিদারুণ সত্যে পরিণত হবে।

সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যুরহস্য। তারপর বহুদিন গত হয়েছে। স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে গিয়ে আমি মন্তব্য করেছিলাম যে, আমাদের স্বাধীনতালাভে সুভাষের অবদান গান্ধীর চেয়ে কম নয়, বরং বেশি। ভারত সরকার যারা স্বাধীনতালাভের জন্য ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট সারারাত্রি উৎসব ও মুক্তিসংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দেবার সময় সুভাষ বসুর উল্লেখ মাত্র করেননি, তারা আমার প্রতি এই জন্য বিরূপ হয়েছিল। কিন্তু বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি সাহেব আমার এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সমর্থন করেছেন। আমার History of Freedom Movement, Vol-111 গ্রন্থে বিস্তৃত আলোচনা করেছি।

সুভাষ বসু আজ জীবিত আছে কিনা তা আমার জানা নেই। এ যাবত তা নির্ণয়ের জন্য সরকার একাধিক সমিতি গঠন করেছেন। সকলেই সিদ্ধান্ত করেছে যে, সুভাষ টাইহোকু বন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান (১৯৪৫ খ্রি:)। কিন্তু আমি তা সত্য বলে স্বীকার করি না। দুইজন আমেরিকান সমসাময়িক সংবাদপত্রে লিখেছেন যে, ঐ তারিখের দুই দিন পরেও তারা সুভাষ বসুকে সাইগনে দেখেছেন। ভারত সরকারও যে জানত সুভাষ বসু ১৮ আগস্ট মারা যাননি ভারতের বড়লাট ওয়াভেলের পত্র থেকে তা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। ২৩শে আগস্ট (১৯৪৫ খ্রি:) তিনি লর্ড পেথিক লরেন্সকে এক চিঠিতে সুভাষ বসুকে এখন কোথায় রাখা যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

বিগত ত্রিশ বৎসরের মধ্যে একাধিক ব্যক্তিকে সুভাষ চন্দ্র বসু বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমার সঙ্গে যারা আলোচনা করেছেন, সকলকেই আমি বলেছি, ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম ভাগে এলগিন রোড ভবনে আমি সুভাষ বসুকে কিছু টাকা দিয়েছিলাম। এই টাকার প্রকৃত সংখ্যা যদি এই ব্যক্তি বলতে পারেন তবে জানব এই ব্যক্তিই সুভাষ বসু; অন্যথা সে জাল প্রতারক মাত্র।স্বাধীনতা লাভের পরে সুভাষ বসু যে বহু দান জীবিত ছিলেন, এরূপ কিছু কিছু প্রমাণ পেয়েছি কিন্তু যদিও একাধিক বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি আমাকে বলেছেন যে, সুভাষ বসু এখনও (১৯৭৭ খ্রি: ডিসেম্বর) জীবিত আছেন। আমি এর নিশ্চিত প্রমাণ পাইনি।"

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test