E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্বাস্থ্যখাতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায়

২০২৩ এপ্রিল ১৫ ১৬:১০:৪১
স্বাস্থ্যখাতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায়

গোপাল নাথ বাবুল


১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। ভারতের বাবরী মসজিদ ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ৭ ডিসেম্বর সরকারি মদদে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সুপরিকল্পিত হামলায় জাতীয় মন্দির ঢাকেশ্বরী, ঢাকার ভোলানাথগিরী আশ্রম, পুরোনো ঢাকার হিন্দু মালিকাধীন স্বর্ণের দোকানগুলো এবং রায়ের  বাজারের হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। মনে পড়ে, উম্মুক্ত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হামলায় সার্কভূক্ত চার জাতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। 

এর পরেরদিন কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, চট্টগ্রাম শহরের কৈবল্যধাম, তুলসীধাম, পঞ্চানন ধাম, বলুয়ার দিঘীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানসহ প্রায় সকল মন্দির এবং উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও মীরেরশ্বরাই-এর প্রত্যেকটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম লুঠ করার পর সম্পূর্ণরূপে আগুনে ভস্মীভূত করা হয়েছিল। এছাড়া বেশকিছু হিন্দু নারী ধর্ষিত ও অপহরণ হয়েছিল। তখন প্রচুর শীত পড়ছিল। গ্রামের পর গ্রাম হিন্দুদের বাড়িগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। এ উপলক্ষে নির্যাতীত হিন্দুদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে পরিবার প্রতি একটা করে কম্বল দিয়েছিল। ঘটনার পরদিন থেকে জাতিসংঘ, আমেরিকা, বৃটেন, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো থেকে বিভিন্ন লোক আসছিলেন এলাকাগুলো পরিদর্শনের জন্য।

হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার সেক্রেটারী এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় ঐক্য পরিষদের সেক্রেটারী এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত আমাকে বললেন, ওদের সঙ্গ দিতে এবং নির্যাতীত এলাকাগুলো পরিদর্শনে সহায়তা করার জন্য। এরপর থেকে প্রতিদিন আমার কাজ ছিল লালদিঘীর পাড় থেকে একটা কার ভাড়া করে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লোকগুলোকে এলাকাগুলো পরিদর্শন করানো। সে হিসেবে গণস্বাস্থ্যের কর্মী-অফিসারদের সঙ্গে কম্বলগুলো বিতরণ করার দায়িত্বও আমার ওপর পড়ে। তখনই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী সম্পর্কে আমি ভালোভাবে অবগত হই। নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ওনার মতো ব্যক্তিত্বের তুলনা হয় না। সংস্থার কর্মী-কর্মকর্তা সবাই নারী। এমনকি গাড়িগুলোর প্রত্যেকটি ড্রাইভারও নারী। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন ডা. চৌধুরী। উত্তরবঙ্গের মঙ্গা এলাকা থেকে অসহায় ও হতদরিদ্র নারীদের নিয়ে এসে বিভিন্ন কাজে প্রশিক্ষণ দিতেন এবং ইলেক্ট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার, ওয়েল্ডার, ড্রাইভার হিসেবে নারীদের সংস্থায় চাকরি দিতেন। নারীরাও সব কাজ পারে, তা তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ১৯৮২ সাল থেকে মেয়েরা গণস্বাস্থ্যের বড় বড় জীপগুলো চালাতে শুরু করেন।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন মোর্শেদ চৌধুরী ও গৃহিনী হাছিনা বেগম চৌধুরীর কোল আলো করে ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার কোয়েপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী গত ১১ এপ্রিল ৮১ বছর বয়সে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ১০ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বাবা ছিলেন বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্যসেনের ছাত্র।

সুতরাং ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামক স্বাস্থ্য বিষয়ক এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মহান মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় ওষধ নীতি প্রণয়ন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্বপ্রণোদিতভাবে, দ্বিধাহীন চিত্তে তিনি জড়িয়ে যেতেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এক সময় দেশের চাহিদার ৭০%-এরও বেশি ওষধ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। ১৯৮২ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় ওষধ নীতি প্রণয়ন করা হয়, যার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ডা. চৌধুরী। ১২ জুন, ১৯৮২ সালে ওষধ নীতিটি অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। ১৯৮১ সালে গড়ে তোলেন ‘গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল’। কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য অপরিহার্য ইনজেকশন ‘হ্যাপারিন’সহ বিভিন্ন ওষুধের দাম হয়ে যায় অর্ধেক। ফলে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বল্পমূল্যে মানসম্মত ওষুধ পৌঁছে দেওয়া সহজ হয় এবং বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৫০টির মতো দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে।

ড. জাফরউল্লাহ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বলে গেছেন, ‘চিকিৎসা মানুষের অধিকার, ব্যবসা নয়।’ সকল পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সত্য, সুন্দর ও গণতন্ত্রের কন্ঠস্বর। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস্-এ এফআরসিএস-এ ভর্তি হন। সেখানে গবেষণা চলাকালীন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে তিনি লন্ডন থেকে ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগরতলার মেলাঘর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে ডা. এম এ মবিনের সঙ্গে মিলে সেখানেই যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময় অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ দিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নার্সিং করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ওই হাসপাতালটি ঢাকার ইস্কাটন সড়কে পুনঃস্থাপিত করেন। পরবর্তীতে ‘চল গ্রামে যাই’ শ্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ নিয়ে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নাম দিয়ে ১৯৭২ সালে হাসপাতালটি সাভারে পুনঃস্থাপন করেন। হাসপাতালটির জন্য ৫ একর জায়গা দান করেন পাকিস্তান সরকারের যুগ্ন সচিব এম এ রব, জোহরা বেগম ও ডা. লুৎফর রহমান। অবশিষ্ট ২৩ একর অধিগ্রহণ করে দেন বঙ্গবন্ধু। এভাবে মুক্তিযুদ্ধকালে আগরতলায় গড়ে তোলা ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ স্বাধীন বাংলাদেশে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে যাত্রা শুরু করে। সাভারের পর ১৯৯৫ সালে ঢাকার মিরপুর রোডে গড়ে তোলেন ‘গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল’। এছাড়া কক্সবাজার ও চাপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫০টির মতো স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে, যেখানে সাধারণ জনগণ সার্বক্ষণিক চিকিৎসা পান।

পারিবারিকভাবে বিত্তশালী ডা. চৌধুরী অত্যন্ত জৌলুসপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। দামি গাড়িতে চলাফেরা করতেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবনে পরিবর্তন আনে। তারপর একটা মাত্র শার্ট দিয়ে তিনি ৩০ বছর কাটিয়ে দেন। তাঁর চিন্তাধারায় ছিল মানুষ। ছাত্রজীবনে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও পরবর্তীতে কোনো দলের সাথে যুক্ত না হলেও রাজনীতি সচেতন এ ব্যক্তি বলতেন, ‘আমি মানুষের রাজনীতি করি।’ নিজের নামে কোনো সম্পদ ছিল না। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া নিজের সমস্ত সম্পত্তি বোনকে দান করে দিয়েছিলেন।

স্বাধীনচেতা এ ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুকে সবার ওপরে স্থান দিতেন। কিন্তু বাকশালে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করেছিলেন। জিয়াউর রহমানকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান করতেন। কিন্তু বিএনপিতে স্বাধীনতা বিরোধী থাকায় মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। দেশের প্রয়োজনে তিনি আওয়ামীলীগ ও বিএনপি উভয় দলের সমালোচনা করতেন। তিনিই সাহস করে ভাস্কর্য নিয়ে কথা না বলে মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে সোচ্চার হতে হেফাজতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। যা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকেও বলার সাহস করেনি কোনোদিন। বরং হেফাজতসহ ধর্মীয় দলগুলোকে তোষণ করে চলছে বর্তমান সরকার।

‘পিপলস্ হেল্থ মুভমেন্ট’ নামের একটি বৈশ্বিক সংগঠনের নির্বাহী সদস্য ডা. চৌধুরী ‘সুইডিশ ইয়ুথ পিস প্রাইজ’ (১৯৭৪), সর্বোচ্চ বেসামরিক ‘স্বাধীনতা পদক’(১৯৭৭), বিকল্প নোবেল পুরস্কার ‘র‌্যামন ম্যাগসাই পুরস্কার’(১৯৮৫), সুইডেনের ‘লাইভলি হুড পুরস্কার’(১৯৯২), কানাডার ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব ন্যাচারাল মেডিসিন ২০০৯ সালে ‘ডক্টর অব হিউম্যানিটারিয়ান’ উপাধি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ’ পুরস্কার (২০১০), মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া তিনি ১৯২১ সালে ‘আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার পান। সর্বশেষ ১৮ মার্চ ‘মুক্তিযুদ্ধ, চিকিৎসা ও সমাজসেবায় জীবনব্যাপী অবদানের জন্য তাঁকে ‘সমকাল-চ্যানেল টোয়েন্টিফোর গুণীজন সম্মাননা-২০২৩’ প্রদান করে। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা ‘রিসার্চঃ অ্যা মেথড অব কলোনাইজেশন’। এটি ১৯৭৭ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর বাংলা, ফরাসি, জার্মান, ইতালি, ডাচ, স্পেনিশসহ একাধিক ভাষায় এটি অনুবাদ হয়।

সুতরাং আমরা এ মহান ব্যক্তিত্ব ও স্বাস্থ্যখাতের এ উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায়ে গভীরভাবে শোকাহত। মানবসেবায় সারাজীবন জীবন কাটিয়ে দেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি ও বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test