E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট এবং ১৪ বছর পরের গল্প 

২০২৩ এপ্রিল ১২ ১৫:১৯:৩০
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট এবং ১৪ বছর পরের গল্প 

রহিম আব্দুর রহিম


১০ এপ্রিল জাতীয় ইংরেজি দৈনিক Daily NewAge পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, "Probe report submission in sagar Runi murder case deferred  for 97th time." অর্থাৎ '৯৭ বারের মত পিছিয়েছে সাগর রুনি হত্যা মামলার তদন্ত দাখিলের সময়।' ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/এ/২ বাড়ির ৫ তলার এ-৪ ফ্লাটে নৃশংসভাবে খুন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি। খুনের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন।     

সাগর-রুনি খুন হবার পর রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরে বাংলা নগর থানায় মামলা করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)উত্তরের পরিদর্শক মো.রবিউল আলমের ওপর। দুইমাস পরে হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া র‌্যাবকে। একাধিক বার তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন, অত্যধুনিক যুগের পুলিশ, র‌্যাব দীর্ঘ ১১ বছর তদন্ত করে হত্যাকান্ডের কূলকিনারা করতে পারে নি। ফলে যা হবার তাই, ৯৭ বারের মত তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করতে পারেনি; এই না পারা যেমন জাতির জন্য হতাশার, তেমনি সংশ্লিষ্টদের চরম ব্যর্থতা। তবে সংস্থাগুলো ধন্যবাদ দেওয়া যায় এই বলে যে, তারা জজ মিঞা নাটক সাজায়নি।

দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তদন্ত সংশ্লিষ্টদের হাতে হয়তবা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকতে পারে, যা প্রকাশ হলে প্রভাবশালী কোন ব্যক্তিমহল আটকে যেতে পারে বা উল্লেখ যোগ্য ক্লু না থাকায়, প্রাপ্ত তথ্যাদি প্রমাণে জটিলতা দেখা দিতে পারে; এও হতে পারে যে ভীকটিম অন্যকোনে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। যাই হোক না কেনো, চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারা, না পারার বিষয়টি উচ্চ আদালত সপ্রনোদিত হয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাজ থেকে জানতে পারলে আর না হোক বিচার প্রার্থীরা কিছুটা আত্মতৃপ্তি পেতো এতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা এই হত্যাকান্ডের ন্যায় বিচার কামনা করছি। যে সাংবাদিক সমাজ যুগযুগ ধরে শত ঘটনার রহস্য উদঘাটনে পুলিশকে সহযোগিতা করে আসলো, অথচ সেই সমাজের 'সাংবাদিক দম্পতি' হত্যার রহস্য পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, র‌্যাব উম্মোচন করতে পারছে না। এখনও বাংলাদেশ জাতরেল অনেক ক্রাইম রিপোর্ট রয়েছেন, তারা কি করছেন? বছর বছর 'সাগর রুনি' হত্যা মামলার বিচার চেয়ে মানব বন্ধন কিংবা সমাবেশ করলেই দায় শেষ নয়, হত্যা রহস্য উদঘাটনে সাংবাদিকদের কলম শাণিত করতেই হবে।

এবার সংবাদ কর্মীদের ওপর আরোপিত 'ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট' নিয়ে বলছি, সংবাদপত্রে, চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশ হতেই পারে, যদি প্রকাশিত সংবাদটি ভিত্তিহীন বা উদ্দেশ্য প্রনোদিত হয়, তবে সেক্ষেত্রে প্রতিবাদ কিংবা সমালোচনার সুযোগও রয়েছে তবে কথা থাকে, যে সংবাদ মাধ্যমটি ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করে, ওই সংবাদ মাধ্যমটি ততটা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না, সমালোচনা বা বিশ্লেষণ তো দূরের কথা। তবে অন্য সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ওই সংবাদটির প্রতিক্রিয়া, বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন যে করে তার প্রমাণ আছে। অত্যধুনিক পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই 'ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট' রয়েছে। যা, প্রচার, প্রকাশ এবং স্বাধীন মত প্রকাশের শৃঙ্খলা রক্ষায় যে আইনটি ব্যবহার হয়। আমাদের দেশে যার অপব্যবহার হচ্ছে বারবার। এই আইনটি বাতিল না হলেও সময় উপযোগী সংস্কার হওয়া জরুরী। প্রতিটি সরকারের উন্নয়ন ফিরিস্তি যে সংবাদ মাধ্যম গুলো তুলে ধরছে,তারা যেকোন ব্যক্তি গোষ্ঠীর তথ্য প্রমাণসহ নেতিবাচক দিকও উপস্থাপন করার অধিকার রাখে। ১১ এপ্রিল Daliy New Age প্রথম পাতায়, "PM takes a swipe at US, Yunus, Prothom Alo," শিরোনামের রিপোর্ট বডির শুরুতেই উল্লেখ, সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,"
কাগজের নাম প্রথম আলো কিন্তু বাস করে অন্ধকারে। প্রথম আলো আওয়ামীলীগ, গণতন্ত্র ও দেশের শত্রু।" প্রথম আলো সম্পর্কে খুদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সমালোচনা করেছেন, আর সমালোচনা হোক। কোন সংবাদ বা সংবাদকর্মীর ওপর কেউ ক্ষুব্দ হলে তা লেখনির মাধ্যমেই হতে পারে, সমাবেশ, সেমিনারের মাধ্যমেই করা যেতে পারে কোনভাবেই তা কোন আইনে খড়ক বা বাহুবলে নয়। একই দিনে এই পত্রিকার অন্য একটি শিরোনাম ছিল, "Youths breach security, intrude on Prothom Alo." এই শিরোনামের ইন্টুতে উল্লেখ, "সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ানবাজারে দৈনিক প্রথম আলো কার্যালয়ে ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী একদল যুবক নিরাপত্তা লঙ্ঘন করে প্রবেশ করে, তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীদের হুমকি দেয়, সম্পাদক মতিউর রহমানকে নিয়ে চিৎকার করে এবং দৈনিকটির অভ্যর্থনা দেয়ালে ‘বয়কট’ লিখে দেয়। .নিরাপত্তা ভেঙ্গে কোন অফিসে অনুপ্রবেশ করার মিশনটা কি সরকারের জন্য নেতিবাচক, নাকি ইতিবাচক? এ ধরনের বাড়াবাড়ি আচরণ আইন পরিপন্থী।

'এবার ১৪ বছর পরের গল্গটি' পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করছি। গত ৮এপ্রিল জাতীয় দৈনিক কালবেলা পক্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, ড.ইমতিয়াজের বইয়ের তথ্য নিয়ে বিতর্ক চলছে। সংবাদ বডির সারাংশ, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. মতিয়াজ পাকিস্তানের একটি ইনস্টিটিউটের আর্থিক সহযোগিতায় 'হিস্টো রাইজিং' ১৯৭১ জেনোসাইড : স্টেট ভার্সেস পারসন।' নামে একটা বই লেখেন ২০০৯ সালে। যার প্রকাশ ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড। এই বই সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এই বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের পর জয় পাকিস্তান বলেছে। ১৫ পৃষ্ঠায় মুক্তিযোদ্ধাকালীন শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ৪১ পৃষ্ঠায় একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে তর্ক উত্থাপন ও একাত্তরে অন্তত ১৫ থেকে ৫০ হজার বিহারী হত্যা হয়েছে বলে একটি বিদেশি প্রকাশনার কথা উল্লেখ করে তদন্ত দাবী করেছেন। বইয়ের ২০ পৃষ্ঠায় জাতীয় সংসদে কোন আলোচনা করা ছাড়া শুধু সরকারি নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধকালের জাতীয় পতাকা থেকে মানচিত্র সরিয়ে দেওয়া ও একাত্তরের গণহত্যা আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বিদেশী শক্তিগুলোর চাইতে দেশীয় সরকারগুলো বেশী দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন।"

বইয়ের সমালোচনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগ পন্থী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ড.ইমতিয়াজের বিচারের দাবী তুলেছেন। হাস্যকর বিষয়, দীর্ঘ ১৪ বছরের পর লেখকের বিরুদ্ধে আন্দোলন, তাও আবার বইটি আন্দোলনকারীরা পড়ে নি; একজনে পড়েছেন, সমালোচনা করেছেন, আর সেই সূত্র ধরে আন্দোলনকারীরা লেখকের বিচারে দাবীতে সোচ্চার হয়েছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় ছিলেন, বইটি মোড়ক উম্মোচন করেছেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, যিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারপন্থী। এছাড়াও মনে রাখতে হবে, একজন লেখকের চিন্তা আর পাঠকের বিশ্লেষণ এক নয়, তবে কাছাকাছি। একটি বাক্যের ভাবার্থ বা বিশ্লেষণ বিচারকের কাছে একরকম, আইনজীবীর কাছে তা অন্যরকম, গবেষকের কাছে যার অর্থ ভিন্নতর। শিক্ষক, পাঠকদের কাছে যা আলাদা ব্যঞ্জনার। আর পাঠ সমালোচকের কাছে যা সীমাহীন ত্রুটি বিচ্যুতির এক পাহাড়সম আর্বজনা। দেশের মানুষের সুবিচার নিশ্চিত, কথা বলা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং পবিত্র কলমের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, সবার। সকল প্রকার ইতিবাচক কর্মটি যে সবার, এই সংস্কৃতি চর্চা, এই দেশে কবে, কিভাবে, কারা শুরু করবেন? তা ভাবনার সময় এখনই।

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট, গবেষক ও শিশু সাহিত্যিক।

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test