E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নিয়ে কেন এ লুকোচুরি?

২০২২ ডিসেম্বর ৩০ ১৫:০৬:২২
মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নিয়ে কেন এ লুকোচুরি?

আবীর আহাদ


বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে সবচে' বড়ো গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ । আর মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী যাদের সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে মুক্তিযুদ্ধে আমরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় লাভ করেছি, ইতিহাসে তারা " বীর মুক্তিযোদ্ধা" নামে পরিচিত। "মুক্তিযোদ্ধা" শব্দটি যুদ্ধের মাঠ থেকে মুখে মুখে প্রচলিত হলেও এর পশ্চাতে একটি আইনী ভিত্তি বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একান্তই আবশ্যকীয় ছিলো।

সে-নিরিখেই স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই অর্থাত্ ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংজ্ঞা দিয়ে বলেছিলেন : মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো দলের (ফোর্স) সদস্য হিশেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন যেটির মূল ঘোষণা নিম্নরূপ : (1972) : Freedom Fighters (FF) means any person who had served as member of any force engaged in the War of Liberation.

এ সংজ্ঞাটি সরকারি গেজেট দ্বারা অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সঠিক সংজ্ঞা বলে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। এ মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা দ্বারা কেবলমাত্র 'সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা'ই মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচিত হতেন।

সরকারি গেজেট দ্বারা অনুমোদিত উক্ত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা যা অদ্যাবধি কোনো সরকার স্থগিত বা বাতিল করেছে বলে জানা যায়নি। অপরদিকে উক্ত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা বহাল থাকা অবস্থায়, সেটিকে বাইপাস করে অতীতে বিএনপি-জামায়াত সরকার ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত কোনো প্রকার সংজ্ঞা বা নির্দেশিকা প্রণয়ন না করেই, বলা চলে, গায়ের জোরে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন প্রায় ৪০/৫০ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকার আলবদর ও আলশামসদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে ফেলে! এ-বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী-এমপি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিকবার এ-অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। তারা ঘোষণাও করেছিলেন যে, তারা ক্ষমতায় এলে এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ করবেন। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা ঐসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ দূরের কথা, তারাও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে বরং ২০১৬ সালে একটি গোঁজামিল সংজ্ঞা প্রণয়ন করে। তারা বিএনপি আমলের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল তথা জামুকা নামক একটি কর্তৃপক্ষের অনুকরণ করে সেই গোঁজামিল সংজ্ঞায় অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায়, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমন সব অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সর্বনাশা অপকর্মে এখনো লিপ্ত রয়েছে!

আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১৬ সালে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় বলা হয়েছে : "যে সমস্ত জনগণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন" তারা মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিগণিত হবেন যেটির মূল ঘোষণা নিম্নরূপ
(2016) : The people who were involved in the liberation war in response to the call of the Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman in between March 26 and December 16, 1971.

এ সংজ্ঞার বদৌলতে "মুক্তিযোদ্ধা"র বাইরে অন্য যেকোনো ব্যক্তিরাও মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচিত হবেন যা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চরম অবমূল্যায়ন করার একটি অমার্জনীয় অপরাধ। এ মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার নামে যেটা করা হয়েছে, আসলে তা মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নয়, এতে মুক্তিকামী জনগণের কথা বলা হয়েছে। এ সংজ্ঞা দিয়ে আসলে যাকে-তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর একটা ফরমুলা বের করা হয়েছে!

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, ফোর্স ও যুদ্ধ জড়িত যেটি ৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার 'ফোর্স' শব্দিটির মধ্যে মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে, কিন্তু ২০১৬ সালের প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার মধ্যে ঐ প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, ফোর্স ও যুদ্ধের কথা নেই। সুতরাং এটা মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নয়, এটা মুক্তিকামী জনগণের সংজ্ঞা বলাই যুক্তিযুক্ত। তাইতো স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কহীন, এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদররাও অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' বনে যাচ্ছে! অতীতে ভুয়াদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একশ্রেণীর চেতনাহীন মুক্তিযোদ্ধা, আর বর্তমানে বানাচ্ছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল তথা জামুকার সদস্যরা। তাদের হাত দিয়েই ৮/১০ বছরের শিশুসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করে আমাদের মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ-করা পাকিসৈনিকও বীর মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে!

পূর্ববর্তী কোনো একটি সরকারের কোনো একটি গেজেটীয় আদেশ পরবর্তীকালীন কোনো একটি সরকার বহাল রেখে, সেটিকে বাইপাস করে একই প্রসঙ্গে নিশ্চয়ই আরেকটি গেজেট জারি করতে পারেন না! এমনটি করা হলে সেখানে সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর সংকীর্ণ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থের করার সুযোগ থাকে বলে প্রতীয়মান হয় যা রাষ্ট্রীয় লুকোচুরির সামিল! তাছাড়া একই বিষয়ের ওপরে দু'টি রাষ্ট্রীয় গেজেট আইনসম্মত নয় বলেও মনে হয়।

আরেকটি বিষয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সেটি হলো, সরকারের ভেতরে অবস্থানকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো একটি অদৃশ্য অপশক্তি বাবা-মেয়ের (বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা) সরকারকে মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নিয়ে জনসমক্ষে বিতর্কিত ও হেয়প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে এমন একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি করেছে বলে আমাদের মনে হয়, যা হয়তো বঙ্গবন্ধু-কন্যা খতিয়ে দেখছেন না বা বুঝতে চেষ্টা করছেন না!

পরিতাপের সাথে বলতে হয়, অন্তরালে এমনই খেলা চলছে যে, বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি বাতিল করা হয় তাঁর কন্যার হাত দিয়ে! অনুরূপভাবে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটিও অবমূল্যায়ন বা বাতিল করতে হয় তার কন্যার মাধ্যমে! এমনকি কয়েক বছর আগে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করার উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু-কন্যার হাত দিয়ে যা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে স্থগিত করা হয়! বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আর কী কী বাদ দেয়া হবে, কে জানে! মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এসব কী হচ্ছে? কারা এসব করাচ্ছে? কেনো সরকারের কেউ বুঝতে পারছেন না? কেনো এতোসব রাষ্ট্রীয় লুকোচুরি সংঘটিত হচ্ছে?

সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নিয়ে যা হচ্ছে তাকে রাষ্ট্রীয় জোচ্চুরিও বলা যেতে পারে। এটা রাষ্ট্রীয় বিভ্রান্তিও বটে। কোনো সভ্য সরকার বা রাষ্ট্র তার জন্মদাতাদের সংজ্ঞা ও মর্যাদাকে অবমূল্যায়ন করার এমন ন্যক্কারজনক আত্মঘাতী অপকর্ম করতে পারে, তা ভাবনার অতীত! জাতীয় মর্যাদা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, চেতনা, সভ্যতা ও ভব্যতার স্বার্থে এ লুকোচুরির অবসান হতেই হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test