E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আবহমান ঐতিহ্যের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার ‘বাংলা নববর্ষ’

২০২৩ এপ্রিল ১৩ ১৫:৫১:২৭
আবহমান ঐতিহ্যের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার ‘বাংলা নববর্ষ’

গোপাল নাথ বাবুল


প্রতিটি জাতির জীবনে তার ক্যালেন্ডারের নববর্ষ ঐতিহ্যের বুনিয়াদ তৈরি করে। সামাজিক ক্ষেত্রে জীবনযাত্রা যতই জটিল থেকে জটিলতর হোক না কেন, নববর্ষ উদযাপনের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। বাঙালির জাতীয় জীবনে বাংলা নববর্ষ তার আত্মপরিচয়ের আকাঙ্খাকে আরও বিকশিত করতে প্রেরণা জোগায়। কারণ, পৃথিবীর কোনো জাতিই তার ভাষা এবং সংস্কৃতির পরিচয় ভুলে বেঁচে থাকতে পারে না। আর ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয় বিলীন হয়ে গেলে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকারের দাবিটিও দুর্বল হয়ে পড়ে। আর সে কারণেই ৪৭ এর দেশভাগের পর পাকিস্তানি ভূতগুলো বাংলাভাষা, বাঙালি সংস্কৃতির বুনিয়াদকে ধ্বংস করার জন্য এক বীভৎস মুখ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু ৫২তে সালাম, রবকত, রফিক, শফিক প্রাণ দিয়ে পাকিস্তানিদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, তাদের সে মনোবাসনা পূরণ হবার নয়। কারণ বাঙালি নিজের মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে নিজের জীবন হাসতে হাসতে বিলিয়ে দিতে পারে। এরপরও এ কাজটা সম্পন্ন করার জন্য অকৃতজ্ঞ পাকিস্তানিরা জাতির ভাষা এবং সংস্কৃতির পরিচয়কে বিলীন করে দেওয়ার জন্য একের পর এক প্রয়াস চালিয়েছিল। কিন্তু বীর বাঙালিকে কোনো ভয়-ভীতিই আটকাতে পারেনি। 

অথচ সেই বাঙালি জাতি আজ দিশেহারা। ধর্মীয় আবেগ তুলে জাতির ঐক্য-চেতনায় অনৈক্যের চোরাস্রোত বইয়ে দেওয়ার প্রণালীবদ্ধ প্রয়াস এখন বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। ফলে বাংলার নববর্ষকে এখন ধর্মীয় আবরণে প্রকাশ করার এক সুগভীর চেষ্টা নতুন মাত্রা নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের কোনো একজন সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন আইনজীবী নাকি মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ধর্ম বিরোধী বলে মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের জন্য আইনী নোটিশ দিয়েছেন। জঙ্গী আদর্শে বিশ্বাসী ছাড়া এমন কাজ কে করতে পারে! এদের মতো কুলাঙ্গারগুলোই রমনা বটমূলে বোমা হামলাকারীদের অনুসারী, এতে কোনো সন্দেহ নেই। নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার জন্য মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু বর্ষবরণের অনুষঙ্গই নয় বরং ইউনেস্কোর বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্যের অংশ।

মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনী নোটিশ দেওয়ার মতো প্রয়াস যে কী ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, জাতির সুবিধাভোগী নেতৃত্ব সেটা অনুভব করতে পারছে না। আগামীদিনে এ পরিস্থিতি কোন খাতে মোড় নেবে, সেটা বলা মুশকিল। কেননা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আজ ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ানোয় নানাভাবে বিদ্বেষের আবহ জাগিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। ভোট-লালসায় ডান-মধ্য-বাম সব রাজনীতিই এখন সংখ্যাগুরুর উগ্র জাতীয়তাবাদের কাছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। এ পটভূমিতে বাঙালি তার আত্মসম্মান এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে কিনা, সেই উত্তর খোঁজার দিন বাংলা নববর্ষ।

বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল ধর্মের মানুষের এ এক মিলন উৎসব। বাংলা সনের প্রথম বৈশাখ মাসের প্রথমদিন উদযাপিত হয় বলে নববর্ষের অপর নাম পহেলা বৈশাখ। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বের বাঙালিরা এ দিনে অতীতের সকল দুঃখ-গ্লানি ভুলে গিয়ে বরণ করে নেন নতুন বছরকে। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সুখময় ও সমৃদ্ধ হয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি লোক উৎসব হিসেবে বিবেচিত।

জানা যায়, হোসেন শাহের আমলে (৯০৩ হিজরী) বাংলা সনের প্রচলন হলেও এটি সর্বভারতীয় রূপ লাভ করে স¤্রাট আকবরের আমল ৯৬৩ হিজরী থেকেই। তখন থেকেই এটি বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে এবং বাংলা সন আপামর বাঙালি জাতির একান্ত নিজস্ব অব্দ হিসেবে পরিগণিত হয়। তখন থেকেই চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল পরিশোধ করতে হতো এবং পরেরদিন পহেলা বৈশাখে ভূমি মালিকেরা নিজেই নিজ প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ সময় বিভিন্ন মেলা ও বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কালক্রমে সামাজিক উৎসব হিসেবে পরিগণিত হওয়া এ উৎসবটির তৎকালীন রূপ পরিবর্তন হয়ে ভিন্নরূপ ধারণ করে। গ্রাম-শহর ও বাণিজ্যিক এলাকায় পুরাতন বছরের বকেয়া আদায়ের মাধ্যমে পুরনো হিসেবের বই বন্ধ করে গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে নতুন হিসেবের খাতা খোলার দিন হিসেবে পরিগণিত হয়।

সুতরাং চৈত্রের শেষ দিনে পঞ্চব্যঞ্জন খেয়ে পরের দিনের পহেলা বৈশাখে মিষ্টিমুখ করার সেই পুরনো অনুষ্ঠান এখন চলে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ ভাজা খাওয়ার মাধ্যমে। বাজার অর্থনীতির আগ্রাসন ও বুর্জোয়া বিলাসিতায় নাগরিক মধ্যবিত্তদের মেকি বাঙালিয়ানাটা বাদ দিলে বাংলা নববর্ষ বাঙালির আবহমান ঐতিহ্যের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। এ উৎসব জাতীয় জীবনের প্রেরণা থেকেই দেশ ও জাতিকে পৌঁছে দিতে পারে বিশ্বভ্রাতৃত্বের মোহনায়। তবে সতর্ক থাকতে হবে বাঙালি জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী কিছু কুলাঙ্গার ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ব্যাপারে। সুতরাং নতুন বছর আমাদের জন্য বয়ে আনুক আনন্দ ও মঙ্গল। শুভ নববর্ষ-১৪৩০ বাংলা।

লেখক :শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test