E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হাইকোর্টের উত্থাপিত প্রশ্নে হতাশ হলাম

২০২২ আগস্ট ২৫ ১৬:৫০:৩৮
হাইকোর্টের উত্থাপিত প্রশ্নে হতাশ হলাম

রণেশ মৈত্র


দেখতে দেখতে ৯০ তে পা রাখতে চলেছি। একক বিশাল পথ পরিক্রমা আমাদের মত দেশে যেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিপুল সখ্যাগষ্ঠি মানুষের দু’বেলা। তিন বেলা পুষ্টিকর খাদ্য জোটে না-তেমন একটি দেশে জন্মে ধীরে ধীরে ৯০ তে পা রাখতে চলেছি-এটি কম আশ্চর্য্যরে কম গৌরবের কথা নয়।

এই সুদীর্ঘ পথ যাত্রায় চোখ বুঁজে যে প্রতিষ্ঠানকে সর্বাধিক সম্মান করে এসেছি-সেটি হলো আমাদের আদালত আমাদের বিচার ব্যবস্থা। সেই আদালত যদি উচ্চ আদালত, যথা হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট হয় তবে তো কথাই নেই। আমি শুধুনই আমাদের দেশবাসী অবশ্যই গর্বিত বোধ করি যখন দেখেছি চরম প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আমাদের উচ্চাদালত মানবাধিকার সংরক্ষণে বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছেন। আমি নিজেই তার একজন সাক্ষী আরও হাজার হাজার এমন সাক্ষী আজও বেঁচে আছেন। পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতা পরবর্তীতে বে-আইনীভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দখলকারী জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে একতার হয়ে বছরের পর বিনা বিচারে আটক থাকলেও এরমধ্যে যে তিন-চারবার হাই কোর্টে রীট করেছি-প্রতিবারই রীটে জিতেছি হাইকোর্ট প্রতিবারই আটকাদেশ অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। শুধু আমি নই-হাজার হাজার রাজবন্দীর ক্ষেত্রেই সে যুগে এমনটি ঘটেছে।

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যালীলা গোটা পৃথিবীব্যাপি আলোড়ন ও নিন্দার ঝড় তুলেছিল। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গোপনে সেই ভোরেই পালিয়ে যাওয়ায় তৎক্ষণাৎ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নাহলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের কোন কোন জেলা শহরে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মীরা যৌথভাবে সাধ্যানুযায়ী প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন-তবে জাতীয় রাজনীতিতে তার তেমন একটা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি।

এই ফাঁকে সুযোগ বুঝে খোন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে না-খুনীদের বিরুদ্ধেও মামলা করা যাবে না মর্মে ‘ইনডেমনিটি মধ্যাদেশ’ নামে যে কালো আইন জারী করেছিল-হাইকোর্টই তো সে অধ্যাদেশকে বে-আইনী ঘোষাণা করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকে সম্ভব করে দিয়েছিলো।

পাকিস্তান আমলে ইত্তেফাক, সংবাদ, অবজার্ভারের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ পাকিস্তান সরকার ওই পরিত্রকাগুলির প্রকাশনা বাতিল এবং ইত্তেফাকের ছাপাখানা জব্দ করার আদেশ দিলে হাইকোর্টই তখন দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল তিনটি পত্রিকার পক্ষে, প্রদত্ত আদেশগুলি বেআইনী ও বাতিল বলে ঘোষণার মাধ্যমে।

এমন অসংখ্য ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হতে পেরে গৌরবান্বিত বোধ করি। এই উচ্চাদালত জিয়া ও এরশাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকে সংবিধান-বিরোধী ও বে-আইনী বলে ঘোষণা করে তাদের জারী করা সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীকে বে-আইনী ঘোষণা করে দেশবাসীর কাছে বিপুল শ্রদ্ধার স্থান নতুন করে দখল করে নিতে পেরেছিল। সুপ্রিম কোর্টে আপিল হলে তার শুনানীর পর সুপ্রিম কোর্ট ও এ সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। কিন্তু সরকার তা না মেনে জিয়া এরশাদের ঐ দুটি সংশোধনীকে পঞ্চদশ সংশোধনীর দ্বারা স্থায়িত্ব প্রদান করে সকল অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক শক্তির প্রবল বিরোধিতা সত্বেও।

উদাহরণের সংখ্যা আর না বাড়িয়ে এখন কেন হাইকোর্টের উত্থাপিত প্রশ্নে হতাশ হলাম সে সংক্রান্ত দৈনিক ‘সংবাদে’ ১৮ আগষ্টে প্রকাশিত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি বিবৃতির উল্লেখ করছি। তাতে বলা হয়েছে: তরুণীর পোষাক নিয়ে উচ্চ আদালতের মন্তব্য দুঃখজনক বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। গতকাল প্রচারিত এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, উচ্চ আদালতের এমন মন্তব্যে গভীর দুঃখ প্রকাশ করে মানুষের অধিকার নিশ্চিতের সর্বোচ্চ স্থান আদালতের প্রতি সম্মান ও আস্থা রেখে নারী অধিকার সমুন্নত রাখতে বিনীত অনুরোধ জানিয়েছে।

বিবৃতিতে আসক বলেছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানতে পেরেছে যে, নরসিংদী রেল ষ্টেশনে পোষকের জন্য তরুণীকে হেনস্তার প্রসঙ্গ নিয়ে উচ্চ আদালত প্রশ্ন রেখেছেন, সভ্য দেশে এমন পোষাক পরে রেলষ্টেশনে যাওয়া যায় কিনা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই খবর যদি সত্য হয় তবে ত নারীর সমানাধিকার, সাংবিধানের অধিকার, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার মানদণ্ড এবং বর্তমান সরকারের নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত নীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া এ ধরণের মন্তব্য প্রতিক্রিয়াশীলদের উদ্বুদ্ধ করবে বলে অনেকেই আশংকা করছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “দুঃখজনক হলেও সত্য যে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, এমন মন্তব্যে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। নারীর স্বাধীনতা, নারীর পছন্দ করার বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার চলাফেরার অধিকার সবই সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার সমূহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সদন দ্বারাও স্বীকৃত। একই সঙ্গে যে স্থানে পোষাককে গুরুত্ব না দিয়ে নারীর মর্য্যাদা, অধিকার ও নিরাপত্তা সর্বোত্তম উপায়ে নিশ্চিত হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এমন বক্তব্যের মাধ্যমে সেই নারীকেই পুনরায় হেনস্তা হতে হচ্ছে।

এবারে আমার মনে পড়ে, পাকিস্তান আমলে যেভাবে আমাদের মেয়েদেরকে গৃহবন্দী করার, শিক্ষা দীক্ষা বা আয় উপার্জন না করে ইসলামের নামে তাদেরকে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত করার অপচেষ্টা সরকারি উদ্যোগে গৃহীত হয়েছিল ১৯৪৮ ও বাহান্নতে এসে আমরা সে যুগের ছাত্র-ছাত্রীরা সমবেতভাবে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি, নারী-পুরুষের সমানাধিকার, বাঙালি সংস্কৃতিকে আমাদের সামাজিক ও জাতীয় জীবনে গৌরবের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করে সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। ধর্মের নামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সংগীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, নাট্যানুষ্ঠানে নারীর অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে মোল্লা গোষ্ঠির লাঠি সোটা নিয়ে পুলিশের সামনে আক্রমন খালিহাতে প্রতিরোধ করতে করতেই একাত্তরে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শহীদ তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে-নয় মাসব্যাপি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করেছিলাম।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন ও হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধায় যে সকল অঙ্গীকার ছিল-বঙ্গবন্ধু নিপুনভাবে তা প্রতিহত করে বাহাত্তরের সংবিধান রচনা করেন যা ঐ বছরের ৪ নভেম্বর সংসদ সদস্যদের দ্বারা গৃহীত ও অনুমোদিত হয়।

ঐতিহাসিক ঐ সংবিধানে নারী পুরুষদের সকল ক্ষেত্রে সমানাধিকারের সুস্পষ্ট স্বীকৃতি রয়েছে। নারীর পোষাক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে আমরা দেখি জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম এবং আফগানিস্তানে তালেবান প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদেরকে। তার বিরুদ্ধেও, খোদ আফগানিস্তানে হাজার হাজার নারী (হিজাব বর্জন করে) কাবুলের রাস্তায় প্রকাশ্যে মিছিল করে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশেও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামাল এবং আরও বিপুল সংখ্যক নারী নেত্রী ও নারী অধিকারকর্মী দীর্ঘ দিনের অবিচ্ছিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে নারী অধিকারের মূল মূল বিষয়গুলি সংবিধানে লিপিবদ্ধ করিয়েছেন।

নারীর পোষাক কি হবে-সে সিদ্ধান্ত নারীই গ্রহণ করবেন-নারীর সেই মৌলিক অধিকার সংবিধান অস্বীকার করেনি বরং স্বীকৃতি দিয়েছে। আজ তাই দরকার দেশের সমগ্র জনগণ, সরকার, পুলিশ ও অপরাপর আইন শৃংখলা বাহিনী এবংস র্বোপরি আমাদের উচ্চ ও নিম্ন আদালত সমূহ নারীর সামগ্রিক অধিকার সংরক্ষণে সর্বাধিক তৎপর হবেন।

দেশের সকল প্রগতি ও গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দল, ছাত্র-যুব-মহিলা-শ্রমিক, কৃষক ও নারী সংগঠনগুলি সর্বাত্মকভাবে নারী অধিকার সংরক্ষণে এগিয়ে আসবেন। দেশের নানাস্থানে আসবেন।

দেশের নানাস্থানে নিগৃহীত নারীর পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করবেন। মনে পড়ে গোটা পাকিস্তান আমল জুড়ে এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সামরিক শ্বৈরাচারের আমলেও আমরা দেশজুড়ে যে যে দাবীতে আন্দোলন করেছি তার মধ্যে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা ও সমাজে নারীর সমমর্য্যাদা প্রতিষ্ঠা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দাবী।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test