E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে

২০২২ জুন ২০ ১৫:৫৪:৫৭
মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে

আবীর আহাদ


জাতীয় জীবনে যাদের উল্লেখযোগ্য কিছুই হওয়ার কথা ছিলো না, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের সূত্রে তাদের অনেকেই এ-দেশে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী এমপি বিচারপতি সেনাপতি সচিব শিল্পপতি প্রভৃতি হয়ে আসছেন! কিন্তু যাদের শৌর্য বীর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীন হলো, সেই মুক্তিযুদ্ধের-যোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের রাষ্ট্রীয় তথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কাউকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা গেলো না যদিও নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে একমাত্র বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি মাসিক সামান্য ভাতার প্রচলন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে চাকরির ক্ষেত্রে একটি কোটা প্রদান করে গেলেও বিভিন্ন সরকারের কর্তাব্যক্তি ও আমলাতান্ত্রিক চক্রান্তের দরুণ সেই কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কোনো কাজে লাগেনি। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও আমলারা মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি বঙ্গবন্ধু-কন্যার হাত দিয়ে বাতিল করিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে ! একথা আজ নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধবিজয়ের ফসল সমাজের প্রায় সবাই দু'হাতে লুট করে আখের গুছিয়ে নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের ৯০% ভাগ চরমতম মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের এ-করুণ অবস্থার কারণ এই যে, তারা তাদেরই ত্যাগে সৃষ্ট দেশটাকে ভালোবেসে কোনো প্রকার অন্যায় না করে নিরবে-নিভৃতে অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। তাদের করুণ অবস্থার ছাপ একইভাবে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান তথা পরিবার-পরিজনের ওপরেও। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বদৌলতে মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী অপশক্তি বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার অপমৃত্যু ঘটিয়ে, গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে রাজনৈতিক দলীয় আর্থিক ও আত্মীয়তার অন্ধস্বার্থে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিপুল পরিমাণ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি হাজার হাজার রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের মর্যাদা ম্লান করে দিয়েছে! অথচ বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার ইচ্ছে করলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে উচ্ছেদ করা কোনো কঠিন কিছুই ছিলো না। এ অবস্থায় আমরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদ ও প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশও পেশ করেছি। সেটি হলো, উচ্চ আদালত, সামরিক বাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডারদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমিশন গঠন।

আসলে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার অনীহার কারণে মুক্তিযোদ্ধা সম্প্রদায় নিজভূমে আজ পরবাসী হয়ে পড়েছে! মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের সব ফসল সবাই ঘরে তুলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও বাঁচার অধিকার পদদলিত করে আসার মধ্য দিয়ে ঐ সুফলভোগীরা আসলে কী বার্তা দিয়ে আসছেন ? তাদের হৃদয় মনে হয় এখনো মৃত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আবদ্ধ। আর সেই পাকিস্তানকে ভাঙার অপরাধে প্রথমে তারা সরিয়ে দিয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী চার জাতীয় নেতাকে এবং সর্বশেষ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তারা দু:খে কষ্টে অপমানে অবহেলায় অমর্যাদায় রেখে মনের ঝাল মিটিয়ে চলেছে ! মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের এহেন কার্যকলাপে আমরা যতোটা না দু:খ পাই, তারচেয়েও বড্ড বেশি মনে কষ্ট লাগে যখন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগ দোর্দণ্ড প্রতাপে একনাগাড়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাবস্থায়ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও ভাগ্যোন্নয়ন ঘটছে না!

মুক্তিযোদ্ধারা আজ জীবনের শেষপ্রান্তে অবস্থান করছেন। অধিকাংশই বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তারা রোগে শোকে ধুকে ধুকে মরছেন। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় তাদের চাওয়া তো অপরিসীম নয়। তারা তাদের ঐতিহাসিক কর্মের রাষ্ট্রীয় তথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায়। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অপসারণ চায়। দু'বেলা দু'মুঠো আহার চায়। মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই চায়। সন্তানদের একটা গতি চায়। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের আকাশচুম্বি শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বের অবদানের কোনো বিনিময়ে নয় দেশের নির্মাতা ও শ্রেষ্ঠ সন্তান হিশেবে তাদের এ-টুকু মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে সরকার তথা রাষ্ট্রেরই তো সানন্দে এগিয়ে আসা উচিত। ঠিক এ নিরিখে আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে দেশের বিপুলসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধার সমবেত-স্বাক্ষরে গত কিছুদিন পূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে ৮ দফা সম্বলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেছি। আমরা এখনো আশা করি যে, সরকার তথা রাষ্ট্র দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মৌলিক মানবিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে একটি কার্যকর সমাধানে এগিয়ে আসবে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার যদি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ইতিহাস তাদেরকেও ক্ষমা করবে না।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা।

পাঠকের মতামত:

৩১ মে ২০২৩

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test