E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারীজীর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২০১৪ অক্টোবর ১৮ ০১:৪৫:৪৫
ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারীজীর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সুবল চন্দ্র সাহা : ফরিদপুর শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন। প্রভূ জগদ্বন্ধু সুন্দরের আদি লীলাভুমি। প্রভু সুন্দরের আদরের দুলাল আধ্যাত্মিক জগতের প্রাণপুরুষ ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারী। তাঁর দিব্যজীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে এ পবিত্র প্রতিষ্ঠানে। তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন ১৯০৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর।

দিব্যলীলা সংবরণ করে তিনি ১৯৯৯ সালের ১৮ অক্টোবর নিত্যলীলায় প্রবিষ্ট হন। আজ ড. ব্রক্ষ্মচারীজীর সেই পঞ্চাদশ মহাপ্রয়াণ দিবস। ড. ব্রক্ষ্মচারীজীর পৈত্রিক নিবাস বরিশাল জেলার খালিশাকোটা গ্রামে। বাবা কালিদাস গুপ্ত। মা কামিনাী সুন্দরী দেবী। শৈশবকালে বাবা-মা তাঁকে আদর করে কান্ত বলে ডাকতেন। অন্নপ্রাশনের পর তাঁর নাম রাখা হয় বঙ্কিম চন্দ্র দাসগুপ্ত। মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারী তাঁর গুরু প্রদত্ত নাম।

ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারীজী বি.এ পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩০ সালে দর্শন ও সংস্কৃত শাস্ত্রে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। সংস্কৃত বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদান করেন। ১৯৩৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি. এইচ. ডি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে ভারতের বৃন্দাবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডি. লিট উপাধি পান। ভারত সরকার তাঁকে মহামহোপাধ্যায় ও ভারত শিরোমনি উপাধিতে ভূষিত করেন।

ছোটবেলা থেকেই বঙ্কিম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। খালিশাকোটা হাইস্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্র। এ সময় বরিশালে জাতীয় কংগ্রেসের এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় দেশবরেণ্য নেতা মহাত্মাগান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এ অধিবেশনে যোগদান করেন। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি ও বৃটিশ বিরোধিতার টেড বঙ্কিম চন্দ্রের কচি মনে রেখাপাত করে। তাঁর মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত হয়। আত্মনির্ভরশীল হবার সুতীব্র আকাংখায় খদ্দোরের পোশাক ব্যবহার করতে শুরু করেন। এভাবেই কিশোর বঙ্কিমের মনে যে সেবা ধর্মের বীজ অঙ্কুরিত হয় যা পরবর্তীকালে আধ্যাত্মিকতার জগতে মহীরুহ হিসেবে দেখা দেয়। দেশপ্রেমে উদ্ধুব্ধ ড. ব্রক্ষ্মচারীজী বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল অকুন্ঠ সমর্থন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অসুস্থতার কারনে সাময়িক ভাবে তিনি কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। পাক হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশের সময় প্রথম টার্গেট করে শ্রীঅঙ্গনকে। পাষন্ড পাক সেনারা শ্রীঅঙ্গনের কীর্ত্তনরত ৮ জন সন্ন্যাসীকে ২১ এপ্রিল ’৭১ নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। তাঁদের পূত রক্ত ধারায় শ্রীঅঙ্গনের মন্দির প্রাঙ্গন প্লাবিত হয়ে যায়। দূর্বৃত্ত পাক সেনারা শ্রীঅঙ্গনের বিশাল আয়তনের মঠটিকে ডিনামাইট দ্বারা চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। এ সংবাদ শুনে ড. ব্রক্ষ্মচারীজী গভীর শোকাতিভুত হন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যতদিন বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, ততদিন তিনি অন্ন গ্রহন করবেন না। তিনি অবিরত দেশকে শত্র“ মুক্ত করার জন্য প্রার্থনায় রত থাকতেন। উপবাসক্লিষ্ট ড. ব্রক্ষ্মচারীজী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ফলমুল খেয়ে জীবন রক্ষা করেছিলেন। শরণার্থীদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্যে সহোযোগীতা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি ফরিদপুর ফিরে আসেন। প্রয়াত সন্ন্যাসীদের উদ্দেশ্যে প্রভু সুন্দরের চরণে ভোগরাগ উৎসর্গ করে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্ন গ্রহন করেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর এ অবদান চিরন্তন ও চির অক্ষয় হয়ে রয়েছে। কিন্তু আজও ড. ব্রক্ষচারীজীকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য কোন মূল্যায়ণ করা হয়নি। সৌভাগ্যবশতঃ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন। গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। সঙ্গত কারণেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে আহ্বান জানাচ্ছি ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারীজীকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরুস্কারে ভূষিত করুন। আর এ মহতী উদ্যোগের জন্য দেশ ও জাতি চিরকাল আপনাকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে।

ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারীজী একাধারে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জল নক্ষত্র। সর্বধর্ম সমন্বয়ের মূর্ত প্রতীক। এ অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারীজী সকলকে মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। তাঁর মতে মানুষ জন্মগ্রহন করলেই মানুষ হয় না, মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। মনুষ্যত্বের বেদীমূলে দেশ ও জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই জীব ও জগতের অশেষ কল্যাণ হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারীজী ১৯৩৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগ দেন। ৪০ বছর পূর্বে ১৮৯৩ সালে বীরসন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তিনি যে মঞ্চে দাড়িয়ে বিশ্ববাসীকে সনাতন ধর্মের মর্মবানী শুনিয়েছিলেন, সেই একই স্থানে ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ভারত তথা এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মচারীজী ।

ড. ব্রক্ষ্মচারীজীর কাছে ঈশ্বরপ্রেম ও মানবতাবোধ একই সূত্রে গ্রথিত। মানবকল্যাণই হচ্ছে ধর্মচারণের মূল ভিত্তি। তাই তিনি সারাজীবন মানুষকে মনুষ্যত্ব লাভে অনুপ্রাণিত করেছেন। বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ড. ব্রক্ষ্মচারীজীর মহাবতরী প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের মানবধর্মের বিশ্বজনীন উদারতা প্রচার করেছিলেন। প্রেমের শাশ্বতবানী শুনিয়ে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছিলেন। তিনি মুলত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ৪টি ভাষণ দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্র পত্রিকায় তাঁর ভাষণের মর্মবানী ও তাৎপর্য ফলাও করে প্রকাশ করে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৬৩টি শহর, ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪৭৬ স্মারক বক্তৃতা দেন। দীর্ঘ ৫ বছর ৮ মাস যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও কানাডায় অবস্থান করেন। ১৯৩৯ সালে দেশে ফিরে আসেন। ড. ব্রক্ষ্মচারীজী ধর্মকে নিছক আচার অনুষ্ঠানের বেড়াজালে আবদ্ধ করতে চাননি। ধর্মচর্চা ছিল তাঁর কাছে মানবকল্যাণ সাধনের একটি পথ মাত্র। তাঁর মতে যিনি সৎ, নিষ্ঠাবান, ভদ্র, বিনয়ী এবং অসাম্প্রদায়িক মনের অধিকারী, তিনিই তো পরম ধার্মিক। তিনিই তো প্রকৃত মানুষ। মনুষ্যত্ব অর্জনই হলো ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য। মানুষের ধর্ম মানবধর্ম। সাধনা তার মানবকল্যাণ। আর এই সাধনায় জাতি, ধর্ম, বর্ণে কোন ভেদাভেদ নেই। ড. ব্রক্ষ্মচারীজী শুধু পারলৌকিক ধর্মীয় চিন্তাতেই মগ্ন থাকতেন না। সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত ও আর্তমানবতার সেবা এবং সমাজের কল্যাণই ছিল তার মুল লক্ষ্য। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। কোন ধর্মীয় গোড়ামি বা সংকীর্ণতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন, মনে প্রাণে অসাম্প্রদায়িক। তিনি বলতেন, “একটি বৃক্ষের ফুলে গন্ধ, পাতায় তিক্ততা কিন্তু বৃক্ষ একটিই”। সুতরাং বিশ্বের বিভিন্নতার মধ্যে তিনি বৈচিত্র প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই মনুষ্যত্বের অধিকারী “একজন উত্তম খ্রিষ্টান, উত্তম মুসলমান, উত্তম হিন্দু, উত্তম বৌদ্ধ এবং উত্তম ইহুদির মধ্যে কোন প্রভেদ নাই”। “কেননা যা’ দ্বারা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব গঠিত হয়, তা’ সারা পৃথিবী জুড়ে এক এবং অভিন্ন।

আজকের এ বস্তুতান্ত্রিক পৃথিবীর দৃশ্যমান অনেক উন্নতি হয়েছে বটে; তবে একই সঙ্গে সংঘাত, সন্ত্রাস ও অপরাধপ্রবনতাও বেড়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। পার্থিব সুখ ভোগের জন্য টাকার পাহাড় গড়ে তুলতেই যেন সবাই ব্যতিব্যস্ত। সততা, ন্যায় নীতি, মানবতা যেন আজ তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আসুন ড. ব্রক্ষ্মচারীজীর জীবনবোধের মহাসত্য অনুসরন করে এক কল্যাণকর পৃথিবী গড়ে তুলি। যেখানে থাকবে না মানুষে মানুষে কোন হিংসা-বিদ্বেষ, বিরোধ আর গোষ্ঠিদ্বন্ধ। সেখানে বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের মানুষ মিলিত হবে এক প্রীতির বন্ধনে। যেখানে “সবাই দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে”। পরমারাধ্য গুরুদেবের এ মহাপ্রয়ান দিবসে তাঁকে জানাই অসংখ্য প্রণতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।

পাঠকের মতামত:

১৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test