E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি : পর্ব-১১

২০২২ আগস্ট ১৭ ১৬:১৩:৫৭
বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি : পর্ব-১১

আবীর আহাদ


বিরাট লোহার গেট। ভেতর থেকে বন্ধ। অবাক হয়ে দেখলাম, দোহা সাহেবের বাসভবনের দোতলায় একটি কক্ষে বাতি জ্বলছে। গেটের পাশের একটুখানি ছিদ্রপথে দৃষ্টি দিতেই দেখলাম আমার পরিচিত বিহারী দারোয়ানটা টুলের ওপর বসে ঝিমুচ্ছে। গেটে মৃদু টোকা মারলাম। ভেতর থেকে ক্ষীণ কন্ঠে ভেসে এলো, কৌন হ্যায়!

খান সাব, দরওয়াজা খোলো। আমি বললাম। কৌন হ্যায় এতনি রাত্মে? মুঝে তুম পেহছানতে হ্যায়। আমার মাছিছ দরকার। সিগারেট ধরাবো।

খান মনে হলো আমার কন্ঠ শুনে চিনতে পেরেছে। ফলে গেটের পাশে ছোট্ট দরোজা খোলার শব্দ হলো। খান গলা বের করে বলে, আরে, আপনি!

আমি বলি, আর বোলো না, সিগ্রেটের নেশা লেগেছে, মাগার হামারা পাছ মাছিছ নেহি হ্যায়। খান ম্লান হেসে বাইরে বেরিয়ে এলো। আমি হাসি। খানও হাসে। খানকে একটা সিগারেট দিয়ে আমি নিজেও একটা ধরালাম। খান আমার খুব পরিচিত। পাশাপাশি বহুদিন বসবাস করার ফলে তার সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতাও আছে।

কয়েকটি গাড়ি ঢোকার কথা বলতেই খান চাপাস্বরে বললো, আর বলবেন না, প্রায় এমন গভীররাতে এরা এখানে আসে। কী করে জানি না, তবে ভালই লাগে, আমাকে তারা বহুত বকশিশ দেয়।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমার যা জানার জেনে গিয়েছি। খানকে আরেকটি সিগারেট দিয়ে আমি আমার বাসায় চলে আসি।

রাত তখন দেড়টা। আমার বাসা, মানে এক কক্ষের সাবলেট। সার্ট-প্যান্ট ও জুতোসমেত বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে এসব নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবলাম। আমি আজ সত্যই এক মহাচক্রান্তের আখড়া আবিষ্কার করতে পেরেছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। বার বার ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন, আমি এ কী দেখলাম! রাতের আঁধারে কতিপয় মন্ত্রী, সামরিক ব্যক্তিসহ মার্কিন দূতাবাসের! ভাবলাম, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। আমার দেশের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই কোনো জঘন্য ষড়যন্ত্র। এতো রাতে কাকে কীভাবে কী বলবো? কেউ তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কাউকে বললে উল্টো আমিই না ফেঁসে যাই! ভাবলাম, একমাত্র বঙ্গবন্ধু আমার শেষ ভরসা। তাকে এতরাতে কিভাবে এসব বলি? আমার বাসায় ফোন থাকলে না হয় বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করলে কেউ না কেউ তো ধরতো। নানান এলোমেলো ভেবে রুমে তালা মেরে বেরিয়ে পড়ি। পাশেই আমরা এক মুক্তিযোদ্ধা-বন্ধু খালেকের বাসা। আগরতলা ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত কমান্ডো বাহিনীর সদস্যও ছিলো। আমার মতো তার সাথেও বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠতা। আমাদের এ-চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই হবে।

খালেককে ঘুম থেকে জাগিয়ে সব খুলে বললাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, এক্ষণি বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাবো। যেভাবেই হোক, এ-খবর পৌঁছাতেই হবে। ভাবীও তাতে সায় দিলেন। তিনি চা তৈরি করে আনলেন। চা পান করতে করতে আমার মনে পড়লো, আমার এক চাচাতো ভাই হাবিলদার জহুর বঙ্গবন্ধুর বাসায় পাহারারত সেনাবাহিনীর লান্সার বাহিনীর সদস্য। বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনে তাঁবুতে সে থাকে। গতকাল সকাল বেলা আমার খোঁজ নিতে এসে এ-কথা বলেছিল। পেয়ে গেলাম মওকা। খালেককে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম।

তখন ভোর পাঁচটা। ধিরে ধিরে আকাশ ফর্সা হচ্ছে। আমি ও খালেক মিরপুর রোড থেকে ধানমন্ডির ৩২ নং রোডের গোড়ায় যেতেই দু'জন সেনা লান্সার আমাদের সামনে এসে গতিরোধ করলো। রাতে এ-রোড বন্ধ। কিছুতেই রোডে ঢুকতে দিলো না। নানান প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুললো। শেষমেশ আমি হাবিলদার জহুরের ভাই পরিচয় দিলে তারা স্বাভাবিক হলো। বললাম, তাকে খবর দিন, তার পারিবারিক একটা জরুরি খবর আছে।

কাজ হলো। আমাদের দাঁড়িয়ে রেখে একজন জহুরভাইকে খবর দেয়ার জন্য চলে গেল। মিনিট বিশেকের মধ্যে জহুরভাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। বললাম, তোমার তাবুর কাছে চলো, বসে জরুরি খবর বলবো। আমাদের সে নিয়ে গেল তার তাঁবুতে। ক্ষীণকন্ঠে বিস্তারিত খুলে বললাম, বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে। শুনে জহুরভাই জানালো যে, সে প্রেসিডেন্ট সাহেবের সাথে আমাদের দেখা করিয়ে দিতে কোনোই ভূমিকা পালন করতে পারবে না, তবে প্রেসিডেন্ট সাহেব একটু পরে নিচে নেমে বাসভবন-চত্বরে হাঁটতে বেরুবেন। নিচু ওয়ালের এপাশে দাঁড়িয়ে যদি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, তখন যদি ডাকেন। জহুরভাই জানে, বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব স্নেহ করেন। এটাই তার ভরসা।

আমরা তাঁবু থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনের নিচু ওয়ালের এ-পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তখন চারদিকে ফর্সা হয়ে উঠেছে। সহসা বঙ্গবন্ধু লনে নেমে এলেন। তাঁর পরনে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। হাতে পাইপ। তিনি কয়েকবার এদিকওদিক পায়চারি করার এক পর্যায়ে আমরা তাঁর দৃষ্টিতে পড়ে গেলাম। হাত উঁচিয়ে সালাম দিতেই কিছুটা বিস্মিত হয়ে পরক্ষণে হাত ইশারায় ডাকলেন। লান্সাররা গেট খুলে দেয়।

শালপ্রাংশু দেহের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ততক্ষণে রাসেলের দোলনার ওপর একখানি পা তুলে দিয়ে নিবিড় মনে পাইপ টানছেন। তাঁর মুখখানি লালচে। উজ্জ্বল। রক্তিম। থমথমে। মনে হচ্ছিলো ভাল ঘুম হয়নি। কাঁচাপাকা কয়েক গাছি চুল এসে পড়েছে কপালের ওপর। বঙ্গবন্ধুকে এ-অবস্থায় খুবই মায়াবি লাগছিল।

জাদুভরা মিষ্টিমধুর জলদগম্ভিরকন্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, কিরে মুক্তিরা! এই সাতসকালে কী মনে কইরা? কোনো সমস্যা? দেইখা তো মনে হইতেছে রাতে ঘুমাও নাই! এক নিঃশ্বাসে তিনি কথাগুলো বলে গেলেন। আমি ও খালেক বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে দাঁড়াই। তিনি দোলনার ওপর বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই তো আবার রিপোর্টার। কোনো জরুরি খবর!

আমি হঠাত্ উত্তেজিত হয়ে চাপাস্বরে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতেই বঙ্গবন্ধু সহসা প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, উহ্, ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র! কী পেয়েছিস তোরা? যখনই কেউ আমার সামনে আসে তখনি শুধু বলে ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র! তোদের খেয়েদেয়ে বুঝি কোনো কাজ নাই? শুধু হুইসপারিং হুইসপারিং! আমার রাষ্ট্রের ন'/দশটি গোয়েন্দা শাখা রয়েছে, তারা কী করে? ঘাস কাটে? তাদের কারো চোখে কিচ্ছুটি ধরা পড়ছে না, ধরা পড়ছে তোর চোখে? তুই কোন গোয়েন্দার লোক!

আমি হুহু করে কেঁদে তার পায়ের ওপর মাথা ঠেকিয়ে বলি, আপনি এক্ষণি পুলিশ পাঠিয়ে খোন্দকারকে ধরে এনে
বলা শেষ না হতেই বঙ্গবন্ধু আমাকে টেনে তুলে সস্নেহে বললেন, আমি জানিরে, তোরা মুক্তিরা আমারে কতো ভালবাসস। তারপর উদাসকন্ঠে বললেন, আমি তো একটা রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। সবসময় যদি এ-ধরনের অশনির কথা শুনি তখন আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। এখন এসব শুনতে আর ভাল্লাগে না। চারদিকে অশান্তি আর দুষ্চিন্তা নিয়ে আর কতো পেরেশানে ভুগবো? দেশটা কি আমার একার? ওরা তারা আর সব ওরা কী করে! বলেই বঙ্গবন্ধু চাপা উত্তেজনায় হাঁফাতে থাকেন। আবার বললেন, তোরাই বল, আমি এখন কী করবো? কাকে বিশ্বাস করবো? কাকে অবিশ্বাস করবো?

ঠিক তখনি অবাক চোখে দেখলাম, খোন্দকার মোশতাক এসে হাজির। তিনি গাড়ি থেকে নামছেন। তার মুখে মিটিমিটি হাসি। আমরা তাকাই সেদিকে। বঙ্গবন্ধুও তাকান। বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে একরাশ মৃদু হেসে বললেন, আসুন মন্ত্রী মহোদয়!

আমি খালেকের হাতে হেচকা টান মেরে পড়ি কি মরি ত্রস্তপায়ে সে-স্থান ত্যাগ করি। গেটের বাইরে বেরিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখি বঙ্গবন্ধু আমাদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। (চলবে)

লেখক :বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থের লেখক গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test