E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য মানুষের আত্মার কুপ্রবৃত্তি দহন করে পরিশুদ্ধ করা

২০২৩ মার্চ ২৪ ১৬:৪২:২৩
রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য মানুষের আত্মার কুপ্রবৃত্তি দহন করে পরিশুদ্ধ করা

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য মানব জাতির আত্মশুদ্ধি। ইসলামে সাম্য-মৈত্রীর যে নান্দনিক দর্শন রয়েছে, সিয়াম সাধনার মাধ্যমেই মূলত এর বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। রমজান যেমন বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর রহমত বা দয়াকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনি এক বান্দার প্রতি অপর বান্দার, এক মানুষের প্রতি অপর মানুষের অন্তরে মমত্ব, সহানুভূতি, দয়া, ভালোবাসার উপলক্ষ সৃষ্টি করে।

রোজার সহমর্মিতার ক্ষেত্র শুধু আর্থিক সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি অপর মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সর্বোত্তম বিনম্র আচরণ, সদুপদেশ প্রদান, তার জন্য প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করায় সবই সহমর্মিতার মধ্যে গণ্য। এ বিষয়টির অপরিহার্যতা ফুটে উঠেছে নু’মান ইবনে বাশির (রা.) বর্ণিত সুন্দর একটি হাদিসে। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনদের একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি, দয়া ও মায়া-মমতার উদাহরণ একটি দেহের মতো।
যখন দেহের কোনো অঙ্গ ব্যথা পায়, তখন তার জন্য পুরো শরীরই অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়। ' (সহিহ বোখারি : ৬০১১)
বর্হিজগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানার্জনের বাহন তার ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিবৃত্তি। কিন্তু মানবজীবনের এমন অনেক দিক আছে, যেগুলো এ দুটির অগোচরে এবং যেগুলোর উদ্ঘাটনে এ দুটি অক্ষম-কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সম্ভবত এ কারণেই জ্ঞানবিজ্ঞানের চরম উত্কর্ষের এই যুগেও বিজ্ঞান বা দর্শন ভেদ করতে পারেনি জীবনরহস্যের অনেক দিক।

এজন্য এ দুটি ছাড়াও মানুষকে বাধ্য হয়ে স্বীকার করতে হয় অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি স্বজ্ঞাকে (intuition)। বুদ্ধির চেয়ে উচ্চতর শক্তি স্বজ্ঞা মানুষের উচ্চতর আধ্যাত্মিক চেতনার এক সচেতন অভিব্যক্তি।

আদর্শ মানুষ গঠনে ইসলামে রোজার ভূমিকা অনন্য, অসাধারণ। রোজার আরবি পরিভাষা সাওম বা সিয়ামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নিবৃত্ত থাকা—আল-ইমসাক। এই অর্থে বিশেষ নিবৃত্তি যাপন বা নিবৃত্তি সাধনার নাম সিয়াম। প্রচলিত ধারায় পানাহার ও জৈবিকতা থেকে নিবৃত্ত থাকাই রোজা এবং তা-ও কেবল শেষ রাত থেকে সূর্যাস্ত অবধি মাত্র ১২-১৪ ঘণ্টার মেয়াদে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এই নিবৃত্তি সব ধরনের অনুচিত ও নিষিদ্ধ কর্ম থেকে নিবৃত্তি এবং সব ধরনের উচিত ও আদিষ্ট কর্মে আত্মনিয়োগ। আসলে বিহিত পানাহার ও কামাচারে নির্দিষ্ট মেয়াদের নিবৃত্তি এমন একটি প্রশিক্ষণ, যা সব ধরনের অবিহিত ও অন্যায় কর্মের মেয়াদহীন নিবৃত্তিতে রোজাদারকে অভ্যস্ত করে তোলে।

সিয়ামের প্রকৃতি এরূপ না হলে প্রচলিত উপবাস বা প্রচলিত নিবৃত্তি যাপনের কোনোই গুরুত্ব নেই ইসলামে। ইসলামের নবি মোহাম্মদ (স) বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন এভাবে : অনেক রোজাদার এমন রয়েছে, যাদের রোজা দ্বারা পিপাসায় কাতর হওয়া ছড়া আর কোনো সার্থকতা নেই। অনেক রাতের নামাজি এমন রয়েছে, যাদের নামাজ দ্বারা রাত্রিজাগরণ ছাড়া আর কোনো সার্থকতা নেই। ইমাম গাজ্জালি (রহ) এ ধরনের রোজাদারকে নিম্নমানের রোজাদার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

তিনি উন্নতমানের দুই শ্রেণির রোজার উল্লেখ করেছেন যথা—সাওমুল খুসুস ও সাওমু খুমুসিল খুসুস—বিশিষ্টজনের রোজা ও অধিকতর বিশিষ্টজনের রোজা। তার মতে, বিশিষ্টজনের রোজা হলো শ্রবণশক্তির, দৃষ্টিশক্তির, বাকশক্তির এবং হাত-পাসহ সমগ্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পাপাচার থেকে উপবাস বা নিবৃত্তি যাপন। আর অধিকতর বিশিষ্টজনের রোজা হচ্ছে অন্তরের পাশবিক বৃত্তি ও পার্থিব চিন্তাভাবনা থেকে উপবাস যাপন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছু থেকে সর্বাত্মক নিবৃত্তি অবলম্বন। ইমাম আল গাজ্জালি (রহ)-এর এই অভিব্যক্তি আসলে একটি বিখ্যাত হাদিসের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। হাদিসটি এরূপ : যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ও অন্যায় অস্বীকৃত কর্ম থেকে নিবৃত্ত থাকে না, তার ক্ষেত্রে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই, যা সে পানাহার বর্জনের রোজা পালন করুক।

রমজান শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দহন। কিন্তু কীসের দহন? মানুষের জৈবিকতার ও পাশবিকতার দহন। মানুষের সব ধরনের কুপ্রবৃত্তির দহন। দহন প্রক্রিয়ায় স্বর্ণ খাদমুক্ত হয়, খাঁটিত্বের প্রমাণ দেয়। অনুরূপ সিয়ামের দহনে মানুষ খাঁটি ও আদর্শ মানুষে পরিণত হয়। মানুষের মধ্যে রয়েছে সু ও কুপ্রবৃত্তি। সে একদিকে অভিজাত ফেরেশতা-গুণাবলির অধিকারী, অন্যদিকে সে পাশবিকতার কঠিন নিগড়ে বন্দি। তার ফেরেশতা গুণগুলো তাকে সমাজজীবনে সংহতি, ঐক্য, প্রেম, মৈত্রী ও ভালোবাসা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। কিন্তু তার পাশবিক গুণগুলো তাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, ইতর ও অসহায় করে তোলে।

কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি নামের বহু রিপু এবং এগুলোর পাশাপাশি বহু কুপ্রবৃত্তি রয়েছে মানবজীবনে। এগুলো জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে, অনুচিত ও অকল্যাণের পথে নিয়ে যায়। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও সংশোধন প্রয়োজন, কিন্তু এগুলোর সম্পূর্ণ উচ্ছেদ বা মূলোত্পাটন সঠিক নয়। কারণ কামবৃত্তির সুষম ব্যবহারের ফলেই মানুষসহ সব প্রাণীর বংশবিস্তার সম্ভব হচ্ছে। কামবৃত্তির মূলোত্পাটন করা হলে বংশানুক্রমিক জীবকুলের টিকে থাকা অসম্ভব হবে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, উেকাচসহ সিংহভাগ দুর্নীতি সংঘটিত হয় লোভের কারণে। কিন্তু জীবন থেকে যদি এই লোভকে সম্পূর্ণ উৎখাত করা হয়, তাহলে মানুষ উন্নত থেকে উন্নততর সোপানে আরোহণ করতে সচেষ্ট হবে। এভাবে কোনো রিপুরই কার্যকারিতা ধ্বংস করা কাম্য নয়। কাম্য হচ্ছে এগুলোর সুনিয়ন্ত্রণ ও সুপ্রয়োগ। রমজানের সিয়াম এগুলোকে এমনভাবে দহন করে, যাতে মানুষ এগুলোর সর্বোচ্চ সুফল অধিকার করতে পারে এবং এগুলোর যথাবিহিত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

সিয়ামের এই সার্থকতা আল কোরআনে কেবল একটি শব্দযুগলে প্রকাশ করা হয়েছে। আর তা হলো ‘যাতে তোমরা তাকওয়াবান হয়ে উঠতে পারো’। তাকওয়া অর্থ সতর্ক হওয়া, প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানে গ্রহণ করা। এক ব্যক্তি বিশিষ্ট্য সাহাবি আবু হুরায়রা (রা)কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাকওয়া কী? তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি কণ্টকাকীর্ণ পথে চলেছেন? তিনি উত্তর করেন, হাঁ। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করেন, কণ্টকাকীর্ণ পথ আপনি কীভাবে অতিক্রম করেছেন? তিনি উত্তর করেন, আমি যখনই কাঁটা দেখেছি, তখনই কাঁটা থেকে সরে এসে বা কাঁটার ওপর দিয়ে বা কোনো এক পাশ দিয়ে সাবধানে পা নিক্ষেপ করে পথ চলেছি, [যাতে কোনো কাঁটা পায়ে না বিঁধে]। আবু হুরায়রা (রা) বললেন, এরই নাম তাকওয়া।

মানুষের দেহ ও মনের যাবতীয় কামনা-বাসনার মধ্যে ক্ষুণ্নিবৃত্তি, কামবৃত্তি ও অবাধ শান্তিলাভ মুখ্য। এই তিনটির কাছে মানুষ পরাভূত হলে ক্ষুণ্নিবৃত্তি তাকে পেটের দাস বানিয়ে ফেলে, কামবৃত্তি তাকে পশুর স্তরে নামিয়ে দেয় এবং অবাধ প্রশান্তি প্রত্যাশা তাকে যথেচ্ছ অন্যায় করতে উদ্বুদ্ধ-অভ্যস্ত করে। সিয়াম এই তিনটির লাগাম টেনে ধরে। সিয়ামে বৈধ পানাহার ও বৈধ কামাচার নিষিদ্ধ হওয়ায় যে কোনো অবৈধ পানাহার ও অবৈধ কামাচার থেকে নিবৃত্ত থাকার প্রশিক্ষণ কেবল সিয়াম সাধনা থেকেই লাভ করা যায়। আরো প্রশিক্ষণ লাভ করা যায় সারা দিনের উপবাসের পরও তারাবিহ ও সেহরিসহ বেশি বেশি পরিশ্রমসমেত প্রশান্তি লাভের।

অন্যায়ের গতিরোধ ও প্রতিশোধ আল-কোরআনের এক সর্বজনীন বিধান। কিন্তু রোজাদারকে এক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ মেনে চলতে হয় আর তা হচ্ছে তার সঙ্গে কেউ ঝগড়া করলে বা তাকে গালমন্দ করলে তিনি তার প্রতিবাদ না করে তার সহ্যক্ষমতাকে সমৃদ্ধ করবেন। আল্লাহর রসুল (স) বলেছেন, রোজা ঢালস্বরূপ, সুতরাং কেউ যেন অশ্লীতা ও মূর্খতা অবলম্বন না করে। অন্য কেউ তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে বা তাকে গালমন্দ করলে সে যেন বলে, আমি রোজাদার। আমি রোজাদার। আসলে জিহ্বাকে সংযত রাখা যত সহজ মনে করা হয়, অত সহজ নয় বরং অনেক কঠিন, অনেক কষ্টসাধ্য।

বেশি বেশি কথা বলা এবং বেশি বেশি চুপ থকা—এ দুটি অবস্থার প্রতিটির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক উভয়ই আছে, কিন্তু এটি বহুল পরীক্ষিত ও বহুল প্রমাণিত যে, বেশি কথা বলার চেয়ে বেশি চুপ থাকার সুফল অধিক। চুপ থাকা কখনো কখনো জ্ঞানগবেষণা ও বিচারবিবেচনার পথ উন্মোচন করে। মুখের সংযম যাপনে চুপ থাকার ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। এখন আদর্শ মানুষ অবশ্যই সদালাপি এবং তিনি শোনেন বেশি, বলেন কম। আল-কোরআন সূত্রে জানা যায়, ঈসা (আ)-এর মা মরিয়ম (আ) এই চুপ থাকার রোজা রাখার মানত করেছিলেন এবং সেই মানত তিনি পূরণও করেছিলেন।

রমজান মুমিনের নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণের মাস। নামাজ কয়েক মিনিটে সম্পন্ন হয়, জাকাত বছরে একবার দিতে হয় এবং হজ পাঁচ দিনে আদায় করা যায়—ব্যতিক্রম কেবল সিয়াম। একাধারে ২৯ বা ৩০ দিন ধরে আদায় করতে হয়—পরিপূর্ণ এক মাস। এত দীর্ঘকালীন ইবাদত ইসলামে আরেকটি নেই—এ এক দীর্ঘকালীন কঠোর পরিশ্রমের প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণের পথনির্দেশ হচ্ছে আল-কোরআন। এজন্য রমজানের পরিচয় দেওয়া হয়েছে কোরআন নাজিলের মাস হিসেবে। আল কোরআনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে স্বয়ং কোরআনে মানুষের পথনির্দেশ, সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন পথনির্দেশ ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। এই আল-কোরআন মানুষকে আদর্শ মানুষে রূপান্তরিত করে। এটি শুধু কেরআনের দাবি নয় বা শুধু কোরআন অনুসারী মুসলিমগণের দাবি নয়; এ দাবি কোরআনবিমুখ অনেক অমুসলিমেরও।

এভাবে পুরো একটি মাস মানবচিত্তকে কোরআন শিক্ষার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে আদর্শ মানুষে পরিণত করার কঠোর সাধনার নাম সিয়াম। স্বপ্নাবিষ্ট পার্থিব জগতে প্রাত্যহিক জীবনে যেসব ময়লা-আবর্জনা আমাদের মানসে পুঞ্জীভূত হয় এবং আমাদের জীবনকে কলুষিত করে, সেসব ময়লা-আবর্জনা উচ্ছেদের অন্যতম প্রধান অভিযান রমজানের সিয়াম বিধান।

লেখক : সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test