E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরের কাছে প্রত্যাশা 

২০২২ জুলাই ২৬ ১৫:০১:৩৩
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরের কাছে প্রত্যাশা 

চৌধুরী আবদুল হান্নান


বাংলাদেশ ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের ব্যাংকার হিসেবে এবং দেশের সকল ব্যাংকের ব্যাংকারহিসেবে কাজ করে । বহুবিধ দায়িত্বের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বড় দায়িত্ব হলো দেশের ব্যাংকিংব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। বিভিন্ন আইন, বিধি-বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রক সংস্হাটি এ ক্ষেত্রেস্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকান্ডের জন্যবাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য।

ব্যাংক মূলত একটি ইউনিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইউনিক এই কারণে যে, অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতোব্যাংকের ব্যবসা শুরুর জন্য কোনো প্রাথমিক পুঁজি বা টাকার দরকার নেই, মানুষের বিশ্বাস বা আস্হাইতাঁর মূলধন।আমানতকারীদের জমা অর্থ দিয়ে ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে, কম সুদেআমানত সংগ্রহ করে আর বেশি সুদে বিনিয়োগ করে । সে কারণেই সততা ও বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় ব্যাংকারদের উত্তীর্ণ হতে হয়। রক্ত যেমন দেহ রক্ষায় অপরিহার্য, জনগণের আমানতও ব্যাংকের জন্যঅপরিহার্য। আমানতকারীরা ব্যাংকের ব্যবসার ভিত্তিমূলে রয়েছে, তাদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব ব্যাংকারদের ।

নিয়ন্ত্রণকারী সংস্হা হিসেবে বংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা নিয়ে অন্তহীন সমালোচনা দীর্ঘদিনের। স্বায়ত্তশাসিত এ সংস্হাটি “ ঠুঁটো জগন্নাথে পরিনত হয়েছে ও আর্থিক খাতের ওপর তাদের কোনোনিয়ন্ত্রণ নেই “— এমন তীব্র সমালোচনা হতে দেখা গেছে ।তাছাড়া প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, ইচ্ছাকৃতঋণখেলাপি , বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের নানামুখি চাপে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইনি ক্ষমতা থাকাসত্ত্বেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। একটি স্বাধীন সংস্হার এভাবে অনুগত, নতজানু হওয়ামানায় না। আমরা স্বাধীনচেতা, নির্ভিক মানুষ চাই। যিনি পদ আঁকড়ে থাকবেন না, নীতির প্রশ্নেআপোষহীন, প্রয়োজনে পদত্যাগ করবেন ।

এক কঠিন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেকসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার গত ১২ জুলাই পরবর্তী ৪ বছরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। বহুবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তাঁকে, কোনটি রেখে কোনটি করবেন ?

ব্যবসার নামে এক শ্রেনীর ধুরন্ধর গ্রাহক ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা অবলীলায় বের করে নিয়েযাচ্ছেন যা তারা ফেরত দেবেন না। তারা এমন বার্তা ধারণ করেন যে, ব্যাংকের টাকা পরিশোধ নাকরলে কিছু হয় না ।

এ প্রবণতা রুখবেন কেমন করে ? ব্যাংক খাতের এ সকল ‘ডাকাত’ নানাভাবে ক্ষমতাবান এবং অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্ত ।

প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে পালিয়ে যাওয়া এবং পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার একটি বেসরকারিব্যাংকের বহুল আলোচিত সাবেক ব্যবস্হাপনা পরিচালক পি কে হালদারের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের কিছু হাইপ্রফাইল ব্যক্তি নির্দিষ্ট মাসোহারার ভিত্তিতে তার অনৈতিক কাজে সহযোগিতাকরেছেন ।ব্যাংকিং খাতের দুর্বৃত্ত পি কে হালদার একজন নয়, অনেক ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের প্রথম পদক্ষেপ হবে পি কে হালদারদের ঠেকানো, তা না হলে এক সময়ব্যাংক ব্যবস্হা দেউলিয়া হওয়ার দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য।

এ অবস্থায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুস্হতা জরুরি এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্হাটির বিদ্যমানভাবমূর্তি সংকট দূর করতে হবে আগে ।

শীর্ষ পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় যোগসাজশ রয়েছে বলেঅভিযোগ আছে ।ইতোমধ্যে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পাওয়ায় জনমনে বাংলাদেশব্যাংক সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, তা সহজে দূর হওয়ার নয় ।

একজন মহাব্যবস্হাপকের ৫৪ লক্ষ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমানিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে চাকুরিচ্যুৎকরা হয়নি , শাস্তি হিসেবে দুটি বার্ষিক বেতনবৃদ্ধি বন্ধ করা হয়েছিল। (দৈনিক সমকাল তারিখ১৮-০২-১৮ ইং “গুরু পাপে লঘু দন্ড“)

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ “সততা সন্দেহজনক” এমন এক মহাব্যবস্হাপককে কীভাবে ব্যাংকের জন্যঅপরিহার্য বিবেচনা করলেন ?

ঘর সামলাতে হবে আগে, তারপর যুদ্ধ প্রস্তুতি । এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করতে পিছনেও তাকাতে হয়, কোথাও ভুল হয়েছিল কিনা দেখার জন্য। অতীতে ঘটে যাওয়া বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারীর ঘটনা মানুষ ভুলে যায়নি, তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এ সব আর্থিক দুর্ঘটনা একদিনে ঘটেনি, অনেক সময় লেগেছে, অপরাধীকে বিচারের আওতায় নিয়েআসা কঠিন কাজ নয় ।

ব্যাংকের অর্থ আত্মসাত ঘটনায় জড়িতদের বিচার করতে গিয়ে নির্দোষ কর্মকর্তাগণ যাতে হয়রানিরশিকার না হয় তা দেখতে হবে।

যোগ্য, দক্ষ, সৎ কর্মকর্তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হলে অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাংকের ভিতরেই একটি প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পাবে। যারা নৈতিকতা, সততার দায় থেকে অন্যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধেঅবস্হান নিয়ে অতীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের খোঁজ করে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে ।

ব্যাক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে “ব্যাংক কমিশন” গঠন, পর্যবেক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি চিন্তা করারআগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান বিধি-বিধান কার্যকর প্রয়োগ চাই । তাছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সফল প্রয়োগের বিষয়টিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজর রাখবে। ব্যাংকের প্রতি নজরদারি করারব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে তাদের ।এখন কেবল প্রয়োজন অর্পিত ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ। কাজটি মোটেইকঠিন নয়, ইচ্ছাই যথেষ্ট । কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারির মধ্যেই নিহিত রয়েছে ব্যাংক খাতের সুশাসন ও স্বচ্ছতা ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test