E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বিভ্রান্তির ধুম্রজাল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ চলতে পারে না 

২০২৩ ফেব্রুয়ারি ১০ ১৫:৩২:১০
বিভ্রান্তির ধুম্রজাল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ চলতে পারে না 

আবীর আহাদ


আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে  "আমরা বাংলাদেশের জনগণ উনিশশো একাত্তর খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসের ছাব্বিশ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া 'জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে' স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি"- সেখানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কথা নেই! মুক্তিসংগ্রাম একটি নিরন্তর চলমান প্রক্রিয়া, কিন্তু একটি সশস্ত্র  মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীনতাপ্রাপ্ত হয়েছে, এটাই বাস্তবতা ও ঐতিহাসিক সত্য। ফলে বিভ্রান্তির ধুম্রজাল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীন বাংলাদেশ চলতে পারে না।

আমরা বলতে চাই যে, এই অনুচ্ছেদের 'জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামে'র পরে যদি 'জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের পথ বেয়ে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে' কথাটি লেখা হতো তাহলে 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটি মহিমান্বিত ও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হতো। আমরা বলবো না যে, সংবিধান রচয়িতারা ইচ্ছেকৃতভাবে 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটি এড়িয়ে গেছেন। মানুষ মাত্রই ভুল করে। হয়তো তাৎক্ষণিক চিন্তায় তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে গলিয়ে ফেলেছিলেন- যদিও মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পৃথক দু'টি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। ইংরেজি ভাষায়ও এ শব্দ দু'টিও পৃথকভাবে বর্ণিত আছে, যেমন Liberation Struggle = মুক্তিসংগ্রাম, Liberation War = মুক্তিযুদ্ধ। তখনকার সংবিধান রচয়িতা ও বর্তমানে সংবিধান রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গেরও নিশ্চয়ই এসব অজানা নয়।

অপরদিকে সংবিধানের প্রস্তাবনার ২য় অনুচ্ছেদে "জনগণ" ও "শহীদ"দের অবদানের কথা বলা হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়নি! এখানে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে, জনগণের একটা বিরাট অংশ মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধিতা করেছিলো। অথচ এখানে "জনগণ" বলে সেই মুক্তিযুবিরোধী অংশকেও জনগণের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে! মূলত: মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনদানকারী জনগণকে "মুক্তিকামী জনগণ" বলাই ছিলো ঐতিহাসিকভাবে যুক্তিযুক্ত।

এসব প্রসঙ্গে বেশ কিছুকাল পূর্বে বাংলাদেশের সাবেক মাননীয় প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সাথে তাঁর আইন কমিশন অফিসে আমার একটা সৌজন্য বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট লেখক কবি ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলী খানের মাধ্যমে তিনি আমার রচিত "বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে" গ্রন্থ নিয়ে আসাসহ আমাকে চায়ের নিমন্ত্রণ দেন। সেই সৌজন্য বৈঠকে আমি 'সংবিধানের প্রস্তাবনায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দদ্বয় নেই বলাতে তিনি 'না-না, তা হবে কেনো' বলে ওঠেন। আমি জোর দিয়ে আবার বলাতে তিনি নিজে উঠে গিয়ে বুকসেল্ফ থেকে সংবিধানটি এনে আমার দেখিয়ে দেয়া সংবিধানের Preamble-প্রস্তাবনা পড়েই বলে ওঠেন : Strange-আশ্চর্য! পরক্ষণে তিনি বলেন, সরকার সংবিধানে এ-শব্দদ্বয় সংযোজন করতে পারেন। এবং এটা করা উচিত।

এ-অবস্থায় সংবিধানের প্রস্তাবনা মোতাবেক প্রতিভাত হয় যে, এ-দেশে কোনো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়নি বা মুক্তিযোদ্ধা বলতে কোনোকিছু নেই! দেশটি বোধহয় আকাশ থেকে হাওয়ায় ভেসে এসেছে! সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি না থাকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ঘটছে। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, গণ্ডগোলের বছর, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ইত্যাদি ধরনের শব্দে মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করার দু:সাহস দেখায়। আর এ-কারণেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানান বিকৃতিসহ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে। অথচ মুখে মুখে সবাই গাল ফুলিয়ে 'মুক্তিযুদ্ধ' ও 'মুক্তিযোদ্ধা' শব্দদ্বয় উচ্চারণ করে আসছেন যদিও এ-শব্দদ্বয়ের কোনোই সাংবিধানিক ভিত্তি দেয়া হয়নি! এই ঐতিহাসিক ভুল তথা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন ও অবমাননা করে কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি চলতেই থাকবে?

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংজ্ঞা যা উনিশশো বাহাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু সরকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন- "তিনিই মুক্তিযোদ্ধা যিনি যেকোনো একটি সশস্ত্র বাহিনীর সাথে জড়িত থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন"। সেই যথাযথ সংজ্ঞাটি এড়িয়ে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রতারণার আশ্রয়ে 'মুক্তিযুদ্ধে'র সাথে সম্পর্কহীন অ-মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকারদেরও 'মুক্তিযোদ্ধা' বানিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জাতির সামনে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে! কোনো অবস্থায়ই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দেড়লাখের বেশি হবে না। অথচ বর্তমানে সরকারি তালিকায় এ-সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু'লাখ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো, যার আশি/ পঁচাশি হাজারই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা! কিন্তু আমাদের জানা মতে বেশকিছু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এখনো মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে স্বীকৃতি পায়নি! অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবই এখন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার মানদণ্ড হিশেবে পরিগণিত হচ্ছে!

এ জন্যই আমরা বিভিন্ন সময় এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশকৃত স্মারকলিপিতে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানসহ বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত সংজ্ঞার আলোকে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা যাচাইয়ের কথা বলেছি। এ প্রক্রিয়ায় যেমন সব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা উঠে আসতো, তেমনি মুক্তিযোদ্ধা তালিকার হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদ হয়ে যেতো। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না! তথাকথিত নিরন্তর যাচাই বাছাই সমাপ্তান্তে বীর মুক্তিযোদ্ধা চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে!

পরিশেষে দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে প্রশ্ন রাখতে চাই, এ-জাতীয় ঐতিহাসিক ভুল ও আত্মঘাতকতা নিয়ে কি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ চলতেই থাকবে? প্রতিকারের কি কোনো ব্যবস্থা নেই?

এ-জন্য আমরা সরকারের কাছে পুনরায় দাবি তুলছি যে, সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দদ্বয় সন্নিবেশিতকরণসহ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সুরক্ষা আইন করুন। জাতীয় ইতিহাসের স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখুন। বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে একটি উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিশন গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করুন।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা এসব বিষয়কে সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধে রাখুন। এটা আমাদের ঐতিহাসিক মর্যাদা ও গর্বের অধ্যায়। যেসব অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার এতোকাল অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা সেজে প্রজাতন্ত্রের অর্থ ও অন্যান্য সুবিধাদি হাতিয়ে নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার করুন। আর এখনো যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও নানান কারণে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা হতে বঞ্চিত রয়েছে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে স্বীকৃতি দিন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন। আশা করি সরকার জাতীয় স্বার্থে জরুরিভিত্তিতে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test