E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সহায়তা দান

২০১৪ অক্টোবর ২৫ ১৪:২৮:২৭
অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সহায়তা দান

চৌধুরী আ: হান্নান : শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং এফবিসিসি আই এর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন- অনিচ্ছাকৃত যারা ঋণখেলাপি হয়েছেন সেসব ব্যবসায়ীকে ঋণ পুন:তফসিলের মাধ্যমে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে সহায়তা করবে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। খবরটি নিশ্চিতভাবে আশান্বিত করেছে ওই ব্যাংকের গ্রাহকদের এবং এ সুযোগ গ্রহন করে অনেক ব্যবসায়ী তাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করে মূল ধারায় ফিরে আসতে পারবেন।

অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিগণ ব্যবসায়ী মহলে কম প্রভাবশালী, দুর্বল গোছের লোক প্রকৃত কোন কারণে ব্যবসায় মার খাওয়ার ফলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার সদিচ্ছা রয়েছে তাদের। এক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ থাকা সত্ত্বেও অন্য কোন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করে নেয়ার ‘কায়দা কানুন’ তাদের জানা নেই বা বেনামী ঋণ নেয়ার কলাকৌশল শিখে উঠতে পারেনি। ব্যাংকের নানা প্রকৃতির গ্রাহক বা ঋনগ্রহীতার মধ্যে এ ‘প্রজাতিটি’ অনেকটা বিপন্ন প্রাণীর মত। ব্যাংক কেবল ঋণ আদায়ে নিয়ম-নীতির কথা অনবরত শুনাতে থাকে কিন্তু অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কোন আবেদন নিবেদন শুনতে চায় না। তারা কেবল দেয়ালে মাথা কুটে মরে। তাদের কথা ভাবার কোথাও কেউ নেই।

তবে জনাব এ কে আজাদ যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তাতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অন্ধকার জগতে একটা উজ্জ্বল আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। সে আলো সরকারি, বেসরকারি সকল ব্যাংকে ছড়িয়ে দেয়ার সময় এসেছে। সে দায়িত্ব কে নেবে? সর্বোচ্চ মহলকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের অর্থমন্ত্রীকেই এ গুরু দায়িত্ব নিতে হবে। অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ঋণ নিয়মিত করে তাদের নিজ নিজ ব্যবসায়ে ফিরিয়ে আনতে ‘বিশেষ নীতিমালা’ প্রনয়ণে তার ইচ্ছা, নির্দেশনা থাকা চাই।

বর্তমানে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের দাপটে অস্থির ব্যাংক পাড়া। বড় বড় চিহ্নিত ঋণখেলাপিরা অতীব ক্ষমতাশালী তারা সরকারের নীতি নির্ধারণে ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। আমাদের দেশের একজন অব্যবসায়ী প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষে ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নিতে যেমন অসুবিধা হয় না, তেমনি পরিশোধ না করলে ও অসুবিধা হয় না। তারা কেবল ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তালিকা বাড়ায়।

এক প্রতিবেদনে জানা যায় চারটি সরকারি ব্যাংকের বর্তমান মোট খেলাপি ঋণের পরিমান প্রায় ৩৪ (চৌত্রিশ) হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আবার প্রায় ১৫(পনের) হাজার কোটি টাকা অবলোপন করে রাখা হয়েছে যা ব্যাংক গুলো খেলাপি হিসেবে খাতাপত্রে দেখায় না। ব্যাংকে এই শ্রেণীর গ্রাহকদের চোট-পাটে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ঋণ পেতে সমস্যা হয়। ব্যাংকের বিতরণ যোগ্য ঋণ কমে যায়। ব্যাংক স্বাভাবিক ভাবে গতি হারায়। বড় বড় ঋণ খেলাপিদের ব্যাংক ফিরিয়ে আনার জন্য নানা সুযোগ সুবিধা নিয়ে সরকারি ব্যাংক গুলো ‘দোকান’ খুলে বসে থাকে। এর মধ্যে সুদ মওকুফ সুবিধা অন্যতম। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিপুল পরিমান টাকা ওদের হাতে চলে গেছে। ঋণখেলাপিরা অনেকটা খাঁচা থেকে বের হয়ে যাওয়া বনের ঘুঘু, আটকানো সহজ নয়। তাদের প্রতি সরকারি ব্যাংকের ‘সমাদর’ দেখে নিয়মিত গ্রাহকরা অনেক সময় আক্ষেপ করে বলে থাকেন- ঋণখেলাপি হওয়াই তো ভাল ছিল।

সরকারি ব্যাংকের অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। তাদের কথা শ্রবণ করার সময় কারো নেই। অনিচ্ছাকৃত খেলাপির একটা উদাহরণ দেই। জামিল চৌধুরী (ছদ্ম নাম) একটি ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য ব্যাংক থেকে ৩ (তিন) কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুরী পেয়েছেন। তাঁর দীর্ঘদিনের এক স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে- দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে পন্য উৎপন্ন করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করবেন এবং বিদেশে ও রপ্তানি করবেন। শিল্প ঋণ বিতরণে ব্যাংকের নিজস্ব নিয়ম আছে। প্রধানত তিন ধাপে উক্ত ঋণের অর্থ বিতরণ করা হবে। (ক) ফ্যাক্টরী বিল্ডিং নির্মানের জন্য (খ) যন্ত্রপাতি সংগ্রহের জন্য এবং (গ) কাঁচামাল সংগ্রহ ও শ্রমিকদের বেতন ইত্যাদি। ইতিমধ্যে জামিল চৌধুরী ফ্যাক্টরী বিল্ডিং নির্মানের জন্য ১ (এক) কোটি টাকা বিতরণ পেয়েছেন।

শর্তানুযায়ী ব্যাংকের টাকা ছাড় করার পূর্বে তাকে কমপক্ষে আরও ১(এক) কোটি টাকা নিজস্ব বিনিয়োগ করতে হয়েছে। চৌধুরী সাহেব রুচি শীল লোক, ফ্যাক্টরী বিল্ডিংটা সুন্দর করার জন্য, অবকাঠামো আকর্ষনীয় করার জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে উদার হস্তে বিনিয়োগ করেছেন। শিল্পপতি হওয়ার স্বপ্ন পূরণ বলে কথা। তার পরের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ-করুণ। তিনি ব্যাংকের মঞ্জুরীকৃত অবশিষ্ট অর্থ আর বিতরণ নিতে সক্ষম হননি, ব্যাংকের ‘নীতিমালার’ ফাঁদে আটকে গেছে। ইতিমধ্যে ৪ (চার) বছর অতিবাহিত হয়েছে। এখন তিনি ব্যাংকের খাতায় ঋণ খেলাপি। ব্যাংকের টাকা সুদসহ ফেরত দেয়ার জন্য তার কাছে বার বার নোটিশ আসছে। দীর্ঘদিন ঘাটে ঘাটে দৌড়ঝাপ করে করে তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনী শক্তি নি:শেষ করেছেন।

সরকারি ব্যাংকে জামিল সাহেবের মত দশা দু-এক জনের নয়-অসংখ্য। তাদের কান্না শোনার সময় কারও নেই। অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কান্না এ.কে. আজাদ ঠিকই শুনতে পেয়েছেন। আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী কী তা শুনতে পান না? সর্বোচ্চ পর্যায় দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ার কারণে ও নানা অব্যবস্থাপনার জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো এখন এক ডুবন্ত টাইটানিক জাহাজ। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। ইতিমধ্যে শতভাগ রাষ্ট্র মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের এলসি অন্য ব্যাংক গ্রহণ করতে ভরসা পায় না। অর্থাৎ বেসিক ব্যাংক প্রদত্ত কমিটমেন্ট বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।

বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে উদ্বার করার জন্য এবং ভবিষ্যৎ সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে। বড় বড় পদক্ষেপ নেয়ার পুর্বে এখনই অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের দুর্দশা নিয়ে ভাবতে হবে। তাদের জন্য ‘বিশেষ নীতিমালা’ প্রনয়ণ করতে হবে যাতে সকল সুদ মওকুফের সুযোগ থাকে এবং তাদের পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। মাননীয় অর্থমন্ত্রী কী এ বিষয়ে একটু সুনজর দেবেন?

লেখক : সাবেক ব্যাংকার


(এএস/অক্টোবর ২৫, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test