E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি কেন প্রয়োজন?

২০২২ জুলাই ০৮ ১৬:১৩:২১
মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি কেন প্রয়োজন?

আবীর আহাদ


মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে আমরা বহুদিন ধরে অন্যান্য আরো কিছু মৌলিক দাবিতে আন্দোলনে ও লেখালেখিতে লিপ্ত রয়েছি। সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতার নিরিখে গত ৬ জুলাই আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আনুষ্ঠানিক মতবিনিময় সভায় মিলিত হই। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক নিরাপদ উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ নিয়ে আমরা দীর্ঘক্ষণ ধরে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আলোচনা করি। অতীতে মন্ত্রী মহোদয় যা-কিছু অতিকথন করে থাকুন না কেনো, আমাদের সাথে আলাপ আলোচনাকালে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক, উৎসাহী, প্রত্যয়ী ও ধীরস্থির। তাতে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, আমরা যেভাবে অত্যন্ত যুক্তিশীলতার সাথে বিভিন্ন প্রসঙ্গ তাঁর  কাছে তুলে ধরেছি, তিনি হয়তো তাতেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক বিষয়াদি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছন বলে এতোটা দীর্ঘক্ষণ আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন। অতঃপর দৃঢ়ভাবে  আশ্বস্ত করে আমাদের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কিত বিষয়াদির সাংবিধানিক স্বীকৃতি কেনো প্রয়োজন এ বিষয়টি অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। এটা হতেই পারে। তবে অনেক জ্ঞানপাপী ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শব্দ দু'টির সাংবিধানিক গুরুত্ব দিতে চান না এ জন্য যে, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার যাবতীয় সুযোগ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, অথবা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, ছিলেন রাজাকার-আলবদর, অথবা এখন হয়ে গেছেন অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কোনোই গুরুত্ব নেই। বিশেষ করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা মনে করে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার আর দরকার নেই, যা পাওয়া গেছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ! সেসব জ্ঞানপাপী এবং রাষ্ট্র পরিচালক, জনগণ ও নতুন প্রজন্মের জ্ঞাতার্থে বিষয়টি সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত ধারণা দেয়ার লক্ষ্যে আলোচ্য প্রতিপাদ্যটি উপস্থাপন করছি।

আজ বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। অনেকেই এদেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, এমপি, সচিব, জেনারেল, বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিসহ আরো অনেক কিছু হয়েছেন হচ্ছেন ও হবেন এসব বড়োই পরিতৃপ্তি ও গর্বের বিষয়। সেই পরিতৃপ্তি ও গর্বের নামটিই হলো স্বাধীনতা। টেবিলের আলোচনায় বসে কিন্তু স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। একটি বিশ্বালোড়িত রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশটির স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। আর সেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পশ্চাতে রয়েছে প্রায় দেড় লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধার সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বের ইতিহাস।

কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয়, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধের অবদানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশের জাতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় (Preamble of Constitution) মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দ দু'টি স্থান পায়নি ! আমরা মনে করি না এটি সংবিধান প্রণেতারা ইচ্ছেকৃতভাবে শব্দ দু'টি এড়িয়ে গিয়েছেন। হয়তো সংবিধান রচনায় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এটি হতে পারে। অনেক দেরিতে হলেও আমিই সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে এ-বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় এনে শব্দ দু'টি সংবিধানের যথাযথ স্থানে সংযোজন করার দাবি জানিয়ে আসছি। দাবিটি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। সংবিধানে শব্দ দু'টি বিশেষ করে 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটি লিপিবদ্ধ না থাকার ফলে চরম ইতিহাস বিকৃতি ঘটছে। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে গোলমালের বছর, গৃহযুদ্ধ, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ইত্যাকার অপবিশেষণে মণ্ডিত করে গোটা রক্তাক্ত মুক্তিসংগ্রামের পথ বেয়ে অনুষ্ঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে থাকেন! মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি তথা অস্বীকার করে থাকেন!

অনেক বিদগ্ধজন এ-যুক্তি পেশ করেন যে, মুক্তিসংগ্রামই মুক্তিযুদ্ধের নামান্তর। তাই যদি হবে তাহলে বাংলা ভাষার অভিধানে মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দ দুটি ভিন্নভাবে লিপিবদ্ধ হতো না। এমনকি ইংরেজি ভাষায়ও এ-দু'টি শব্দের ভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন, Liberation Struggle (মুক্তিসংগ্রাম) ও Liberation War / War of Liberation (মুক্তিযুদ্ধ)। মুক্তিযুদ্ধ হলো একটি জাতির জাতীয় স্বাধীনতা ও আর্থসামাজিক মুক্তি তথা জাতির সার্বিক মুক্তির আকাঙ্খা, আর সেই মুক্তির আকাঙ্খা বাস্তবায়নের প্রয়োজনে সংগঠিত হয় যে সশস্ত্র যুদ্ধ সেটাই মুক্তিযুদ্ধ। উনিশশো একাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুর সুমহান নেতৃত্বে সেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। এখানে ঐতিহাসিক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধই মুখ্য।

অনেকে যারা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও জীবনের মায়া ও দেশপ্রেমের অভাবে তাতে অংশগ্রহণ করেননি এবং অনেকে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিলো, তারা তাদের মানসিক দৈন্যতা ও পরশ্রীকাতরতার জন্যে মুক্তিযুদ্ধকে এখনো মেনে নিতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম শুনলে তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়। অথচ তারাই মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় ফসল দু'হাতে লুটেপুটে খাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গাত্রদাহের মুখ্য কারণ হলো, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের সিংহভাগই ছিলেন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। সেই দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধারা দেশটি স্বাধীন করে এমন একটি ঐতিহাসিক কাজ করে ফেলেছেন যার ফলে তথাকথিত ধনিক ও সুবিধাবাদী-পরজীবী শ্রেণী সহজে তাদের স্বীকৃতি দিতে চান না! তাদের অনেকেই আবার অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক সংযোগে মুক্তিযোদ্ধা বনেও গেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা সবার আগে লুটে নিয়েছেন। এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বিষয়ে একেবারে নীরবই শুধু নয়, এসব দাবির বিপক্ষে তাদের অবস্থান। তারা মনে করে, মুক্তিযোদ্ধা হতে পেরেছি, এটাই তো গর্বের, আর কী? এরাই মূলত: মুক্তিযোদ্ধাদের চরম শত্রু। এরা রাজাকারদের সমগোত্রীয়। রাষ্ট্রদ্রোহী। আর শাসকগোষ্ঠী? তারা মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু ফসল ভোগ করে আসছেন, কিন্তু তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে উদাসীন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরই প্রতিষ্ঠিত দেশে মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছেন। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বদান্যতায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি যৎকিঞ্চিত মাসিক ভাতা পাচ্ছেন।

জাতীয় সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দ দুটি সংযোজনের বিষয়ে অনেকে এ-অভিমত প্রকাশ করেন যে, যেহেতু বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দদ্বয় সংযোজিত হয়নি, সেহেতু এখন সংবিধানে তা লিপিবদ্ধ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তর সালের সংবিধানে অনেক কিছুই লিপিবদ্ধ হয়নি বিধায় বিগত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সংবিধানে অনেক কিছুই লিপিবদ্ধ হয়েছে। সংবিধান কোনো কোরআনের বাণী নয় যে তাতে হাত দেয়া যাবে না। জাতীয় স্বার্থে ও সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান পরিবর্তন পরিবর্ধন সংযোজন ও বিয়োজন হতেই পারে। তা হয়েছে হচ্ছে এবং হবেই। সেক্ষেত্রে জাতীয় ইতিহাসের সবচে' মর্যাদাপূর্ণ বিষয় 'মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ' শব্দদ্বয় সংবিধানে সন্নিবেশিত হলে বরং আমাদের জাতীয় মর্যাদা ও গরিমা মহিমান্বিতই হয়।

আমরা তো এও জানি, জাতীয়, সময় ও ব্যক্তিস্বার্থের প্রয়োজনে জাতীয় সংবিধানে অনেক সংশোধনী সংযোজন ও বিয়োজন হয়েছে। সে-ক্ষেত্রে জাতীয় ইতিহাস ও মর্যাদার প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দ দু'টি সংবিধানে সংযোজন করতে অসুবিধা থাকার তো কোনো কারণ নেই! মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্বসুযোগ ভোগ করা যাবে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা যাবে না----এটা কি মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চরম অবজ্ঞা নয়? এটা কি পরম সত্যকে অস্বীকার করা নয়? এটা কি ইতিহাসের চরম বিকৃতি নয়? অসত্য ও বিকৃতি নিয়ে একটা সভ্য জাতি কি এভাবে চলতে থাকবে?

এ প্রশ্নগুলো সেদিন আমি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়কেও করেছি। সব শুনে তিনি বলেন, বিষয়টি সংবিধানে সংযুক্ত করা সহজ হবে, কারণ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। আপনারা প্রস্তাব দিন, আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের কাছে যথাযথ তুলে ধরবো।' হ্যাঁ, মাননীয় মন্ত্রীর পরামর্শ স্মরণে রেখে অচিরেই আমরা সংবিধানের কোথায় কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধা শব্দ দু'টি সংযুক্ত করতে হবে, সেটির একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপনাসহ আমাদের মৌলিক দাবিনামা তাঁর মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে পেশ করবো। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী হিশেবে তিনি যেসব কথা দিয়েছেন, সেকথার ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। আর আমরাও নাছোড়বান্দা হয়ে তাঁর কথা বাস্তবায়নের জন্য এখন থেকে লেগেই থাকবো বলে তাঁকে বলে রেখেছি।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test