E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে অন্তরায় নব্য রক্ষণশীলরাই

২০২৩ এপ্রিল ১১ ১৫:৪২:৩৫
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে অন্তরায় নব্য রক্ষণশীলরাই

গোপাল নাথ বাবুল


ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ফাঁস হয়েছে। রাশিয়ার এমন একটি দাবি বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ফাঁস হওয়া এসব নথির একটিতে ইউক্রেনের ১২টি ব্রিগেডের ৯টিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সেনারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে জানা যায়। এসব গোপন নথিগুলো টুইটার ও টেলিগ্রামে ছড়িয়ে পড়ায় মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

সম্প্রতি সংবাদমাধ্যাম নিউজউইক-এ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সামরিক কমিটির চেয়ারম্যান বব বাউয়ার রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নিজেদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। রাশিয়া ন্যাটোভুক্ত কোনও একটি দেশে হামলা চালিয়ে রেড লাইন অতিক্রম করলে ন্যাটো তার প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে পুতিন এক বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে বাড়িয়ে তোলার অভিযোগ করে বলেছেন, বৈশ্বিক সংঘাতের মঞ্চে মস্কোকে পরাজিত করতে পারবে, এমন একটি ভুল ধারণা নিয়ে তারা এটি করছে। পশ্চিমাদের বৈশ্বিক সংঘাতের বিষয়ে সতর্ক করে পুতিন আরও বলেন, রাশিয়াকে এ যুদ্ধে যেতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাধ্য করেছে।

নথি ফাঁস, বব বাউয়ার এবং পুতিনের বক্তব্যে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এ যুদ্ধ থামার নয়। বরং এটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। পুতিনও ছাড়ার পাত্র নয়। কেননা, ইউক্রেনকে কৌশলগতভাবে রাশিয়া তার বাড়ির পেছনের আঙ্গিনা বলে বিবেচনা করে। ইউক্রেনের সম্মতিক্রমে ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্য করতে রাজি। রাশিয়ার দাবি ছিল, এটা যেন কখনও না হয়। তাছাড়া, ১৯৯০ সালে ন্যাটোকে পূর্বদিকে সম্প্রসারণ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র সে কথা রাখেনি। পশ্চিমা শক্তি আসলে ন্যাটো জোটকে ব্যবহার করে চারিদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলেছে। পুতিনের দাবি ছিল, ন্যাটো যেন পূর্ব ইউরোপে তাদের সামরিক তৎপরতা কমিয়ে আনে। সে দাবিও প্রত্যাখ্যান হলে ইউক্রেনে হামলা চালানো ছাড়া রাশিয়ার আর কোনো পথ ছিল না। মূলত ন্যাটোকে রাশিয়ার সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে পশ্চিমারা রাশিয়াকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চায়।

পুতিনের এমন অভিযোগের যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সংঘটিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এর সত্যতা পাওয়া যায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডেপ্রি ডি’র বক্তব্য থেকে। তাঁর মতে, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার পরিণতি সম্পর্কে জানতেন অনেক নিওকন নেতা। তারা নিশ্চিতভাবে জানতেন যে, রাশিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা জেনে-শুনে ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায়। অথচ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়ই ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে রাখার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু নব্য রক্ষণশীলরা সিদ্ধান্ত নেয়, যুক্তরাষ্ট্রকে ওইখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ইউক্রেনকে আর নিরপেক্ষ হিসেবে রাখার প্রয়োজন নেই। বরং ন্যাটোর সদস্য বাড়াতে হবে। ন্যাটোকে রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। ইউক্রেন পর্যন্ত ন্যাটোর সম্প্রসারণকে নব্য রক্ষণশীলরা যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় হিসেবে মনে করে। তাদের পরিকল্পনাতে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে ইউক্রেন পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর পরিণতিই এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নব্য রক্ষণশীলদের অপতৎপরতা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে ২০২২ এর ১ জুন ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘দি হিল ট্যাবলয়েড’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, ওয়াশিংটনে একটি স্বঘোষিত জাতীয় নিরাপত্তা ‘বিশেষজ্ঞ সম্প্রদায়’-এর উদ্ভব হয়েছে। জো বাইডেনের ইউক্রেন নীতি ঠিক করার ক্ষেত্রে তাঁরাই এখন চালকের আসনে।

নিওকন আন্দোলনের মূলকথা হলো, বিশ্বের সর্বত্র যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। উদীয়মান শক্তি হিসেবে অবশ্যই যুদ্ধের মাধ্যমে দমন করা হবে যাতে তারা কখনও যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারে। এজন্য সারাবিশ্বে থাকতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের শত শত ঘাঁটি এবং সবসময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে আর জাতিসংঘকে কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে।

১৯৭০ সালের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লিওস্ট্রান্স এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডোনাল্ড খাগানির নেতৃত্বে কয়েকজন বুদ্ধিজীবি শুরু করেন নিওকন আন্দোলন। বর্তমানে যেসব নিওকন আন্দোলনের নেতা রয়েছেন তারা হলেন, ভিকটোরিয়া নুল্যান্ড, পল ওল্ফোভিটস্, ডোনাল্ড খাগানির ছেলে রবার্ট খাগান ও ফেড্রোরিফ খাগান, নরম্যান পোধোর্তজ, রিচার্ড পেরেল, পল ব্রেমার, ইলিয়ট কোহেন ও ইলিয়ট আব্রামস্ ইত্যাদি। বর্তমানে বাইডেন প্রশাসনের স্টেট ফর পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্সের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড হলেন নিওকন আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডোনাল্ড খাগানির পুত্রবধু। তার স্বামী রবার্ট খাগান নিওকন আন্দোলনের বর্তমান নেতা।

ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড এক সময় বুশ জুনিয়ার প্রশাসনে ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, ওবামা প্রশাসনের ইউরোপ বিষয়ক এসিস্ট্যান্স সেক্রেটারি এবং ইউক্রেনে ১৯১৪ সালে রুশ-পন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতে দারুণ ভূমিকা পালন করেছেন।

২০০২ সালে পল ওল্ডফিউজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের জন্য একটি ডিফেন্স পলিসি গাইডেন্সের খসড়া প্রণয়ন করেন। এখানে তিনি নিওকন এর এসব লক্ষ্য বর্ণনা করেছেন। নিওকন এর এ পরিকল্পনার আলোকে গত দু’দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অপারেশন পরিচালনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

মূলত ১৯ শতকে অটোম্যানদের পরাজিত করে রাশিয়ান সাম্রাজ্য ক্রিমিয়া দখলে নেয়ার পর থেকে বৃটেন এবং ফ্রান্স সিদ্ধান্ত নেয় কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার আধিপত্য খর্ব করার। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নব্য রক্ষণশীলরা ইউক্রেন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টেনে আনে। তাদের বিশ্বাস ছিল, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে অবশ্যই বিজয়ী হয়ে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করবে যুক্তরাষ্ট্র।

নব্য রক্ষণশীলরা যা-ই মনে করুক না কেন, অনেক বিশ্লেষক ইউক্রেন যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি বিপর্যয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। প্রফেসর জেপ্রি ডিও মনে করেন, ইউরোপের নেতারা যদি দূরদর্শী হতো, তাহলে তারা নিজেদেরকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখতো। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের ধ্বংসাত্মক পররাষ্ট্রনীতির সাথে শরীক হতো না। তাঁর মতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিওকন’ বা নব্য রক্ষণশীলদের সর্বশেষ বিপর্যয় হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। নব্য রক্ষণশীলরা গত ৩০ বছর ধরে তীব্র যুদ্ধ উম্মাদনায় আক্রান্ত। বাইডেন প্রশাসনে বর্তমানে গিজ গিজ করছে নব্য রক্ষণশীল বা নিউ কনসার্ভেটিজম আন্দোলনের সাথে জড়িত লোকজন। এরা এর আগে ১৯৯৯ সালে সার্বিয়া থেকে শুরু করে ২০০১ সালে আফগানিস্থান, ২০০৩ সালে ইরাক, ২০১১ সালে সিরিয়া এবং লিবিয়া যুদ্ধে টেনে এনেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। সীমাহীন ব্যর্থতা আর বিপর্যয়ই তাদের একমাত্র রেকর্ড। তাদের সর্বশেষ বিপর্যয়ের উদাহরণ হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। জেপ্রি ডি পরামর্শ দিয়েছেন, এখনো সময় আছে, ইউরোপের এ বিপর্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরও না জড়িয়ে বরং বের হয়ে আসা।

যে কোনও যুদ্ধ এড়ানো যায় পারস্পারিক আলোচনার টেবিলে বসে, কুটনৈতিকভাবে মগজাস্ত্রে শান দিয়ে। এমন উদ্যোগ গত বছর তুরস্কের এরদোগান এবং বর্তমানে চীনের শী নিলেও এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে অস্ত্র ব্যবসায়ীর লোভ এবং রাষ্ট্রনেতাদের সা¤্রাজ্যবাদী, বিদেশ-আগ্রাসী এবং প্রভুত্বকামী মনোভাব। অস্ত্রব্যবসার লাভের জন্যই বিশ্বব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন, দীর্ঘমেয়াদী অশান্তি চায় এবং রাষ্ট্রীয় মদতেই যুদ্ধ চায় যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো। এতে বিশ্বের অন্যদের মতামতের কোনও মূল্য নেই। এখন কিয়েভ চাইলেও যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, ইউক্রেন যুদ্ধ এখন আর কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে নেই। এ যুদ্ধ এখন যুক্তরাষ্ট্রের মর্জির ওপর নির্ভর করছে।

সুতরাং যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ নেই। রাশিয়া দিন দিন আগ্রাসি ভূমিকা নিচ্ছে এবং বারবার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, পরাজিত হলে পারমাণবিক যুদ্ধ অনিবার্য। রাশিয়ার এমন হুমকিকে দু’পয়সারও পাত্তা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভূক্ত দেশগুলো মানবতা বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে কিয়েভকে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মার্কিন সেনাবাহিনীর অন্যতম শক্তিশালী ও অত্যাধুনিক অস্ত্র ৩১টি আব্রামস ট্যাঙ্ক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সুতরাং এ যুদ্ধের পরিণতি দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।

লেখক :শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test