E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধা ডিজিটাল সনদ প্রত্যাখ্যান প্রসঙ্গে

২০২২ জুলাই ০৪ ১৫:২৬:৩৭
মুক্তিযোদ্ধা ডিজিটাল সনদ প্রত্যাখ্যান প্রসঙ্গে

আবীর আহাদ 


মুক্তিযোদ্ধা তালিকা। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্ন। এটা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বের প্রশ্ন। জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। এটা নিয়ে ছলচাতুরি, তামাশা, গোঁজামিল ও জালজালিয়াতি চলবে না। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকাররাও স্থান পাবে...

এসব কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া হবে না; এটা অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমতুল্য অপরাধ। ইতিমধ্যে প্রকাশিত সমন্বিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার গতিপ্রকৃতি দেখে এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকার নামে হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদের নামও মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে পরিগণিত হচ্ছে! বিশেষ করে কয়েক পর্বের তালিকার মধ্যে যখন ভারতীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের নাম প্রকাশিত না হলেও শুধুমাত্র গেজেট বা লাল তালিকার অনেক বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধার নাম চূড়ান্ত তালিকায় চলে এসেছে, তখন তালিকাটা যে স্বচ্ছ নয়, সেটাই প্রমাণিত হয়।

নানান তথাকথিত যাচাই বাছাই, ধানাই পানাই, জালজালিয়াত করে বর্তমানে ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড প্রদানের নাম করে মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে, সেটা নিয়েও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে বিরাটসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকাররাও রয়েছে বলে আমাদের অনেকেরই কাছে প্রমাণ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অভিযোগ দেয়া হলেও জামুকা নানান ছলের আশ্রয় নিয়ে তাদেরকেই বহাল রেখে দিয়েছে এবং অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবে যাকে-তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েই চলেছে!

কারা প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা... তাদের সংজ্ঞা বঙ্গবন্ধু সরকার সেই ৭২ সালেই নির্ধারণ করে গেছেন। সেই সংজ্ঞাটি হলো: "মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো একটি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন"। তাই নতুন করে অন্য কোনো গোঁজামিল সংজ্ঞার আর কোনো প্রয়োজন নেই। বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বসাকুল্য সংখ্যা ১ লক্ষ ৫০ হাজারের নিচে হলেও, বর্তমানে প্রস্তুতকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কমপক্ষে ৫০ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে।

এই তো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয় তাঁর চিরাচরিত অতিকথনের ধারাবাহিকতায় ক'দিন আগে ঘোষণা করেছেন যে, চলতি জুলাই মাসের মধ্যে ৩৭ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ঐতিহাসিক ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড প্রদানের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকেও সেই ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড প্রদান করবেন। এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও একটা ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হলেও পরক্ষণেই তারা চরম নিরাশ হয়েছেন যে, সেই ঐতিহাসিক ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অবস্থানরত বিরাট সংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকাররাও পেতে যাচ্ছে! ফলে সেই ঐতিহাসিক মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও আইডি কার্ড তাদের জন্যে একটা অমর্যাদাকর বস্তুতে
পরিণত হতে যাচ্ছে। কথা উঠেছে, অমুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা একই মর্যাদার ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড গ্রহণ করবেন না। প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা যদি এ সিদ্ধান্তে অটুট থাকেন যে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তারা এ সনদ ও আইডি কার্ড গ্রহণ করবেন না, তাহলে একটা ইতিহাস সৃষ্টি হবে। তাহলে সরকারের কানে পানি ঢুকবে ও তারা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবে।

এটা তো একটা ঐতিহাসিক আত্মমর্যাদা আত্মম্ভরিতা ও আত্মাহঙ্কারের কথা এই যে, বীর মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থাতেই তাদের শৌর্য ও বীরত্বের ভাগ কোনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দিতে পারেন না। আর সেসব ভুয়াদের মধ্যে যদি রাজাকাররা থাকে, তখন তা তো আত্মবিনাশ ছাড়া আর কিছু নয়। এ অবস্থায় ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মনে কোনো শান্তি ও স্বস্তি এনে দেবে না। সেটি একটা তামাশার বস্তুতে রূপান্তরিত হবে।

সুতরাং প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড গ্রহণ না-করার সিদ্ধান্তে আসতে পারলে, সেটিতে একটা বিরাট আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটবে, যাতে বাঙালি জাতির মনেও দৈশিক চেতনা ও আত্মমর্যাদা জাগ্রত হবে। সৃষ্টি হবে এক অনন্য ইতিহাস। ফলে আজ সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশের যে অপকর্ম দেখেও না-দেখার ভান করে আছে, তার কর্ণকুহরে তখন সেটি প্রবেশ করবে। আমাদের কথা পরিষ্কার। কোনো অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারবে না, তদ্রূপ কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বহির্ভূত থাকবেন না। তারপরও যদি সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নে এগিয়ে না আসে, তাহলে, আমরা প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের ও মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রয়োজনে নিজেরাই কমিশন গঠন করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নে নামবো।

আমরা আগেই বলেছি, " মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো একটি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন" ... বঙ্গবন্ধু সরকারের বাহাত্তর সালের এই মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে একটি উচ্চ আদালত ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে "জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমিশন" গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা উচিত ছিলো। এ সংজ্ঞা ব্যবহৃত হয়নি বলেই অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় গোঁজামিল সংজ্ঞা ও নির্দেশিকায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধার অনুপ্রবেশ ঘটার ফলে তালিকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। যারা মুক্তিযোদ্ধা নয়, তারা আজ মুক্তিযোদ্ধা সেজে মুক্তিযোদ্ধার গৌরব ও রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি ভোগ করে আসছে। তারাও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি আজ ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড পেতে যাচ্ছে! এ দু:খ, এ অপমান, এ লজ্জা আমরা কোথায় রাখবো?

অতএব, আসুন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একই অবস্থান আমরা মেনে নেবো না... যে ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও পাবে, সেটি আমরাও গ্রহণ করবো না। এটা আমাদের আত্মমর্যাদা ও আত্মাহঙ্কারের প্রশ্ন। এটা নিয়ে কোনো আপোস নয়। এটাই হোক আমাদের শপথ। এটাই হোক আমাদের প্রত্যয়। এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test