E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রসঙ্গে

২০১৪ অক্টোবর ১৩ ১৩:০৬:৫৩

১০ অক্টোবর ২০১৪ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে - লিভিং উইথ সিজোফ্রেনিয়া। সমাজে মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে সমাজে অন্তভুক্তির দাবীকে জনপ্রিয় করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে নানা আয়োজনের মাধ্যমে সারা বিশ্বব্যাপী দিবসটি উদযাপন করা হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মোতাবেক বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মানসিক ভারসাম্যহীনতার শিকার। আর মধ্য ও নিম্ম আায়ের দেশসমুহে এ হার প্রায় ২০ শতাংশের কাছাকাছি।

সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা সমাজে সবচাইতে অবহেলার শিকার হচ্ছে। সকল ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে এবং তাদের পরিবারকে অভিশপ্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। ফলে মানসিক সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তি ও তার পরিবার সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর প্রভাবে এই পরিবারগুলির আর্থিক সক্ষমতা ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ে শেষ পর্যন্ত নিঃস্ব হয়ে যায়। আবার প্রচলিত ‘লুনাসি এ্যাক্ট’ অনুযায়ী সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তিকে সম্পদের মালিকানা থেকে বঞ্চিত করে তাকে অর্থনৈতিকভাবে নিরাপত্তাহীন করে তার জীবনকে আরো এক ধাপ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হয়। অমানবিক এই আইন অবিলম্বে বাতিল করা জরুরী।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সুরক্ষা আইন - ২০১৩ এর আওতায় মানসিক সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তিবর্গকে প্রতিবন্ধী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনের ধারা-৬ এ উল্লেখ করা হয়েছে “মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা-সিজোেিফ্রনিয়া বা অনুরুপ ধরনের মনস্তাত্বিক সমস্যা, যেমন ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, পোষ্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা বা ফোবিয়াজনিত কোন মানসিক সমস্যা, যাহার কারনে কোন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন বাধাগ্রস্থ হয়, তিনি মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বলিয়া বিবেচিত হইবেন।” কিন্তু প্রতিবন্ধিতা জরিপ কার্যক্রমের মাঠ কর্মীদের এই আইনের বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দিক নির্দেশনা প্রদানের অভাবে তারা তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। পরিবার-সমাজ এর অসচেতনতা, তাদেরকে যথাসময়ে বাড়ীতে না পাওয়া, ভোটার আইডি কার্ড, জন্ম নিবন্ধনের কপি ঠিকমত না পাওয়া সর্বোপরি বর্তমান আইন অনুযায়ী তারা যে প্রতিবন্ধী হিসেবে তালিকাভুক্ত হবে এ বিষয়ে সমাজে যথেষ্ট সচেতনতা না থাকায় তারা প্রতিবন্ধিতা জরিপ কার্যক্রমের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। নাগরিক অধিকারবিহীন রাস্তা-ঘাটে ঘুড়ে বেড়ায় মনোসামাজিক সামাজিক সমস্যাগ্রস্থ এমন মানুষদেরকেও আইন অনুযায়ী মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হচ্ছেনা।

শারিরীক স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে রাাষ্ট্রের নীতি নির্ধারনী মহলে সচেতনতা গড়ে উঠেনি। কিছু পেশাজীবি মানুষ তাদের দায়বদ্ধতা থেকে সুশীল সমাজ ও সংবাদ মাধ্যম কর্মীদের সাথে নিয়ে সামাজিক প্রতিকুলতাকে ডিঙিয়ে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। মানুষের জীবনকালের প্রতিটি পর্যায়ে অর্থাৎ শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বৃদ্ধ বয়সে ভিন্ন ভিন্ন সময়কালে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এ বিষয়টি সম্পুর্নভাবে উপেক্ষিত থাকায় জীবনের কোন সময়কালেই এ জাতীয় সেবা না পেয়ে মানসিকভাবে সুষ্ঠু বিকাশলাভ করতে পারছিনা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ‘ডিয়াকোনিয়া’ এর আর্থিক সহায়তায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পেরেশনের আওতায় ৯ ও ১০ নং ওয়ার্ডে ৬ টি স্কুলে এবং কমিউনিটি পর্যায়ে ২ টি কৈশোর মঞ্চ গঠন করে কিশোর-কিশোরীদের মাঝে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা প্রদান করছে। সেবা নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিবর্গকে ০১৭৯১-৭৯১১৩৫ নম্বরে যোগাযোগ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

পুজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়ায় শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠার প্রেক্ষাপটে নগরায়ন এর ফলে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনে, মূল্যবোধে পরিবর্তন এসেছে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার গড়ে উঠছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, হতাশা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, রোগাক্রান্ত হওয়া, ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক নানা সমস্যার কারনে মানুষ মানসিক চাপে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকা, ক্লান্তি-অবসাদগ্রস্থতা, অস্বস্থিভাব, নিদ্রাহীনতা, মাথাব্যাথা, অতেুক আতঙ্কিত হওয়া, দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ ও বদমেজাজী হয়ে পড়া, কর্মদক্ষতা কমে যাওয়া, সুষ্ঠু ও দক্ষতার সাথে দৈনন্দিন কাজ-কর্ম সম্পন্ন করতে না পারা ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা দেয়। এভাবে দীর্ঘদিন মানসিক চাপের মধ্যে থেকে বিষন্নতাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। আমাদের দেশে আত্মহত্যা করে অনেক মানুষ মারা যায়। আগে থেকেই সচেতনভাবে বিষয়টি শনাক্ত করে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনতে পারলে তাদের এই অপমৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায়ে মনোবিজ্ঞানী, কাউন্সিলর এর পরামর্শ গ্রহন করে আমরা জীবনের নানা জটিল পরিস্থিতিকে দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে সক্ষমতা অর্জন করতে পারব। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা কথা বলতে সংকোচ বোধ করি। মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কথা বললে বা আলোচনা করলে তাকে আমরা পাগল আখ্যা দিয়ে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষনা করি।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইউনাইট্ থিয়েটার ফর সোশাল অ্যাক্শন্ (উৎস/টঞঝঅ) এর উদ্যোগে ২০১২ সালে দৃশ্যমান চরম মাত্রায় মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে ‘মনলোক’ স্ব-সহায়ক সংগঠন গড়ে তুলে তাদের সমস্যাবলী চিহ্নিত করার কার্যক্রম চলছে। এই কার্যক্রমের প্রক্রিয়ায় তাদেরকে মেডিকেল কলেজ সমুহের মানসিক বিভাগে নিয়ে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
১. চিকিৎসার আওতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই একজন সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।
২. একজন সদস্য কিছুটা সুস্থ হয়ে পুনরায় চাকুরীতে যোগদান করতে সক্ষম হন। কিন্তু চাকুরীতে শিফটিং পদ্ধতি থাকায় রাত্রিকালীন ডিউটি করার কারনে সমস্যাটি আবার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কর্তৃপক্ষের অসচেতনতার কারনে তার সুস্থ জীবনের বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে উঠছেনা।
৩. একজন সদস্যকে সংগঠনের সহায়তায় ব্যয়বহুল সেবা দিয়ে মোটামোটি সহনীয় মাত্রায় নিয়ে এসে পবিারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু এই চিকিৎসা সেবাটি স্বল্প মূল্যের ও সহজলভ্য না হওয়ায় দূরের জেলা শহরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে তারা ব্যর্থ হয়। ফলে পুনরায় তার সমস্যাটি চরম মাত্রায় দেখা দেয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
৪. একজন সদস্যের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় অনিয়মিত চিকিৎসায় কোন ফল হচ্ছেনা।
৫. একজন সদস্যের চিকিৎসা স্থানীয় জনগনের আর্থিক সহায়তায় চালানোর উদ্যোগ নেয়া হলে নিকটাত্মীয়দের কাউকে তার সেবা-শশ্রুষা প্রদানের জন্য না পাওয়ায় উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়ে যায়।
৬. একজন সদস্য চিকিৎসার আওতায় না আসার কারনে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন।
৭. একই পরিবারের দুইজন সদস্য তাবিজ-কবজ, ঝার-ফুঁক, প্রতারক কবিরাজের দ্বারা অপচিকিৎসা চালিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন।
৮. পরিবার ও সমাজের সচেতনতার অভাবে মাঝারী মাত্রার সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তিরা শনাক্তকরণের (এসেসমেন্ট) মাধ্যমে চিকিৎসার সুযোগ না থাকার কারনে শেষ পর্যন্ত মানবেতর পর্যায়ে জীবন যাপন করছেন।

‘মনলোক’ এর এই কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখা একান্ত প্রয়োজন। পরিবার ও সমাজের সচেতনতা ছাড়া কার্যক্রম সফলতা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছেনা। সরকারী-বেসরকারী যৌথ উদ্যোগে পরিকল্পনামাফিক কাজ করলে দেশে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। সরকারি হাসপাতালে সহজলভ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের প্রস্তাবনা:
১. মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের জন্য এডভোকেসি কার্যক্রম পরিচালনা করা।
২. অধিকার আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য উপজেলাভিত্তিক স্ব-সহায়ক সংগঠন গড়ে তোলা।
৩. সমাজে এ বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তোলার লক্ষ্যে পোষ্টার, লিফলেট, বুকলেট প্রকাশ করা।
৪. সমাজের বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনাসভা, সেমিনার, উঠান বৈঠক এর আয়োজন করা।
৫. সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমুহের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠান, সুচিকিৎসার জন্য ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সিলর এর নিকট রেফার করা, দিবস উদযাপন করা।

আমাদের সমাজে মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের কোন রকমের অধিকার নেই। প্রকৃতপক্ষে দেশের কোন আইন তাদেরকে সুরক্ষা দেয় না। তাদের কোন ভোটাধিকার নেই। সম্পদ-সম্পত্তির অকিার থেকে তারা বঞ্চিত। মানবাধিকার বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীকে আমরা চলতি কথায় পাগল বলে আখ্যা দিয়ে থাকি। এই জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ণ করার উদ্যোগ নেয়া জরুরী। আসুন এ দাবীর পক্ষে সোচ্চার হই। তবেই এই দিবস পালন সার্থক হবে।

প্রতিবেদক : আবুল হাসেম খান, প্রোগ্রাম অর্গানাইজার, উৎস, চট্টগ্রাম।
মোবাইল : ০১৭৩১-৪৯৩৯৭৭।

(ওএস/অ/অক্টোবর ১৩, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test