E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অর্থ পাচারকারীরা দেশের শত্রু : অর্থ উদ্ধার ও কঠিন শাস্তিই তাদের প্রাপ্য

২০২৩ জানুয়ারি ১৩ ১৬:৩৯:৩৬
অর্থ পাচারকারীরা দেশের শত্রু : অর্থ উদ্ধার ও কঠিন শাস্তিই তাদের প্রাপ্য

আবীর আহাদ


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গত বছরের ভারত সফরের ওপর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনটি তাঁর অন্যান্য আর দশটি সম্মেলন থেকে আলাদা ছিলো বলে মনে হয়েছে। সেই সংবাদ সম্মেলনেই তিনি বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন তা মূল্যায়নের দাবি রাখে। কারণ তিনিই একমাত্র সরকার প্রধান যিনি প্রথমবারের মতো বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের সম্পর্কে মুখ খুলেছেন। অপরদিকে চলতি জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী বিদেশে বাংলাদেশীদের সেকেণ্ড হোম, বেগমপাড়া, অর্থ পাচারকারী ও ব্যাঙ্ক লুটেরাদের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তাফা কামাল 'নীরব কেনো" শিরোনামে যে খোলামেলা বক্তব্য দিয়েছেন তাতে স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি এখন সারা দেশের সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশবাসী সঙ্গত:কারণেই এখন অর্থ পাচারকারীদের পাকড়াও করার জোর দাবি জানাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, মাননীয় অর্থমন্ত্রী তথা সরকার কোন প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচারকারী এসব দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আর যদি বিষয়টি কথার কথা হয়ে থাকে, পাচারকারীদের ধরা না হয়, তাহলে এর মাধ্যমে সরকার সম্পর্কে জনসমক্ষে ভুল বার্তা যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমরা বহুকাল ধরে শুনে আসছি যে, বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিবাজ লুটেরাগণ সেসব দেশের অর্থ আত্মসাত করে নিরাপদ ভোগের লক্ষ্যে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাঙ্কে অর্থ গচ্ছিত রাখে। যেমন একদা ইরানের সম্রাট রেজাশাহ পাহলবী, ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সিলাসী, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ট মার্কোস, মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক এভাবে বিশ্বের বহু দুর্নীতিবাজ লুটেরা শাসক সেসব দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার/পাউণ্ড লুটপাট করে সুইস ব্যাংকে জমা রেখেছিলেন এবং পরবর্তীকালে জানা যায় যে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা সেসব অর্থ নাকি আর ফেরত পাননি। অর্থাৎ সুইস ব্যাংক সুযোগ বুঝে সেসব অর্থ বাজেয়াপ্ত করে আত্মসাত করেছে। যেহেতু সেসব ছিলো অনৈতিক পন্থায় লুটকৃত কালো টাকা, তাই তার মালিকরা আইনত: সুইস ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোথাও মামলা করতে পারেননি। অনেক লুটেরা শাসক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর তাদের উত্তরাধিকাররা সে-অর্থ ফেরত পেয়েছে বলেও জানা যায়নি।

বর্তমানেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক দুর্নীতিবাজ লুটেরা প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী ও তাদের আত্মীয়স্বজন, মন্ত্রী এমপি সচিব জেনারেল ব্যবসায়ী শিল্পপতি ও মাফিয়ারা সুইস ব্যাংকসহ আমেরিকা বৃটেন পানামা কানাডা দুবাই সিঙ্গাপুর মালায়েশিয়া ও অন্যান্য দেশে অঢেল অর্থ গচ্ছিত রাখছেন। তারা কেউ কেউ সে-অর্থ ভোগ করতে পারছেন এবং আবার অনেকেই নাকি পারছেন না! ঐসব বিদেশের ব্যাঙ্ক জানে যে, যারাই এখানে অর্থ গচ্ছিত রেখেছেন, তারা তা তাদের দেশ থেকে লুটপাট করে এনেছেন। সেসব দেশে এসব অর্থ আইনের চোখে কালো টাকা। এসব কালো টাকা মেরে দিলে লুটেরাচক্র তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে বা আইনের আশ্রয় নিতে পারবে না। ফলে অর্থগুলো ঐসব দেশের ব্যাংকগুলো মেরে দিয়ে থাকে।

একটা উদাহরণ দেই। আমাদের দেশের তথাকথিত প্রিন্স মুসা বিন শামসিরের পঁচানব্বই হাজার কোটি টাকা নাকি সুইস ব্যাংক বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছে বলে তিনি প্রকাশ্যে একাধিকবার স্বীকার করেছেন। এভাবে অনেকের অর্থই সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাঙ্ক আত্মসাত করেছে বলে অনুমিত হয়। মুসা বিন শামসিরই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ছোট বড়ো ও মেগা প্রকল্প ও কেনাকাটায় প্রকৃত ব্যয়ের চাইতে শত শত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাজার গুণ বাড়তি মূল্য দেখিয়ে তা আত্মসাত করা হলেও এর সাথে জড়িত আমলা, ব্যবসায়ী ও এমপি-মন্ত্রীদের কোনোই জবাব দিতে হয় না! এছাড়া একটা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নামধারী দুর্বৃত্ত ব্যাঙ্কের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে শতশত হাজার হাজার কোটি আত্মসাত করে থাকে। আবার বিভিন্ন আমদানি-রফতানিকারক ব্যবসায়ীরা ওভার ও আণ্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমেও শতশত কোটি টাকা আত্মসাত করে থাকে। এসব ব্যবসায়ী দুর্বৃত্তরা শেয়ারবাজার পরিচালনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশেও শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে। ওপর মহলে কমিশন প্রদান করে তারা ক্ষমতাশালীদের আনুকূল্য, পৃষ্ঠপোষকতা ও নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন। এসব উচ্চপদস্থ আমলা, ব্যবসায়ী ও লুটেরা রাজনীতিকরা আত্মসাতকৃত অর্থ দিয়ে দেশে-বিদেশে অতি রাজকীয় জীবন যাপন করে থাকেন। তাদের অনেকেই আমেরিকা কানাডা ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া দুবাই সিঙ্গাপুর মালয়েশীয়া প্রভৃতি দেশে "সেকেণ্ডহোম" "বেগমপাড়া" নামীয় প্রাসাদোপম বাড়িতে বৌ-ছেলে-মেয়ে রেখে দেন, নিজেরাও মাঝেমধ্যে সেখানে অবস্থান করেন। তারপরেও নিজেরা এদেশে থেকে আরো লুটপাটে জড়িত থেকে লুটকৃত অর্থ সেসবখানে পাচার করে থাকেন।

ব্যক্তিখাতের বহুমুখী একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এদেশের বিদ্যুত্, জ্বালানি, আইটি, শিপিং, সিমেন্টসহ বড়ো বড়ো বাণিজ্য ও শিল্পের সাথে জড়িত থেকে বিশাল লুটপাটীয় আর্থিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। তাদের হেডকোয়ার্টার সিঙ্গাপুরে। মূলত: বাণিজ্যের অজুহাতে বাংলাদেশ থেকে লুটপাট করে নিরাপদে থাকার জন্যেই এ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অধিকাংশই সিঙ্গাপুরে অবস্থান করেন। শোনা যায়, সিঙ্গাপুরে তারা বিশিষ্ট ধনিকের খাতায় নাম তুলেছেন! এ জাতীয় আরো কতিপয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এদেশ থেকে লুটপাট করে বিদেশে বিশাল ধনিক হিশেবে পরিগণিত হচ্ছেন। বিদেশে অর্থ পাচারকারী এধরনের হাতেগণা ৬০/৭০টা বিশাল লুটেরা পরিবারের সাথে জড়িত আমলা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, রাজনীতিক, এমপি, মন্ত্রীদের একটা তালিকা কিছুদিন আগে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসেছিলো বলে জানা যায়। এটা নিয়ে কিছু হইচই পড়ে গেলেও সরকার বা দুদক কোনোই রা করেনি। এতেই বুঝা যায়, ডালমে কুচ কালা হ্যায়! তবে এটাও জানা গেছে যে, এসব বিশাল অর্থ পাচারকারী দুর্বৃত্তরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষের মানুষ! আর কী আশ্চর্য, তাদের অনেকেই জামুকার আনুকূল্যে 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' খাতায় নামও লিপিবদ্ধ করেছেন! এতেই বুঝা যায়, কারা ছলেবলেকলেকৌশলে এদেশটাকে দুর্নীতি ও লুটপাটের অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলেছেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ভুলুন্ঠিত করে চলেছেন। এসবই নিশ্চয়ই আমাদের সৎ ও সাহসী প্রধানমন্ত্রীর নখদর্পণে রয়েছে বলেই তিনি তাদের সম্পর্কে মুখ খুলেছেন, এটা বড়োই আশার কথা।

সুতরাং আমাদের দেশ থেকে যেসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াচক্র লুটপাট করে বিদেশী ব্যাঙ্কে অর্থ গচ্ছিত রেখেও সেসব ব্যাঙ্কের হাতে মার খেয়েছে ও খাচ্ছে, তা জেনেশুনে কেনো যে তারা লুটকৃত অর্থ সেসব ব্যাঙ্কেই রাখে তা আমাদের বোধগম্য নয়। এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে দশ/বারো লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে! তারা দেশে ও বিদেশে রাজকীয় সুখের জীবন নির্বাহ করছে। অথচ দেশের সিংহভাগ সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছে। বিশাল শিক্ষিত যুবসমাজ বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজের সৃষ্ট দেশে পরবাসীর মতো বসবাস করছেন!

আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরাচক্র অর্থ লুটপাট ও তা পাচারের মধ্যে একধরনের মাদকীয় নেশা উপভোগ করে থাকে অর্থাৎ তারা মানসিক বিকারগ্রস্ত। এরা বাংলাদেশের শত্রু, দেশদ্রোহী। এবার আমাদের বিচক্ষণ ও সাহসী প্রধানমন্ত্রীর হাতে তাদের যথাযথ মানসিক চিকিৎসাসহ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে বলে দেশবাসী উন্মুখ হয়ে রয়েছে। অপরদিকে পাচারকৃত বিপুল অর্থ উদ্ধার করে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও চলমান আর্থিক সংকট মোকাবিলায় কাজে লাগিয়ে তিনি দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুতসহ জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করবেন।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test