E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি : শেষ পর্ব

২০২২ আগস্ট ২২ ১৫:৩৬:৩২
বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি : শেষ পর্ব

আবীর আহাদ


বঙ্গবন্ধু হত্যাযজ্ঞ

বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির আরো এক ধাপ নিচে নামতেই কার যেন কান্নাচিৎকার ভেসে এলো, ওরা কামাল ভাইকে মেরে ফেলেছে!
বঙ্গবন্ধু আকাশভেদি চিৎকার করে উঠলেন, কোথায় কামাল! মেজর মহিউদ্দিন দু'পা পিছিয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু আরো এক ধাপ নিচে নামতেই মেজর নূর বঙ্গবন্ধুর দিকে স্টেনগান তাক করে বাজপাখির মতো ছুটে এসে মহিউদ্দিনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো।

মেজর নূর শেখ কামালের বন্ধু। কতোবার এ বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভাত খেয়েছে। তার হাতে উদ্যত স্টেনগান দেখে বঙ্গবন্ধু বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, তুমি! তুমিও?

বঙ্গবন্ধু তখনো দৃঢ়পায়ে নামছেন। ঘাতকবাহিনীর আরো কতিপয় সদস্য বঙ্গবন্ধুর দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে মেজর নূরের পাশে এসে দাঁড়ায়।

বঙ্গবন্ধু থমকে দাঁড়ান। কিছুটা বিপর্যস্ত কন্ঠে বললেন, তোমরা কামালকে কেনো মেরেছো? এখন আমাকেও মারবে নাকি? এ পরিকল্পনা দাও। তোমরাও রেহাই পাবে না।

সহসা মেজর নূর গুলী চালালো। বঙ্গবন্ধুর বুকে। একনাগাড়ে গুলী চালালো, ট্যা-ট্যা-ট্যা! পুরো স্টেনগানের আটাশ রাউন্ড বুলেট জাতির পিতার বুক থেকে পেটে বিদ্ধ হলো।

বঙ্গবন্ধু ডানহাতে বুক চেপে ধরে ধনুকের মতো বেঁকে পেছনে লুটিয়ে পড়লেন। তারপর গড়াতে গড়াতে নিচে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। রক্তের বন্যা ফিনকি দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো! তখনো তাঁর প্রিয় সিগার পাইপ বাঁ-হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরা।

এরপর ঘাতকবাহিনী বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই বেগম মুজিব পাগলের মতো ছুটে এলেন। প্রিয়তম স্বামী শেখ মুজিবকে ওভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বিকট চিৎকার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দেহকে সাপটে ধরলেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে রিসালদার মোসলেহউদ্দিন বেগম মুজিবের বুকে স্টেনগানের কয়েকটি বুলেট ছুঁড়ে দেয়। বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।

এবার খুনি সৈন্যরা দোতলায় উঠে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালাতে থাকে। বন্ধ দরজা- জানালাগুলো গুলীর আঘাতে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র সেনাবাহিনীর লেফ্টেন্যান্ট শেখ জামাল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে জড়ো হয়ে অপেক্ষা করেছিলো। সুলতানা কামাল, রোজী জামাল ও বঙ্গবন্ধুর আট বছরের কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল একে-অপরের গলা ধরে জড়োসড়ো হয়ে থরথর করে কাঁপছিল।

মেজর নূর ও মোসলেহউদ্দিনসহ কতিপয় সৈন্য বুটের আঘাতে দরজা ভেঙে সেই কক্ষে প্রবেশ করে। মেজর নূর শান্তভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা শেখ জামালের বুকে গুলী চালায়। জামাল লুটিয়ে মেঝেতে পড়ে যায়।

মেজর বজলুল হুদা ও মোসলেহউদ্দিন সুলতানা- রোজীর চুলের ঝুঁটি ধরে পৃথক করে। ভয়ার্ত রাসেল দৌঁড়ে গিয়ে পাশের ওয়ারড্রোবের পেছনে লুকায়। বজলুল হুদা ব্রাশ ফায়ার করে দুই অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ সুলতানা ও রোজীকে হত্যা করে।

একজন সৈন্য লাথি মেরে পাশের একটা দরজা ভেঙে ফেলে। বাথরুমের ভেতর বঙ্গবন্ধুর ছোটভাই শেখ নাসেরকে পেয়ে গুলী করে তাঁকে হত্যা করে। এরপর ঘাতকরা একে একে বাড়ির দু'জন কাজের লোককে হত্যা করে। অপর কাজের ছেলে রমা ও বুড়ির মা কোনো প্রকারে প্রাণ নিয়ে ছুটে পালিয়ে যায়।

এবার শুরু হলো সামরিক অফিসার ও জোয়ানদের লুটপাটের তান্ডব। কাঁচের আলমারি ভেঙে তারা কিছু টাকা, কতিপয় সোনার নৌকা ও একখানি সোনার তরবারি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু করে। কেউ কেউ বালিশ তোষক ও জাজিম উলটেপালটে খোঁজাখুঁজি শুরু করলো। প্রতিটি ঘাতক কিছু না কিছু হস্তগত করে নিচে নামতে লাগলো।

মেজর নূর তখনো শিশু রাসেলকে খুঁজছিল। সহসা তার সন্ধান পাওয়া গেল। রাসেল ওয়ারড্রোবের পাশে বসে গালে হাত রেখে থরথর করে কাঁপছিল। মেজর নূর এগিয়ে আসতেই সে আর্তনাদ করে ওঠে, আমাকে মেরো না ! আমাকে মার কাছে নিয়ে চলো!

শিশু রাসেলের করুণ চাউনি আর বুক ফাঁটা আর্তনাদ দেখে পাষাণখুনি নূর হো: হো: করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

এ-সময় সেখানে এসে পৌঁছয় বঙ্গবন্ধুর বাসার পিএ ঘাতকের গুলীতে আহত মুহিতুল ইসলাম। তাকে দেখেই রাসেল তার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষীণকন্ঠে বলে, ভাইয়া, ওরা আমাকে মারবে না তো! মুহিত তাকে সান্ত্বনা দেয়, না, তোমাকে মারবে না।

এ-সময় মেজর নূর মুহিত ও পাশের এক হাবিলদারকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে উদ্যত বেয়নেট সজোরে আমুল বসিয়ে দেয় শিশু রাসেলের ছোট্ট বুকের মাঝে । রাসেলের ছোট্ট মরদেহ কাঁপত কাঁপতে ঢলে পড়ে শেখ জামালের লাশের ওপর।

এবার ঘাতকবাহিনী নিচে নেমে এসে লনের ওপর জড়ো হয়ে লাইন ধর দাঁড়ায়। প্রতেকের পরনের কাপড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। সবার অস্ত্র কাঁধে ঝুলানো। সবারই দু'হাতে ও বগলে নানান লুটপাটের মালামাল।

মেজর হুদা চিৎকার করে বলে ওঠে, সবক'টিকে খতম করা হয়েছে। মেজর নূর বলে, মেয়ে দু'টি কোথায়?
মেজর মহিউদ্দিন আস্তে জবাব দেয়, ওরা বিদেশে।

শেখ হাসিনা। শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুর দু'কন্যা। মাত্র কিছুদিন পূর্বে তাঁরা ড. ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে গিয়েছে। তাঁরা বেঁচে গেলেন এই নির্মম ঘাতকদের নিষ্ঠুর থাবা থেকে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে আপনজনদের স্মৃতি সারাজীবন বুকে ধুকে ধুকে বহন করার জন্য।

ঘাতকবাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞ সমাপ্ত করলো তখন ভোর পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিট।

একইভাবে ঘাতক মেজর ডালিমের নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় আক্রমণ চালায়। রব সেরনিয়াবাত তাঁর কতিপয় পুত্র-কন্যাসহ নিহত হন। অপরদিকে শেখ মণি ও তাঁর স্ত্রী অন্ত:সত্ত্বা আরজু মণি ঘাতকের গুলীতে নিহত হন। উল্লেখ্য, আরজু মণি ছিলেন রব সেরনিয়াবাতের জেষ্ঠ্যকন্যা। শেখ মণি ও আরজু মণির দুই শিশুপুত্র পরশ ও তাপস আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গেল। তেমনি বেঁচে গেলেন শেখ মণির ছোটভাই শেখ সেলিমও ।

শেখ মণির বাসভবন ছিল বঙ্গবন্ধুভবনের সন্নিকটে। ধানমন্ডিতে। শেখ মণির হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেই ঘাতক মোসলেহউদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে ছুটে আসে বত্রিশ নম্বর সড়কে এবং বঙ্গবন্ধুভবনেও তারা হত্যাযজ্ঞে সামিল হয়। ওদিকে মেজর ডালিম রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হত্যাকাণ্ড সমাপ্ত করে সোজা চলে যায় ঢাকা বেতার কেন্দ্রে।

বেতার কেন্দ্রে প্রবেশ করেই মেজর ডালিম বেতার অন করে সদম্ভে ঘোষণা করে, রেডিও বাংলাদেশ! আচ্ছালামু আলাইকুম । প্রিয় দেশবাসী । স্বৈরাচারী মুজিবকে উৎখাত করা হয়েছে! আবার সে বলে, স্বৈরাচারী মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে! খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে! অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করবেন।

গোটা অপারেশন শেষ করার পর পরই মেজর রশিদ তার মামা বাণিজ্যমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাককে বাংলাদেশ বেতারে নিয়ে আসে। প্রায় একই সময় সেখানে এসে উপস্থিত হয় তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মোশতাকের এককালীন সচিব মাহাবুব আলম চাষী। উল্লেখ্য, মোশতাক, তাহের ঠাকুর, মাহাবুব চাষী ও মেজর রশিদ এরা সবাই একই জেলা কুমিল্লার অধিবাসী। একে অপরের আত্মীয়।

তাহের ঠাকুর ছিলেন একদা ইত্তেফাক পত্রিকার একজন সিনিয়র সাংবাদিক। চাষী ছিলেন মুজিবনগরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাকের পররাষ্ট্র সচিব। বেতার কেন্দ্রে বসে এরা দু'জন মিলে নতুন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাকের ভাষণ লিখতে শুরু করে।

অপরদিকে মোশতাকের নির্দেশে মেজর রশিদ ও মেজর ডালিম একদল সৈন্য নিয়ে ছুটে গেল ঢাকা সেনানিবাসে। প্রায় ঘন্টা তিনেকের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ, উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল মোশাররফ হোসেন খানসহ বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান ও পুলিশের আইজি আবদুর রহিম নতুন অবৈধ রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাকের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলেন।

এবার মোশতাকের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ ও জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার পালা। কিন্তু ভীরু কাপুরুষ মোশতাক বেঁকে বসলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখতে চান। মুজিব নিহত হয়েছেন এখবর বারবার প্রচারিত হলেও তিনি যেন আদৌ বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন! তিনি নিজ চোখে দেখে নিশ্চিত হতে চান।

অগত্যা খুনি রশিদ সৈন্যসহ খুনি মোশতাককে নিয়ে গেল বঙ্গবন্ধুভবনে। লাশ ও রক্তের স্রোত মাড়িয়ে খোন্দকার মোশতাক কম্পিতহাতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পরীক্ষা করলেন এবং কাঁপতে কাঁপতে গাড়িতে উঠে বসলেন।

লেখক : বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বহু গ্রন্থের লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test