E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্বাধীনতার অপূর্ণতা, দুর্নীতি আর ব্যাংক লুটে ‘পূর্ণতা’

২০২২ ডিসেম্বর ২৫ ১৬:৪০:৩৬
স্বাধীনতার অপূর্ণতা, দুর্নীতি আর ব্যাংক লুটে ‘পূর্ণতা’

চৌধুরী আবদুল হান্নান


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “ বঙ্গমাতা “ কবিতার শেষ দুই লাইনে বলেছেন — “সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি”। সদ্য স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের পর কোনো এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্বকবির এমন লেখার জবাবে আবেগি ভাষায় বলেছিলেন, “কবিগুরু, আপনার কথা মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে, আপনি দেখে যান, আজ আমার বাঙালি মানুষ হয়েছে।” 

বাঙালির বীরত্ব ও বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম তভালোবাসা আর একবার প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বক্তব্যে। এই স্বাধীন ভূখন্ড মুক্তিযোদ্ধাদেরই অবস্মরণীয় দান। বাঙালি কখনো শাসক ছিল না, তারা চিরদিনকেবল অন্যের দ্বারা শাসিত, শোষিত হয়েছে।

শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তানিরা বাঙালি বলে গালি দিত, অনেকে রসিকতা করে, তামাশা করে বিদ্রুপ করতো — ওরা বাঙালি হয়েছে তো কি হয়েছে ! ওরা তো মুসলমান, আবার নামাজও পড়ে।

বঙ্গবন্ধু আমাদের মর্যাদার আসনে আসীন করলেন, বিশ্বমান চিত্রে জায়গা করে দিলেন কিন্ত যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠনের সময় পাননি তিনি। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাঙালিরাই তাঁকে সপরিবারে খুন করলো। তখন থেকেই বহুতর দুর্দশা জাতির ললাট লিখন হয়ে রইলো।

তিনি দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, তাঁর চারপাশে দুর্নীতিবাজদের দেখে দেখে বিরক্ত প্রকাশ করতেন। অনেক জনসভায় তিনি বলতেন — বাঙলার কৃষক, শ্রমিক দুর্নীতি করে না, দুর্নীতি করেআমাদের শিক্ষিত সমাজ।

একবার ক্যালকাটা ইসলামিয়া কলেজের তাঁর প্রিয় শিক্ষক দর্শনের অধ্যাপক সাইয়েদুর রহমান যিনি শেখ মুজিবের ছাত্রাবাস বেকার হোস্টেলেরও সুপার ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন, তখন তাঁর দুরন্ত সেই ছাত্রটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।

তাঁদের আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর শিক্ষককে বলেছিলেন — “স্যার, আপনি তো অনেক মানুষ চেনেন, দয়া করে আপনি আমাকে ১০০ সৎ মানুষের তালিকা করে দেবেন?” দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যক্তদের নিয়ে তিনি কতটা মর্মপীড়ায় ছিলেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তিনি প্রায়ই বলতেন —“আমি যা ভিক্ষা করে আনি সব চাটার গোষ্ঠী খেয়ে ফেলে , আমার গরীব কিছুই পায় না।”

রাষ্ট্রটি ৫১ বছর অতিক্রম করলেও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের কোনো চিহ্ন দৃশ্যমান নয়, দারিদ্র ও শোষণ মুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমরা কবে দেখবো ? লাগামহীন দুর্নীতি সকল অর্জন খেয়ে ফেলছে, দুর্নীতিমুক্ত কোনো ক্ষেত্র নেই, সকল সীমা অতিক্রম করেগেছে। তখন হতো পুকুর চুরি আর এখন হচ্ছে সাগর চুরি।

অর্থ ব্যবস্থার আর একটি বড় ছিদ্র হচ্ছে ব্যাংক থেকে অর্থ লুট। দেশে বর্তমানে ৬৪ মতো ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের কাজ কারবার দেখলে মনে হবে এই সব ব্যাংক সৃষ্টি হয়েছে কেবল অর্থ আত্মসাতকারী ও পাচারকারীদের কু-কর্মে অনুঘটক হিসেবে কাজ করা।

আপিল বিভাগে একটি মামলার শুনানিকালে প্রয়াত এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন — কিছু লোক লেখাপড়া করে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য, এরা হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল। এখন অনেকেই ব্যাংক করেন জনগণের টাকা লুট করার জন্য।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমানে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট ব্যাংক লুট। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে লুটেরা গোষ্ঠী ব্যাংক করছে। ১০০ কোটি টাকার মতো প্রাথমিক পুঁজি জমাদিয়ে একটি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক হয়ে ব্যাংকের “মালিক” বনে গেছেন। তারা যেন টাকার গাছরোপন করে ফেলেছেন এবং এখন তা ফলবান বৃক্ষ। এখন কেবল গাছ থেকে ফল পেড়ে পেড়ে বস্তা ভরার পালা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে — ব্যাংক মালিকরাই চার হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি (সমকাল ০৫/০৩/১৮ ইং )। ব্যাংকের টাকা লোপাটের এমন অসংখ্য ঘটনা বিরামহীন ঘটে চলেছে।

এক একটি ব্যাংক অর্থনীতির হৃদপিন্ড থেকে রক্তক্ষরণের এক একটি ছিদ্র, ইতোমধ্যে শরীরে রক্ত স্বল্পতা দেখা দিয়েছে , রক্তশূণ্যতা আসন্ন।প্রকৃতপক্ষে ব্যাংক থেকে দেশের জনগণের অর্থ লুট হয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে সরকারের কেউ মুখ খুলছে না, আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তো সাহসই নেই। সমাজের ছদ্মবেশী প্রভাবশালী এবং চিহ্নিত ব্যাংক ডাকাতদের বিচার করার আন্তরিক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যখন অকেজো হয়ে পড়ে তখন ব্যাংক ব্যবস্থাকে রক্ষা করব ?

প্রকৃতপক্ষে যাদের অর্থ তাদেরই সচেতন হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে।এখন আরও একটি মুক্তিযুদ্ধ প্রয়োজন, দেশ স্বাধীন হয়েছিল “ জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে, এবারের শ্লোগান হবে “রুখো লুটেরা, বাঁচাও দেশ।” কে দেবে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব ? বঙ্গবন্ধুর মতো আর একজন নেতা চাই।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test