E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘জয় বাংলা’ স্লোগান বাঙালি জাতির চেতনা ও ঐক্যের প্রতীক

২০২২ ডিসেম্বর ১১ ১৬:০৪:০৩
‘জয় বাংলা’ স্লোগান বাঙালি জাতির চেতনা ও ঐক্যের প্রতীক

মোহাম্মদ ইলিয়াস


‘জয় বাংলা’ আমাদের চেতনার উৎস ও প্রেরণার শক্তি। এ স্লোগানকে হৃদয়ে ধারণ করে বীর বাঙালি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করেছিল। 'জয় বাংলা' ছিল আমাদের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির স্লোগন। দেরিতে হলেও 'জয় বাংলা' স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করায় বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বিত। 'জয় বাংলা'কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা চেয়ে ২০১৭ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। এর পর ২০২০ সালে হাইকোর্ট 'জয় বাংলা'কে জাতীয় স্লোগান করার নির্দেশনা দেন। তরুণ প্রজন্ম, যারা আগামীর বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে তাদের 'জয় বাংলা' স্লোগানে শানিত হয়ে মুজিব আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে কাজ করতে হবে।

মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতাসংগ্রামের পরাবৃত্ত পরিক্রমার দুর্জয় প্রান্তে বাঙালির প্রাণস্পন্দনে অনুরণিত হয় নতুন দ্রোহ। নিপীড়ন-নির্যাতন, আমানবিক শোষণ-শাসন, বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ়চেতা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, অর্জন-বিসর্জন, আনন্দ-উল্লাস, প্রত্যয়-অঙ্গীকার ব্যক্ত করার প্রতিশব্দ হিসাবে বাঙালি আশ্রিত হয়েছে ‘জয় বাংলা’ প্রতিধ্বনিতে। আমাদের সবার জানা-উনসত্তরের দুর্বার গণ-আন্দোলনের বিচয়ন ফসলের বিকল্প প্রত্যয় হচ্ছে ‘জয় বাংলা’।

১৯৪৭ এর পর থেকেই আওয়ামীলীগের নেতা শেখ মুজিব হয়ে উঠেন স্বাধীকার আন্দোলনের অগ্রপথিক। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। সারা বাংলায় সেই একই শ্লোগান জয় বাংলা, জয় শেখ মুজিব দেয়া হয়। সরাসরি এই নামকরণের মাধ্যমে আওয়ামীলীগের গণ্ডি অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর বজ্রকন্ঠে উচ্চারিত 'জয়বাংলা' শ্লোগান হয়ে যায় সকল মুক্তিকামি মানুষের।

নিরস্ত্র বাঙালি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বিশেষ করে ৭ মার্চ থেকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হায়েনা কর্তৃক গণহত্যার পরবর্তী অধ্যায় রচিত হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের অকুতোভয় রণধ্বনিতে। জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা ধ্বনিতে রণাঙ্গনে শত্রুদের পরাস্ত করতে অভূতপূর্ব শক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়।

লাল-সবুজের পতাকাখচিত বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ‘জয় বাংলা’কে ধারণ করে শুধু স্বাধীন মাতৃভূমি অর্জন করেনি; বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গড়ার প্রতিটি কর্মযজ্ঞে ও অব্যাহত অপশক্তির বিরুদ্ধে সব আন্দোলন-সংগ্রামে জয় বাংলা ধ্বনিকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। জয় বাংলা নিছক কোনো দলীয় স্লোগান নয়। এটি বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের ঐক্যের প্রতীক ও সব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপামরসাধারণের বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের ৭ জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভার ভাষণে প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেছিলেন জয় বাংলা স্লোগানের মাধ্যমে। ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব-এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা মাদারীপুরের স্কুলশিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাসের কারামুক্তি উপলক্ষ্যে কালিপদ রায় চৌধুরীর অনুরোধে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায় প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন।

এছাড়া কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় ১৯৪২ সালে প্রকাশিত নবযুগ পত্রিকার ৩ বৈশাখ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় ‘বাঙালির বাংলা’ নামক প্রবন্ধে তিনি বলেন, “বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এ এক মন্ত্র শেখাও; এ পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির-আমাদের। দিয়া ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’ তাড়াব আমরা করি না ভয় যত পরদেশি দস্যু ডাকাত রামাদের গামা’দের। বাংলা বাঙালির হোক। বাঙালির জয় হোক। বাংলার জয় হোক।”

১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় থাকার সুবাদে কাজী নজরুলের সেই প্রজ্বলিত প্রবন্ধের প্রভাবে তখন থেকেই তার অন্তরে জয় বাংলা স্লোগানকে স্থান দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জানান, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকেই বঙ্গবন্ধু এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জয় বাংলা স্লোগানের মধ্যে জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিহিত আছে।

তাই আমি মনে করি, এ স্লোগান আমাদের জাতীয় মন্ত্র। এটা সব সময়ের। আর এখন এটা সবার মাঝে আবার নতুন করে ছড়িয়ে দিতে হবে।’ বাংলা একাডেমির সম্মানিত সভাপতি সেলিনা হোসেন স্মৃতিচারণ করে গণমাধ্যমে বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শহিদ স্মরণের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। সেদিন তিনি অল্প কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্যে আমাদের মুক্তির কথা আছে। এটাই বাঙালির স্লোগান হবে।’

দেশের খ্যাতিমান বরেণ্য ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিকসহ সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, ঐতিহাসিক এ স্লোগান দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। তাই এই স্লোগান দিতে দেশপ্রেমিক কোনো ব্যক্তির অনীহা প্রকাশের অবকাশ থাকতে পারে না। কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, ‘১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীজমন্ত্র হিসাবে কাজ করে এ স্লোগান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিগত শতকের ছয়ের দশকে পরিচালিত বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে স্লোগানটি যে গতি ও শক্তি সঞ্চার করে, তার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে নেই।’

১৯৭১ সালের মার্চ থেকে স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতিটি সভা-সমাবেশ-মিছিল-প্রচারণাসহ প্রায় সর্বক্ষেত্রে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছিল। চট্টগ্রামের কালুরঘাট অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ শেষেও ‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হয়েছিল।

মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময় ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করা হতো। যার স্বাক্ষর সংগীত ছিল জয় বাংলা, বাংলার জয়। ওই কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম বেতার ভাষণটি শেষ করেছিলেন জয় বাংলা দিয়ে।

তিনি আরও বলেন, ‘জয় বাংলা কোনো দলের স্লোগান নয়, কোনো ব্যক্তির স্লোগান নয়, এটা বাঙালির জাতীয় ঐক্য প্রেরণার প্রতীক। পৃথিবীর ৬০টি দেশে জাতীয় স্লোগান আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য যে, আমরা আমাদের চেতনার সেই জয় বাংলাকে স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছরেও জাতীয় স্লোগান হিসাবে পাইনি।’

ওই রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেলসহ সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের মতামতের ভিত্তিতে বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ শুনানিতে পরবর্তী বিজয় দিবস থেকে প্রতিটি দিবসে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বস্তরের প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির ভাষণ বা বক্তব্যের শুরু এবং শেষে জয় বাংলা স্লোগান হিসাবে ব্যবহার করা উচিত বলে অভিমত দিয়েছেন।

দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ২০২০ সালের ১০ মার্চ উল্লিখিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান হিসাবে গ্রহণের রায় প্রদান করেন। রায়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, রাষ্ট্রের সব দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ সবাইকে অনুষ্ঠানের বক্তব্য শেষে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বক্তব্য শেষ করতে হবে।

এ রায় কার্যকরের জন্য সরকারকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে বলা হয়েছে। হাইকোর্ট যেহেতু সংবিধান সংশোধন বা আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাখে না, তাই সরকার চাইলে সংসদে আইন পাশ করে কিংবা সংবিধান সংশোধন করেও বিষয়টিকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার পক্ষে আদালত মতামত ব্যক্ত করেছেন।

উল্লেখ্য, রায় ঘোষণার প্রায় দুই বছর পর ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ উচ্চ আদালতের ওই নির্দেশনার আলোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ সভার বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

বাঙালি জাতি কখনো অসত্যের কাছে মাথা নত করে না। সত্যের কাঠিন্যে যে কোনো দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে শাশ্বত ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির বাহক ও সুন্দর-কল্যাণ-আনন্দ সমাহারে অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। জয় বাংলা স্লোগানের নিখাদ-পবিত্র আচ্ছাদনে বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে জয়ী থাকবেই।

পরিশেষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উচ্চারণে নিবন্ধের ইতি টানতে চাই-‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!/ ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়।/তোরা সব জয়ধ্বনি কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!/ আসছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল,/সিন্ধুপারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙ্ল আগল!/ মৃত্যু-গহন অন্ধ-কূপে মহাকালের চন্ড-রূপে-ধূম্র-ধূপে/বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ঙ্কর!/ওরে ঐ হাসছে ভয়ঙ্কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!’

লেখক :সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test