E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রসঙ্গ : মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচন 

২০২৩ ফেব্রুয়ারি ২০ ১৪:৩৯:৩৭
প্রসঙ্গ : মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচন 

আবীর আহাদ


গত ২/৪ বছর ধরে মুবিম মন্ত্রী বাহাদুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনের কথা বলে বলেও শেষ পর্যন্ত সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেননি!। তিনি আজ ৮/৯ বছর ধরে তার জামুকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বানাতেই ব্যস্তসমস্ত দিন পার করে আসছেন। ফলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন হলো কি হলো না, এবিষষে তার তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা তিনি প্রায় শেষ করে এনেছেন। ইতোমধ্যে নির্রচনপন্থী মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের উপর্যুপরি দাবির প্রেক্ষিতে মুবিমন্ত্রী গত জানুয়ারি মাসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা ইংগিত দিয়েছিলেন। যদিও মুক্তিযোদ্ধারা ফালতুকথা, মিথ্যাচার ও অতিকথনপ্রিয় মন্ত্রী বাহাদুরের কোনো কথার ওপর আস্থা রাখেননি। তারপরও কেনো জানি এবার ফেব্রুয়ারিতে এসে সবাই একটু নড়েচড়ে বসেছে। পর্দার অন্তরালে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেউ কেউ প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা শুরু করে দিয়েছেন! আবার কেউ ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে ফিরে এসে তার অনুসারীদের নির্বাচনের পক্ষে জনমত সৃষ্টির ইংগীত দিয়ে নির্বাচনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর একজন জামুকার প্রভাবশালী সদস্য পরিবহন সেক্টরের রাঘব বোয়াল তাঁর সরকারি প্রটোকল খাটিয়ে ইতোমধ্যে প্রায় সারা দেশ সফর করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা জানান দিয়ে বেড়াচ্ছেন! বেশকিছু উৎসাহী পর্যবক্ষেকও ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনে বিশেষ করে কারা চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে পারেন, তা নিয়েও আগাম বায়বীয় আভাস-ইংগিত দিয়ে নানান জরিপকর্মও পরিচালনা করেছেন, যদিও চেয়ারম্যান প্রার্থীরা কেউ তাদের প্রার্থিতা সম্পর্কে এখনো মুখ খুলেননি।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্বশীল একটি বৃহত্তম সংগঠন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পাকা অফিসসহ বিভিন্ন হাট-বাজার ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনার সাথে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটা অর্থনৈতিক সংযোগ আছে। সরকার বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ভাতা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিভিন্ন খাতে যৎকিঞ্চিত আর্থিক সহযোগিতাও করে থাকে, যেমন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের লেখাপড়া, কন্যা সন্তানদের বিয়েশাদি, মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন কাফন প্রভৃতি। ফলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে কেন্দ্র করে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মনেও একটা আগ্রহ রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন নিয়ে সংগতকারণে সংশ্লিষ্টরা বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন। মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গনে জোর গুজব, আগামী এপ্রিল মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে! ওয়াকিবহাল মহল অবশ্য মুবিমন্ত্রীর কোনো কথায় বিশ্বাস রাখেন না, সেখানে চলছে গুজব! নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না-হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই বলা যাচ্ছে না।

কিন্তু সবচে' বড়ো প্রশ্ন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন যে হবে, কিন্তু ভোটার কারা? আমরা জানি, যেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দেড় লক্ষের নিচে, সেখানে সরকারি গেজেটে নাম আছে দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো। চূড়ান্ত তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কতো হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। ইতোমধ্যে তিন পর্বে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা চূড়ান্ত তালিকার গতিপ্রকৃতি দেখে বুঝা যাচ্ছে যে, বিশালসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা চূড়ান্ত তালিকায় থেকেই গেছে। অপরদিকে শহীদ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভোটার তালিকায় নাম না থাকার ফলে জীবিত মুক্তিযোদ্ধা তথা ভোটার সংখ্যা কতোতে দাঁড়াবে তাও আগাম বলা যাচ্ছে না। তবে শোনাকথা, ভোটার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নাকি ১লাখ ১০ হাজার।

আমাদের ধারণা, বিদ্যমান মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কমবেশি ৬০/৭০ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে যারা তুলনামূলক একটু কমবয়সী এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল। তারা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার একটি বিরাট সংখ্যক শহীদ ও মৃত। সে-নিরিখে ভোটারদের মধ্যে হয়তো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেশিই হবে। অমুক্তিযোদ্ধারা স্বভাবত: প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে থাকার ফলে অমুক্তিযোদ্ধা ভোটাররা তাই ঐক্যবদ্ধ। ফলে অমুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের অস্তিত্ব রজায় রাখার লক্ষ্যে তারা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। তারা মনে করে, নির্বাচন হলে তাদের ভুয়াত্বের অপবাদ কেটে যাবে। বিশেষ করে উপজেলা/জেলা পর্যায়ের নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবে তারা আর্থিকভাবে থাকবে স্বচ্ছল। অপরদিকে অমুক্তিযোদ্ধা যারা প্রাথী হবে, তাদের পক্ষে অমুক্তিযোদ্ধারাই ভোট দেবে। এর প্রভাবে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যে প্যানেল ভুয়াদের ব্যাপারে নমনীয় থাকবে বা ভুয়ার কারিগরদের প্রাধান্য থাকবে, সেই প্যানেলকে জিতিয়ে আনার লক্ষ্যে অমুক্তিযোদ্ধারা আদাজল খেয়ে নামবে। ফলে নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে যাবে বলে প্রবল শঙ্কা রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাসহ এদের কারিগররাও পার পেয়ে যাবে।

তবে যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অতীত নেতাদের দুর্নীতি, ভুয়ামি ও লুটপাটের কথা, তাদের নিজেদের বঞ্চনা ও আত্মমর্যাদার কথা স্মরণসহ অমুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের ক্ষোভকে যথাযথভাবে চেতনায় শানিত করে সত্যিকার অর্থে কোনো মুক্তিযোদ্ধাবান্ধব আদর্শবান সৎ ও সাহসী নেতৃত্ব তথা নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে পারেন, তাহলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ অমুক্তিযোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হলেও, যেহেতু বেশ ক'টা কেন্দ্রীয় প্যানেল থাকবে, এ অবস্থায় অমুক্তিযোদ্ধা ভোটাররাও বিভিন্ন প্যানেলে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। এ প্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে একটা চেতনার উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। পাকিস্তানের প্রবল প্রতাপশালী সামরিক শক্তি, বেসামরিক আমলাতন্ত্র, আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দল, ধনবান ২২ পরিবারসহ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও অন্যান্য সমাজশক্তির বিরুদ্ধে বাঙালিরা যেমন করে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের পক্ষে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছিলো, তেমনি যদি প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সর্বপ্রকার ভয় শঙ্কা ও লোভকে পদদলিত করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের মনোনীত নেতৃত্বের পক্ষে নেমে পড়েন, তাহলে তাদের বিজয়কে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

তবে মোদ্দা কথা হলো, মুক্তিযোদ্ধা ভোটার তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা ভোটার থাকলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন একটা তামাশায় পর্যবসিত হবে। এখানে নৈতিকতা, আদর্শ ও চেতনার প্রশ্ন জড়িত। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধাদের বহাল রেখে কোনো নির্বাচন যেমন সুষ্ঠু হতে পারবে না, তেমনি তাদের নিয়ে নির্বাচন করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে অমুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেয়া হবে; বৈধতা দেয়া হবে, অমুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির কারিগররাও স্বস্তি ফিরে পাবে, যা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি চরম অবমাননা। তবে সেটাই শেষ কথা নয়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে। সেটা হলো: Nothing will go unchalleged = কোনোকিছুকেই বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়া হবে না' বলে যদি প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা একট্টা হয়ে একটা সৎ সাহসী প্রাজ্ঞ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বান্ধব নেতার নেতৃত্বেধীন প্যানেলকে বেছে নেন, তাহলে বিজয়ের সূর্য উদিত হতেও পারে।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test