E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নতুন দল নিবন্ধন আইন : নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন

২০২২ জুন ০৫ ১৫:০৭:৫৮
নতুন দল নিবন্ধন আইন : নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন

রণেশ মৈত্র


বছর দেড়েক সময় হাতে থাকলেও আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে নিবন্ধিত- অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলি এবং নির্বাচন কমিশন নানাবিধ তৎপরতা ইতোমধ্যেই শুরু করেছেন । বৈধ ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হলে সঠিক ভোটারতালিকা প্রনয়ন বা তার হালনাগাদকরণ নির্বাচন কমিশনের একটি নিয়মিত ও অত্যন্ত আবশ্যিক কাজ। সেই কাজটি কমিশন ইতোমধ্যেই শুরু করেছেন। আশা করি তাঁরা একটি নির্ভূল ভোটারতালিকা দেশবাসীকে উপহার দিতে সক্ষম হবেন।

নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন

এই বিষয় নিয়ে পাঁচ বছর আগে একবার লিখেছিলাম। বিদায়ী বা সাবেক নির্বাচন কমিশনের নজরে তা পড়েছিল কিনা-জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে, ওই লেখায় প্রকাশিত মতামতকে তাঁরা আদৌ আমলে নেন নি।

নতুন নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছেন। শীঘ্রই তাঁরা নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কাজটি হাতে নেবেন। তবে তাঁরা কাজটি হাতে নেওয়ার আগে আমি এ বিষয়ে আমার মতামত ও সুপারিশ এই নিবন্ধ মারফত তুলে ধরছি। আশা করি, কমিশন অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এই সুপারিশ ও মতামতসমূহ বিবেচনায় নেবেন।

সুপারিশসমূহ

এক, প্রচলিত নিয়মে শুধুমাত্র সংসদের নির্বাচন- যাকে আমরা সাধারন নির্বাচন বলে থাকি- তার আগ দিয়ে পাঁচ বছর অন্তর নতুন রাজনৈতিক দল বা দলসমূহের, নিবন্ধন দিয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় তা অনেককে, বিশেষ করে নতুন দলগুলোকে, ক্ষতির সম্মুখীন করে।

যেমন স্থানীয় সরকার নির্বাচন । এই নির্বাচনগুলি পাঁচটি বছর ধরেই হতে থাকে এবং এই সব নির্বাচন অতীতে সম্পূর্ণ নির্দলীয় ভিত্তিতে হওয়াতে অতীতে যে পরিস্থিতি ছিল, বর্তমানে বেশ কয়েকবছর যাবত স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের নিয়ম চালু করায়,নতুন দলগুলি তাতে অংশ নিতে পারছেন না। এতে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে । তাই নির্বাচনগুলি যেহেতু পাঁচটি বছর ধরেই হচ্ছে, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও পাঁচটি বছর ধরে করা বাঞ্ছনীয়। আশা করি আমার এই যুক্তি-গ্রাহ্য অভিমত নির্বাচন কমিশন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবেন।
দুই, একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনটি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, বাস্তবতা- বর্জিত এবং সর্বোপরি সংবিধানে বর্ণিত এ সংক্রান্ত মূল নীতি- সমূহের সাথে পরিপন্থী। তাই এই আইনটির খোল-নলচে পাল্টাতে হবে।

নিবন্ধন আইনে বলা আছে, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন নিতে হলে সেই দলের ঢাকাতে একটি কেন্দ্রীয় কার্য্যালয়, জেলা ও উপজেলাগুলিতে ন্যূনতম এতজন সদস্য, এতগুলি কমিটি, এতগুলি অফিস, ৩০ ভাগ মহিলা সদস্য থাকতে হবে। এটি বাধ্যতামূলক হবে কেন? মহিলা সদস্য ঠিক ২০/২৫ বছরেও বড় বড় সুপরিচিত পুরাতন দলগুলিও ৩০ ভাগ সদস্য তাদের নানা কমিটিতে গ্রহণ করতে পারে নি। মূল কথা হলো, কাউকে জোর করে এন সদস্য করা যায় না- আগ্রহ নিয়ে সদস্যপদ দলীয় নিয়মকানুন মেনে গ্রহণ করতে হয়। সাধারণভাবে এ ক্ষেত্রে আজও আমাদের নারী সমাজ, যথেষ্ট পিছিয়ে আছেন নানা কারণে। ধর্মীয় কুসংস্কার, প্রচলিত রাজনীতিতে কালোটাকা,অস্ত্র, নারী নির্য্যাতন প্রভৃতি তাঁদের এ ব্যাপারে উৎসাহে বাড়তি ঘাটতি সৃষ্টি করেছে।

তদুপরি নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রার্থী (যেমন ৫০ বা ১০০) দলীয় মনোনয়নে সাংসদদের ভোটে নির্বচিত হবেন- এমন বিধান থাকায় নতুন কোনো দলে যোগ দিতে নারী সমাজ আগ্রহ বোধ করেন না। এরূপ পরোক্ষ নির্বাচন সচেতন নারী সমাজও চান না। তাই এই বিধানটি তুলে দিয়ে নারীর জন্য ১০০/১৫০ আসন রিজার্ভ রেখে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে এ ব্যাপারে নারী সমাজ নিশ্চিতভাবেই অনুকূল সাড়া দেবেন। তাই উক্ত আইনটি আলিম্বে রদ করে সরাসরি নির্বাচন ব্যবস্থা এই মূহুর্ত থেকেই চালু করা প্রয়োজন।

এবারে আসি নানা পর্যায়ে কমিটি,অফিস ও নূন্যতম সংখ্যক সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক-এমন বিধান সম্পর্কে। আসলে একটি রাজনৈতিক দল যখন নতুন গঠিত হয় তখন (অসৎ, দূর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিকরা যদি তা গঠন না করে থাকে) সকল পর্যায়ে সদস্য অফিসঘর (অত্যধিক ব্যয়সাধ্য ও দুষ্প্রাপ্যও বটে) পাওয়া সম্পূর্ণ অবাস্তব। দলটিকে সেই পর্যায়ে যেতে বছরে পর বছর তার নীতি, আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে তার সততা প্রভৃতি সম্পর্কে তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে প্রচার, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সমাজকল্যাণমূলক কাজ প্রভৃতির মানুষকে আকৃষ্ট করতে হবে। জনগণের মূল সমস্যাসমূহ সমাধানের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই তা সম্ভম। এটা কতদিনে বা কত বছরে হবে তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল গঠণ ও সেগুলির বিকাশও আমার উক্ত অভিমত কে পুরোপুরি সমর্থন করে।

তাই এসব বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে দলটি মেনিফেষ্টো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ কিনা এবং মেনিফেক্টো তে বর্ণিত কর্মসূচী সাম্প্রদায়িকতা- বর্জিত, পরিপূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ায় অঙ্গীকার সমৃদ্ধ কিনা তা দেখেই এবং একটি কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকলেই দলটি নিবন্ধন পেতে অধিকারী-এমন বিধান করা অপরিহার্য। কারণ, দল গঠন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার।

ব্যক্তিগতভাবে আমি ১৯৪৮ সাল থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে ওতঃপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। বিশাল ইতিহাসের সাক্ষী আমি। সেই ইতিহাসের কিছু কথা বলি।

আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এর সাধারন সম্পাদক শামসুল হক । অল্পকাল পরেই শামসুল হকের মৃত্যু ঘটায়, ঐ পদে আসীন হন শেখ মুজিবুর রহমান(এই সভাপতি ও সম্পাদকের চাইতে জনপ্রিয় এবং গণমুখী নেতৃত্ব কল্পনা করা যায় কি?)। দলটি গঠণের সময় তো দূরের কথা, ৫ বছর পরে যখন ১৯৫৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখনও দলটির সব জেলা ও থানায় কমিটি গঠন সম্ভব হয় নি। ঐ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ গণভিত্তি পেতে থাকে। যুক্তফ্রণ্টের ভূমিধস বিজয় সম্ভব হয়েছিল মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা শূণ্যের কোঠায় নেমে যাওয়াতে, ভাষা আন্দোলোনের উত্তাল ঢেউ এর কারণে এবং সর্বোপরি শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর মত তিন দিকপাল নেতার নেতৃত্ব এবং অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পন্ন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দিবারাত্র পরিশ্রম ও ছাত্রলীগ- ছাত্র ইউনিয়নের তথা ছাত্র সমাজের সমগ্র প্রদেশে ক্লান্তিহীন কর্মকা-ের ফলে।
প্রকৃত প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ তে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষনার পর বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল ।

আর একটি কথা। নিবন্ধিত দলগুলির মধ্যে কয়টি পূর্বোক্ত শর্তসমূহ পূরণ করতে পেরেছে বা পারছে- তৃণমূলে সারা দেশে খোঁজ নিলেই প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে। তাই বলে এ নয় যে তারা নিবন্ধনের অযোগ্য বা নিবন্ধন প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। বরং অবশ্যই সকলের নিবন্ধন বজায় থাকতে হবে এবং নির্বাচন কমিশন নতুন দল নিবন্ধন আইনে বর্নিত নিবন্ধনের শর্তসমূহ বাতিল করতে হবে। তবেই তা হবে গণতান্ত্রিক।

কোন দলের কয়জন সদস্য, কতগুলি অফিস, কতগুলি কমিটি থাকবে তা দলটিরই বিবেচ্য। তার সুফল-কুফল যাই হোক- তা ঐ দলগুলিই পাবে- নির্বাচন কমিশন নয়।

তিন. স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে যে বিধানটি রয়েছে তা সম্পূর্ণ গণতন্ত্র- বিরোধী ও অবাস্তব। কি করে সারা দেশ থেকে তার বা বিশাল নির্বাচনী লোক থেকে হাজার হাজার ভোটারের সাক্ষর সংগ্রহ করে মনোনয়ন চাইবেন? এ আইন তুলে দিয়ে এবং তার পরিবর্তে মনোনয়ন ফি দিয়ে এবং ঋনখেলাপি বা অপ্রকৃতিস্থ বা সাজাপ্রাপ্ত ইত্যাদি না হলে তার প্রার্থীতা মেনে নিতে হবে- এটাই গণতন্ত্র। এমন প্রার্থীদের কেও নির্বাচনি মোলফেষ্ঠো কমিশনে দাখিল করতে হবে।

স্মরণে রাখা প্রয়োজন, নির্বাচন কমিশন জনগণ বা রাজনৈতিক দল- সমূহের প্রভু বলে নিজেকে বিবেচনা না করে তাদের সেবক বলে ভাবতে হবে।

চার. আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রচলিত বিধানে কেউ দলের প্রার্থী বা স্বতন্ত্রপ্রার্থী তাঁর প্রতিদন্দ্বী প্রার্থীদের চেয়ে এক ভোট বেশি পেলেই তাঁকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়। এটি দলীয় ভিত্তিক নির্বাচন কে অস্বীকার করে।

তাই অত্যন্ত যৌক্তিক বিধান হবে প্রার্থীর তালিকাpreferentially প্রত্যেক দল নির্বাচনের তিন মাস আগে নির্বাচন কমিশনের কাছে দাখিল করবেন। ভোট হবে দলীয় ভিত্তিতে। যে দল শতকরা যতভাগ ভোট পাবেন- সে দল ততভাগ আসনে বিজয়ী হবেন। নির্বাচন কমিশন ভোট প্রাপ্তির শতাংশ অনুযায়ী এবং দলগুলির প্রদত্ত তালিকা থেকেpreferentially নির্বাচিত ঘোষণা করবেন। এটি হবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিধান এবং প্রকৃত অর্থে অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন এভাবেই নিশ্চিত করা যেতে পারে।

পাঁচ. নির্বাচন নিয়ে মামলা হলে তা পরিচালনার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে রাখতে হবে। কোনো দল বা প্রার্থী মামলা দায়ের করলে তা দায়েরের দিন থেকে ছয় মাসের বা ১০০ কার্যদিবসের মধ্যে বাধ্যতামূলক- নিষ্পত্তি করতে হবে। আপিল নিষ্পত্তির সময় হবে সর্বাধিক তিন মাস বা ৫০ কার্যদিবস।

ছয়. দলগুলি এবং প্রার্থীদের আয়- ব্যয়ের হিসাব নির্বাচনে মনোয়ন গ্রহণ কালে দাখিল করতে হবে এবং কমিশন তা প্রতি বছর, তদন্ত করে জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন।

এমন বিধিমালা প্রণীত হলে নির্বাচন জনগণের কল্যাণমূখী হবে- এমটা বিশ্বাস করি।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test