E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হলুদে হলুদে তুমি চাঁপাফুল হয়ে ফোঁটো

২০২২ জুন ০৩ ২১:৫৯:৩৫
হলুদে হলুদে তুমি চাঁপাফুল হয়ে ফোঁটো

পীযূষ সিকদার


আমাদের বিপদ আর যায় না। এইতো ২৬ মে বৃহস্পতিবার আমাদের সেতু আমাদের ছেড়ে চলে গেলো! একের পর এক বিপদ। এই বিপদ সন্ধিকালে শিল্পকলায় ওমর ফারুকের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। আমার বড় ভাই নির্ভিক সাংবাদিক প্রবীর সিকদার তখন মোশাররফ মিয়ার রোষানলে পড়ে জেল খানায়।

ওমর ফারুক আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এলো। ওমর ফারুক একটি গোয়েন্দা সংস্থায় চাকরি করে। এতো ভালো ছেলে আমি খুব কমই দেখেছি! ওমর ফারুক ও আমি সেতু, সেতু টেনে দেয়। ওমর আমার ছোট ভাই। কিন্তু বন্ধুত্বে অতুলনীয়। সেই কবে থেকে একটানা বন্ধুত্ব চলছে। কখনোই ভুল বোঝাবোঝির অবকাশ ছিলো না। হঠাৎ ওমরের জীবনে ঝড় বহে গেলো। তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মারা গেলো। আমিই নিজেকে বুঝ দিতে পারছি না আর ওমর কিভাবে নিজেকে বুঝ দেবে! স্ত্রীকে এতো ভালোবাসা যায় ওমর ফারুক তার উদাহরণ। প্রতি সপ্তাহে ওমর ফারুক ঢাকা থেকে বাড়ি আসে। স্ত্রী কন্যা নিয়ে গ্রামের বাড়ি যায়। চলে ভ্রমন ও আড্ডা। এই তো সেদিন ওমরের স্ত্রী( সেতু ) কন্যা ( আরবি ) নিয়ে কানাইপুর এলো। আমার আনন্দ আর ধরে না! এতো ভূ-সম্পত্তির মালিক তবুও ওদের মধ্যে অহমিকা কাজ করে না। এখানেই দুজনের বিশেষ্যত্ব। সেতু উঁচু নীচুর ভেদ বুঝতো না! আমার ভাঙা ঘরে সেতু বসলো ঘর আলোকিত হলো। শত হলেও আমার বোনতো।

সেতু যেখানে সেখানে বসতে পারতো। এটা খেতে হবে ওটা খেতে হবে কোন রকম বাদ বিচার ছিল না। অহংকার নেই কোথাও। তাইতো বড় ভাইয়ের সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও আনন্দে পা নাচায়! সেতু যেমন ভাগ্যবান তেমনি ওমর ফারুকও ভাগ্যবান। ওমর তো সমস্ত ঘর জুড়ে সেতু সেতু ডাকতে ডাকতে পাগল! আমি দূর থেকে দেখতাম। এত ভালোবাসে মানুষ কেমন করে! আমি দূর থেকে অপলক চেয়ে দেখতাম। আরবি মা মা বাবা বাবা বলতে এগিয়ে আসতো।

সুখের সংসার! আমার ভেতর একটা বোধের জন্ম হলো! ভালবাসায় ভাগ্য ফেরায় কথাটা কতটুকুন সত্য! সেতু চলে গেলো! ভাগ্যই যদি ফিরায় এ কিসের আলামত! সেতু চলে গেলো!!! ওমর ফারুকের কলিজায় টান লাগে। আমি যখন সেতুর মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। ওমর কিভাবে মেনে নেবে! সেতু বোন আমার, আমাদের না বলেই চলে গেলি! তোর বাড়িতে গেলে টেবিল ভরে যেতো খাবার-এ। আমি আশ্চর্য হয়ে বলতাম এতো খাবার! সেতু ও ফারুক হেসে দিয়ে বলতো, আমরা খাবো না! আমার ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে গেলো!

এই তো সেদিন স্পষ্ট মনে করতে পারি সেতু এসেছে সর্ষে ফুল দেখবে বলে। সেতু চোখে মুখে বাহারি নাচন তোলে! সেতুও চাকরি করতো ওমরও চাকরি করতো। একদিন জানা গেলো ওরা গাড়ি কিনেছে! এ অনুভূতি আমাকে নাচায়ে ছেড়েছে। এ আনন্দ আমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার লিখে আনন্দ বোঝাতে পারবো না। আমি গাড়িটা আলতো করে ছোঁই! আরবি গ্লাসের পেছন দিয়ে তাকায় Ñআমরা চলে যাচ্ছি! কাকু, তুমি? আমার যাওয়া হয় না! সারাদিন আমার ঘোরে কেটেছে! আনন্দ-উচ্ছাসে। সর্ষে ফুলের দিকে তাকাই মনটা কেবলই রবীন্দ্রসংগীত হয়ে বাজে।

আমার দাদা জেলে না গেলে হয়তো ওমরের সাথে আমার পরিচয় হতো না! বন্ধুত্ব হতো না! চালের পয়সা, দুধের পয়সা নিতাম না। ওমর ফারুক আমার দুর্দিনের বন্ধু। আমার ছেলে পৃথ্বিরাজ জন্ম নিল ঢাকার বনশ্রী ফরাজী হাসপাতালে! ওমরের মুখখান আমি দেখেছি! মনে ভাবিÑআমার কেউ নয় তবু কত আপন! পৃথ্বিরাজের জন্য কী আনে নাই, তার ফিরিস্তি দেয়া কঠিন!

সেতু নেই! ভাবতেই শিউরে উঠছি। আহারে সেতু তুই ক্যান গেলি ওমর ফারুককে রেখে! নাকি এতো ভালোবাসা ধারন করতে পারো নাই। কেন গেলি সেতু? নাকি বধির হয়ে গেলি! সেতু যেখানেই থাকো ভাল থেকো!

সেতু বোন আমার, তোমার নামটাই এতো সুন্দর যে, আমাদের তিনজনের মধ্যে সেতু এঁকে দিয়ে চলে গেলে পরপারে। বারবার একই কথা লিখছি রিপিটেশন করছি যে সেতু আমার বোন। ওর বাড়িতে গেলেই চাঁদমুখ হতাম। ও যে এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবিনি। এখন আরবি ও অনামিকা শূণ্য ঘরে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে! মা মা বলে ডাকছে। ওদের জানার কথা না ওদের মা তাঁরা হয়ে জ্বলছে। ওমর কষ্ট পাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি। ওমরের পৃথিবী একটাই সে সেতু! আরবি এলো। আনন্দের ঢেউ লাগে নিজ গ্রামে! আরেকটি কন্যা সন্তান আসার মধ্য দিয়ে সেতু অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়! ওমর এ কষ্ট ভুলবে কেমনে?

শিল্পকলা জানে আমি আর ওমর। ওমর আর আমি । চায়ের দোকানে ধূয়ার গোল বৃত্ত আঁকতাম! প্রতি বিকেলে ওমরের জন্য অপেক্ষা করতাম। ওমর ফারুকও তাই! গল্পে গল্পে উঠে আসতো সেতু শুধুই সেতু। আমি নির্বাক হতাম এতো ভালোবাসা কাউকে ভালোবাসা যায়! যেমনটি ভালোবাসা যায় একি শুধু গল্প? একেবারে না। সেতু নেই! সেতু আছে। থাকবে আজন্ম তিল তিল করে। আরবি ও অনামিকার কী হবে?

এ জমানায় কেউ কাউকে ভালবাসে সে ভালোবাসায় মধ্যে কোন অমৃত-সুধা নাই। ওমর ফারুক ভালোবাসে ভালোবাসে। ও যে ভালোবেসে জানান দিতো ভালোবাসা ছাড়া কোন পথ নাই।

এক সময় অর্থ ও অসুস্থতার কারণে আমি গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের কানাইপুরে চলে আসি। ওমরের সাথে তাতে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। মাঝে মাঝে সাদা গাড়িতে চলে আসতো আমার দোকান চর্যাপদে। ওমর আর কী আসা হবে সাদা গাড়ীতে চড়ে সর্ষে ফুল দেখার জন্য? আর কোনদিন গাড়ির পাল্লা খুলে সেতু বেরুবে না! বেরুবেনা আরবি কিংবা অনামিকা! সেতু তুই যে আমার বোন। তুই যে চলে গেলি আমাদের দুই কুল ছাপিয়ে! ভালো থেকো সেতু। যেখানেই থাকো ভালো থেকো। স্রষ্টার কাছে আমার চাওয়া সেতু জান্নাতবাসী হোক। সেতু তোমার বন্দনায় আমরা পঞ্চমুখ। সেতু তোমার সারা শরীরে সর্ষে ফুলের ঘ্রান লেগে আছে। হলুদে হলুদে তুমি চাঁপাফুল হয়ে ফোঁটো।

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test