E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

টাঙ্গাইলে ও নড়াইলে আবার মন্দিরে হামলা, শেষ কোথায়?

২০২২ জুলাই ২২ ১৭:১৬:২৯
টাঙ্গাইলে ও নড়াইলে আবার মন্দিরে হামলা, শেষ কোথায়?

রণেশ মৈত্র


টাঙ্গাইলের মীর্জাপুর। শতাব্দীরও বেশীকাল স্থানটি অবিভক্ত ভারত জুরেই খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করেছিল - মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য রচনার ক্ষেত্রে। এ ছাড়াও শিক্ষা, দীক্ষা, দান-ধ্যান কী-না! আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি মীর্জাপুরের গৌরবগাঁথা।

যৌবনে ছোটমেয়েকে পাঠিয়েছিলাম মীর্জাপুর ভারতেশ্বরী হোমসে পড়তে। বছর কয়েক আগে আদরের এক নাতনীকেও সেখানে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। সেখানকার ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাবেক অধ্যক্ষ প্রতিভা মুৎসুদ্দী আবার সমসাময়িক - একজন সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতাও। তিনি বয়সের ভারে ন্যুজ্ব কিন্তু সদা সক্রিয় স্কুলটির উন্নয়ন চিন্তায় মগ্ন। দিদি বলে ডাকি তাঁকে - যেমন সনজিদা খাতুনকে ডাকি সনজিদা দি বলে। সনজিদা দিও আজীবন শিক্ষক এবং ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন নেত্রী কিন্তু নিঃসন্দেহে উভয়েই দেশবরেন্য।

মীর্জাপুর দানবীর রনদা প্রসাদ সাহার স্মৃতি আজো অনেকটা ধরে রেখেছে তাঁর বংশধরদের ও প্রতিভা মুৎসুদ্দীর কল্যানে। ঘন ঘন না হলেও মাঝে মধ্যে পাবনা - ঢাকা - পাবনা যাতায়াতে কখনও কখনও দেখাও করি প্রতিভা দি’র সাথে। অল্প সময়ের জন্য সাক্ষাত করলে কি আনন্দিতই না হন। দৃশ্যতই ব্যস্ত হয়ে পড়েন কোন বইটা উপহার দেবেন - কি খাওয়াবেন - এ্ইসব চিন্তায়। আর ওই বিশাল এলাকাটি কতই না শান্ত, স্নিগ্ধ ও পবিত্র! সেখানে মন্দিরে হামলা?

দেশের কর্তাব্যক্তিরা নিঃসন্দেহে সমগ্র জাতির কাছে প্রশংসার পাত্র। হিন্দুদের মন্দির ভাংলে, পোড়ালে, বিগ্রহ ভাংচুর করলে ধর্মের কোন অবমাননা হয়না - বস্তুতঃ কোন অপরাধই হয়না। কিন্তু কোন মসজিদের কাছে নোংরা-আবর্জনা থাকলে তা নিয়ে মসজিদের কাছে নোংড়া-আবর্জনা থাকলে তা নিয়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোষ্ট দেওয়া মাত্র “ইসলামের অবমাননা” হয় এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে ওই পোষ্ট দাতাকে (যদি তিনি অমুসলিম হন) তৎক্ষনাৎ কারাগারে পাঠানো হয়। এতে সময় লাগেনা আদৌ। কিন্তু পোষ্টে কি আছে তা না দেখেই হাজার হাজার মানুষ মসজিদের মাইকের প্রচার শুনে গ্রামশুদ্ধ হিন্দু বাড়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পোড়ানোর বহু ঘটনা ঘটলেও শাস্তি পেল পোষ্টদাতা - শাস্তি দেওয়া হলোনা অপরাধীদের, যারা বাড়ীঘড় ভাংগলো, পোড়ালো, লুটপাট করলো। এই যদি হয় সরকারের নীতি, তবে নিশ্চয়ই মানতে হবে বাংলাদেশ “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক আদর্শ দেশ”।
এই ‘আদর্শ দেশ’ এর সর্বশেষ নমুনা বিগত ১৬ জুলাই এর কতিপয় দায়িত্বশীল দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে ষ্পষ্টভাবেই দেখানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছেঃ

দু’দিনের ব্যবধানে পৃথক দুটি ঘটনায় তিনটি মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুর ও মন্দিরের অর্ধশতাধিক ফলজ গাছ কেটে ফেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৩ জুলাই বানাইল ইউনিয়নের ভুষুন্ডি গ্রামের রথখোলা মন্দিরে এবং ১১ জুলাই পানিশাইল গ্রামে মন্দিরের জমি দখলকে কেন্দ্র করে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় এলাকার দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

জানা গেছে, বানাইল ইউনিয়নের ভুষুন্ডি গ্রামের রথখোলায় ৭৯ শতাংশ দেবোত্তর জমিতে রাধা গোবিন্দ ও কালী মন্দির রয়েছে। শত বছরের পুরনো এই মন্দির প্রাঙ্গনেবছর জুড়ে বিভিন্ন পূজা-পার্বন ছাড়াও প্রতিবছর রথযাত্রা ও মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠান হয়। মন্দিরে খোলা মাঠের মত জায়গা থাকায় ছোট ছেলে-মেয়েরা সেখানে খেলা-ধুলাও করে।

এদিকে মন্দিরের খোলা মাঠ দখলে নেওয়ার জন্য ওই গ্রামের একটি পক্ষ দীর্ঘদিন যাবত মন্দির কমিটির লোকজনের সঙ্গে বিরোধ করে আসছে। এ নিয়ে একাধিক মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে বলে জানা গেছে। শত বছরের পুরনো মন্দিরটি রক্ষায় পাকা বাউন্ডারী করার জন্য সরকার থেকে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সে কাজ করতেও অপর পক্ষ বাধা প্রদান করেছিল। পরে স্থানীয় প্রশাসন উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির সুরাহা করায় বাউন্ডারি নির্মানের কাজ চলমান রয়েছে।

এদিকে গত বুধবার বিকেলে ঐ গ্রামের আবুল খায়ের বকলির নির্দ্দেশে তাদের লোকজন খোলা জায়গায় লাগানো ৫০/৬০টি উঠন্ত ফলজ গাছ কেটে ফেলে এবং রাধা গোবিন্দ ও কালী মন্দিরের বেশ কয়েকটি প্রতিমা ভাংচুর করে বলে অভিযোগ করেনমন্দির কমিটির প্রধান উপদেষ্টা জগদীশ চন্দ্র প্রামানিক। এ ঘটনায় ওই এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ওই এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় আজ শনিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হলরুমে বিবদমান দুই পক্ষের সভা ডাকা হয়েছে।

এদিকে মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাংচুর ও গাছ কাটার অভিযোগে বুধবার রাতে মন্দির কমিটির প্রধান উপদেষ্টা জগদীশ চন্দ্র প্রামানিক বাদী হয়ে ১০/১২ জনের নাম উল্লেখ করে মীর্জাপুর থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে আবুল খায়ের বকলি বলেন, রথখোলা মন্দিরের সামনের মাঠটি যাতে খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার হয় এবং এলাকার শিশু কিশোরেরা খেলাধুলা করতে পারে এটা আমাদের দাবি। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মাঠে সীমানা প্রাচীর নির্মান করছে। মন্দিরের সামনে কাঠের গাছ কাটার কথা স্বীকার করলেও প্রতিমা ভাংচুরের সঙ্গে তাঁদের কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে, একই ইউনিয়নের পানিশাইল (কদমতলি) গ্রামে ৩৮ শতাংশ জমির উপর রাধাগোবিন্দ বিগ্রহ আশ্রম রয়েছে। ১১ জুলাই সকালে পূজা চলাকালীন ওই গ্রামের শুকুর আলী, খালেক মিয়া ও বাদল মিয়া জমি দখল করার জন্য মন্দিরটিতে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুর করে বলে অভিযোগ করেন মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত সরকার। এ বিষয়ে ওই দিনই মন্দির কমিটির সভাপতি পলান বিশ্বাস মীর্জাপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
মীর্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ আবু সালেহ মাসুদ করিম বলেন, উভয় ঘটনার লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। দুটি ঘটনায় উভয়পক্ষকে বসিয়ে স্থানীয় প্রশাসন মীমাংসা করার চেষ্টা করছে। পরিস্থিতি শান্ত আছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিমা ভাংচুর এবং গাছ কাটার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমঝোতা বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অভিনব প্রচেষ্টা

অপরাধটা কি? মন্দিরের জমি দখল করতে না পেরে মন্দির ও প্রতিমা ভাংচুর এবং অর্ধশতাধিক ফলজ গাছ কেটে নেওয়া। যতদূর মনে পড়ে তাবৎ অপরাধ আইনতঃ আমলযোগ্য এবং জামিনের অযোগ্য এবং গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ হেন অপরাধ তো ১০/২০ মিনিটে অকস্মাৎ ঘটানো যায়না। বিশেষ করে বিরোধটি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা আগে থেকেই আদালতে ঝুলছে। সেগুলির মীমাংসা হয়নি। সেগুলি সবই আদালতে বিচারাধীন।

এমত অবস্থায় লিখিত অভিযোগের তোয়াক্কা না করে ঘটনা শুরু হওয়ার সাথে সাথে পুলিশের ছুটে যাওয়া উচিত ছিল। পুলিশ তা যায়নি। অতঃপর মন্দির কমিটি উভয় ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিলো - অপরাধী যারা তাদের নাম উল্লেখ করে। এমতাবস্থায় পুলিশের ন্যুনতম কর্তব্য ছিল - অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো - অতঃপর তদন্ত করে স্বাক্ষী প্রমান জোগাড় করে চার্জশীট দিয়ে বিচার কাজ শুরুর ব্যবস্থা করা। তা হয়নি। এমন কি, লিখিত অভিযোগকে এজাহার হিসেবেও এই নিবন্ধ লেখা পর্য্যন্ত গন্য করা বা রেকর্ড করে মোকর্দ্দমার নং, তারিখ ও অপরাধের ধারা সমূহ যোগ করার ন্যুনতম কাজগুলি করা হয়নি।

এমত অবস্থায় আপোষ ফয়সালার কথা কিভাবে এবং উদ্দেশ্যে ভাবা হলো? যতক্ষন মামলা গ্রহন না করা হয় ততক্ষন অপরাধীতো অপরাধ বলে গন্য হবেন না। তাই কর্তৃপক্ষ উভয় পক্ষকে সমান মর্যাদায় আসীন করতে চান বলে মনে হয়। তাতে কথিত অপরাধীদেরকে সম্মানিত এবং যাঁরা ক্ষতিগ্রস্থ হলেন তাঁদেরকে অপমানিতই করা হলো। এমন উর্বর মস্তিষ্ক কার তা বুঝা কষ্টকর। তবে খুব পরিকল্পিতভাবেই অপরাধীদের নির্দোষ হিসেবে দেখতে চাইছেন মীর্জাপুরের পুলিশ ও প্রশাসন এমনটাই মনে হয়।

এটুকু লিখে গতকাল শেষ করি - মীর্জাপুরের সমঝোতা বৈঠকের সর্বশেষ খবরের অপেক্ষা। কিন্তু না, আজ ১৭ জুলাই অত্যধিক আশা নিয়ে সংবাদপত্র গুলির পাতা বারবার উল্টিয়েও ওই খবরের কোন ফলোআপ খুঁজে পেলামনা।

কিন্তু পেলাম নতুন খবর - নড়্ইাল তবে মিস যায়নি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর ছাড়া হাতে সংবাদপত্র পাবো - এমনটা কি ভাবা যায়? যদিও এটা পুরোপুরি সত্য, সেলফ সেন্সরশীপ ও অপ্রকাশ্য সরকারী সেন্সরশীপ বা ডিজিটাল অপরাধের দায়ে ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে সব খবর পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পায়না। তবু যেটুকু আসে - তাই যদি ৩৬৫ দিনের তথ্য একত্রিত করে প্রকাশ করা যেত তবে রীতিমত রামায়ন - মহাভারতের মত ৮/১০ টা ভলিউম হয়ে যেত। যেহেতু খবরগুলি সংরক্ষিত করার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি, তাই তেমন কোন ভলিউম নিয়ে ভাবনার ও অবকাশ নেই।

কি ঘটেছিল নড়াইলে ?

ফেসবুকে একটি পোষ্টকে কেন্দ্র করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নড়াইলের দিঘলিয়ার সাহাপাড়া গ্রামে হিন্দু বাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় আটক কলেজ ছাত্র আকাশ সাহা ও তার বাবা অলোক সাহাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ সাহা পুলিশকে বলেছেন, যে ফেসবুক আইডি থেকে ধর্মকে অবমাননা করে মন্তব্য করা হয়েছে, সেটি তাঁর নয়। এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। এদিকে হামলার শিকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের দাবী, আকাশ সাহা ফেসবুকে ধর্মীয় কোন পোষ্টের নীচে এমন কোন মন্তব্য করেন নি, এটি পূর্ব পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। সেই পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র অনুযায়ী হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা-ভাংচুর চালানো হয়েছে।

লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, আমরা নিরাপত্তার জন্য আকাশ সাহা ও তার বাবাকে পুলিশ হেফাজতে রেখেছি। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি এখন শান্ত। লোহাগড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার গুলিকে ২৬,০০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।

জানা যায় ফেসবুকে একটি পোষ্টকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে “বিক্ষুব্ধ জনতা” আকাশ সাহা সহ কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। এ ছাড়াও সেখানকার মন্দিরের চেয়ার, সাউন্ডবক্স ভাংচুর সহ ইঁট ছোঁড়ে বিক্ষুব্ধরা। তাতে মন্দির ও বিগ্রহের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

এখন প্রশ্ন হলো - আকাশরা ভুক্তভোগী হয়েও পুলিশের হাতে ধরা পড়েন কিন্তু যারা বাড়ীর পর বাড়ী এবং মন্দির ভাংচুর করলো তারা দিব্যি আদরে বহির্জগতে স্বাধীনভাবে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে কীভাবে? তারা কি ধর্মের অবমাননা করে নি ?

লেখক : সভাপতিমন্ডলির সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test