E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন নেতিয়ে পড়লো?

২০২২ ডিসেম্বর ১১ ১৫:০১:৫৬
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন নেতিয়ে পড়লো?

চৌধুরী আবদুল হান্নান


কোনো ব্যাংকে অনিয়ম, দুর্নীতির খবর পেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলকে কাল বিলম্ব না করে দ্রুত সেখানে ছুটে যেতে দেখেছি। বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনেকের কাছেই বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট-টিম মানে এক আতঙ্কের নাম। ব্যাংকের যেখানেই অনিয়ম, দুর্নীতি সেখানেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত দলের তাৎক্ষণিক উপস্থিতি।

কিন্ত এখন কী দেখছি? আমি সোনালী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক পরিদর্শনের সম্মুখীন হয়েছি, পরিদর্শক কর্মকর্তাদের আমরা সমীহ করতাম, আলাদাভাবে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতাম। পরিদর্শনে কোনো অনিয়ম পেলে, তাৎক্ষণিক সংশোধন করতে পারলে তা রিপোর্টে আনতেন না এবং সংশোধনের জন্য সহযোগিতা করতেন।

বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ট্রেইনিং প্রোগ্রামে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা অতিথি বক্তা হিসেবে আসতেন, অনেক সময় “এথিক্স ইন ব্যাংকিং” বিষয়ে আলোচনা করতেন। তাদের সততা, নৈতিকতায় মুগ্ধ হতাম। দুপুরে এক সাথে খেতে অনুরোধ করলে অনেককে কিছুটা বিব্রত বোধ করতে দেখেছি।

সম্প্রতি সমকাল পত্রিকার প্রথম পাতায় “বড় অনিয়ম জেনেও চুপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক” শিরোনামে প্রকাশিত বিশ্লেষণমূলক খবরটি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

একটি ব্যাংকে বেনামে ঋণ বের করে নেওয়া হয়েছে, এমন সন্দেহ জন্ম নেওয়ার পরও কেন সেখানে তাৎক্ষণিক পরিদর্শক দল পাঠানো হয়নি?

ব্যাংক কোম্পানি আইন ভঙ্গ করে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংক তাদের মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ মঞ্জুর করেছে এবং তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো আপত্তি তো তুলেইনি বরং তা অনুমোদন করে দিয়েছে।

এগুলো কিসের আলামত? বহুবিধ কাজের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূখ্য কাজ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারি ও তদারকি করা এবং অনিয়ম, দুর্নীতি রোধ করা কিন্ত ব্যাংকগুলো যেভাবে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে, তাতে মনে হয় এখানে তারা নীরব দর্শক, নামেই কেবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। তার প্রধান কারণ বাহির থেকে রাজনৈতিক, মন্ত্রণালয়, প্রাইভেট ব্যাংক মালিক সমিতি, ক্ষমতাবান ঋণখেলাপি বিভিন্ন পক্ষের অযাচিত চাপ।

বিস্ময়ের সীমা থাকে না, যখন দেখা যায় অনিয়ম, দুর্নীতি প্রতিরোধে বা বেনামি ঋণের প্রবাহ বন্ধে উদ্যোগী না হয়ে তারা চোখ বন্ধ করে রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন পচন হঠাৎ করে শুরু হয়নি, পচনের উপসর্গ বহু পূর্বেই আঁচ করা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন মহাব্যবস্থাপককে ৫৪ লক্ষ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমানিত হওয়া সত্তেও তাকে চাকুরিতে বহাল রাখা হয়েছিল, শাস্তি হিসেবে কেবল দুটি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বন্ধ করা হয়েছিল (সমকালে “গুরু পাপে, লঘু দন্ড” শিরোনামে ১৮/০২/১৮ ইং তারিখে খবর প্রকাশিত)।

নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের এ ঘটনা প্রকাশের পর ব্যাংক পাড়ায় ব্যাপক সমালোচনার জন্ম হয়েছিল। নৈতিক স্খলনের এমন “অবাক বিচার” বাংলাদেশ ব্যাংকে ইতিপূর্বে কেউ দেখেনি। আত্মসাতকৃত অর্থের পরিমান বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হচ্ছে নৈতিকতা। সততা ও বিশ্বাসের মানদন্ডে যারা উত্তীর্ণ নয় তাদের মতো এমন বিপজ্জনক লোক বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে আরও থাকতে পারে এমন ধারণা করার যৌক্তিকতা রয়েছে ।

ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে, দুর্বৃত্ত দ্বারা হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সীতাংশু কুমার সুর চৌধুরী (এস কে সুর) ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, দুর্নীতি রোধে নিয়োজিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিমকে ইতিবাচক রিপোর্ট দিতে মাসোয়ারা দেওয়ার বিষয়টিও পত্রিকার খবর হয়েছে।

হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটির এক তদন্তে প্রকাশ, দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ কেলেঙ্কারীর ঘটনায় দায় রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পাঁচ ডেপুটি গভর্নরসহ আরও অনেক কর্মকর্তার।

ভিতরে এমন ঘুণ পোকার বসবাস আর বাইরের অনাকাঙ্খিত চাপ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটির মেরুদন্ড দুর্বল করে দিয়েছে, যে নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়াতেই পারে না, সে কীভাবে অন্যকে পথ দেখাবে ?

যে সকল উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের নামে ব্যাংক থেকে হাজারো কোটি টাকা লোপাটের সহযোগী হিসেবে বর্তমানে চিহ্নিত করা হচ্চে তারা কেউ চাকুরিতে নেই, এখন ব্যাপক তদন্ত শুরু হয়েছে, চোর পালিয়েছে কিন্ত বুদ্ধি বেড়েছে বলে মনে হয় না। সব অপরাধের তদন্ত হয়, সব রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না।

আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি নিয়ন্ত্রণকারী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের এই যখন অবস্থা, সেক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থা সুরক্ষায় অনেকেই ব্যাংক কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন। কিন্ত কথা হলো — যারা এই কমিশনের সভাপতি/সচিব হবেন, তারা তো অন্য গ্রহ থেকে আসবেন না। তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশেরই নাগরিক এবং এ দেশের ভাত-মাছ খান, যারা ভাত-মাছ খান তারা ঘুষও খান। নতুন করে গঠিত ব্যাংক কমিশনও একদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো ঠুঁটো জগন্নাতে পরিণত হবে না তা বলা যায় না।

এমতাবস্থায় ঝিমিয়ে পড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে ঘুণ পোকা দূর করার ঔষধ দিন, সৎ ও দক্ষকর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিন এবং বাইরের চাপ বন্ধ করুন, দেখবেন আস্তে আস্তে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাটি সমহিমায় ঘুরে দাঁড়াবে। আমরা নেতিয়ে পড়া হাতি চাই না, তেজী ব্যাঘ্র চাই ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test