E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ধর্ম ও সংস্কৃতি যে এক নয়, এ কথা কে কাকে বোঝাবে? 

২০২৩ এপ্রিল ২৫ ১৫:৩৩:০০
ধর্ম ও সংস্কৃতি যে এক নয়, এ কথা কে কাকে বোঝাবে? 

শিতাংশু গুহ


প্রায়ত রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ-র দু’টি মহৎ কর্ম, প্রথমটি রাষ্ট্রধর্ম, দ্বিতীয়টি বাংলাবর্ষ পরিবর্তন করে ১দিন কমিয়ে দেয়া, এবং ‘পহেলা বৈশাখ’ স্থায়ীভাবে ১৪ই এপ্রিল নিয়ে আসা। এরশাদকে আমরা কষে গালিগালাজ করি, কিন্তু তাঁর প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম বা বাংলাবর্ষ সুড়সুড় করে মেনে চলি। আর এক প্রয়াত: রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-কে আমরা সহ্য করিনা, কিন্তু তাঁর প্রবর্তিত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী, অর্থাৎ ‘বিস্মিল্লাহিররাহমানেররাহিম’ ছাড়া ভাষণ শুরুই করতে পারিনা। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই আসামে ‘অসমীয়া-বাঙ্গালী’ দাঙ্গা হয়েছিলো। ধারণা করি, দুইবাংলা-আসাম-ত্রিপুরার বাঙ্গালীরা যাতে এক হতে না পারে, তৎজন্যে ঐ দাঙ্গার সৃষ্টি। এরশাদ ৮ম এবং জিয়া ৫ম সংশোধনী এনেছেন বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যে। বাংলা ক্যালেন্ডারে এরশাদ ছুরি চালান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের মধ্যে বিভেদটা পাকাপোক্ত করার জন্যে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আসামে ‘অসমীয়া-বাঙ্গালী’ দাঙ্গা, ৫ম ও ৮ম সংশোধনীর লক্ষ্য সফল।

বাঙ্গালী স্পষ্টত: দুই ভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশে আমরা চৈত্র সংক্রান্তি’র দিন ১৪ই এপ্রিল ‘পহেলা বৈশাখ’ পালন করি? পশ্চিমবাংলায় ১৫ই এপ্রিল শুভ নববর্ষ। এমনকি বাংলাদেশে হিন্দুরা সরকারি হিসাবমত ছুটিছাটা, আনন্দউৎসব পালন করলেও ঘরে পহেলা বৈশাখ পালন করে পঞ্চিকা দেখে ১৫ই এপ্রিল। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে যারা ভাষণ শুরু করেন, তাঁরা আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করলে দেখতে পাবেন, হিন্দুরা ‘জয় শ্রীরাম’ বলে ভাষণ শুরু করবেন।

মানুষ জেনেশুনে কিভাবে বিভক্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, সেটি দেখাতে চাচ্ছি। ভারতে, বিশেষত: পশ্চিমবঙ্গে এখনো বাঙ্গালী বলতে ‘বাঙ্গালী হিন্দু’ বোঝানো হয়, অর্থাৎ ওঁরা যখন বলে ‘বাঙ্গালী ও মুসলমান’ -এর অর্থ হচ্ছে বাঙ্গালী হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলমান। ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, পশ্চিমবঙ্গে বাঙ্গালী মুসলমান এখনো বাংলার চেয়ে উর্দু পছন্দ করেন। অধুনা অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষী মুসলমান সামনে এগিয়ে আসছেন।

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিলো, এখনো আছে। অধিকাংশ এঁরা এখনো কট্টর ইসলামপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীর পক্ষে। বাংলাদেশের মানুষের একটি বড় অংশ এখন নিজেদের ‘বাঙ্গালী মুসলমান’ ভাবতে পছন্দ করেন। এঁরা বাঙ্গালী হতে ততটা উৎসাহী নন, এরচেয়ে অনেক বেশি উৎসাহী মুসলমান পরিচয়ে। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-র সৃষ্টির কারণ এটি, পহেলা বৈশাখ বা মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে আপত্তির কারণও একই।

এটি সত্য, বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তা এখনো প্রায় পুরোটাই ভারতীয় সংস্কৃতি বা পুরান বা হিন্দু লোকজ প্রথায় ভরপুর। কিছু মুসলমান চেষ্টা করছেন এরমধ্যে আরবীয় সংস্কৃতি ঢোকাতে। সমস্যা হচ্ছে, বাংলার আদ্র জলবায়ুতে মরুর উষ্ণ আবহাওয়া সংমিশ্রণ যথেষ্ট কঠিন। মুসলমানের পক্ষে হিন্দুপ্রথায় ভরপুর বাঙ্গালী সংস্কৃতি মেনে নেয়াও কষ্টকর? এ সময়ে কলকাতায় আওয়াজ উঠছে, বাঙ্গালী হতে হলে বাঙ্গালী সংস্কৃতি বুকে লালন করতে হবে!

এ থেকে পরিত্রানের উপায়, ‘বাঙ্গালী মুসলমান’ পরিচয়। বাংলাদেশে হচ্ছেটা তাই, সবাই আগে মুসলমান, পরে বাঙ্গালী। এতে আরবী থাকলো, বাংলাও থাকলো, কি মজা। দেশে এখন আরবী’র যথেষ্ট কদর, এটি সামনে আরো বাড়বে, কারণ ধর্ম সবকিছু গ্রাস করছে। এমনিতে মুসলিম সমাজে সংস্কৃতি’র জায়গা কম, এ কারণে ধর্মের প্রভাব যত বাড়ছে, সংস্কৃতি’র প্রভাব ততটা কমছে। এটি স্পষ্ট, বাংলাদেশে হিন্দু না থাকলে সাংস্কৃতিক জগৎ মুখ থুবড়ে পড়বে’।

বাঙ্গালী মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকট বুঝতে হবে! অনেকেই দেখবেন তাঁদের পূর্বপুরুষ আরব দেশ থেকে এসেছেন এ পরিচয় দিতে চেষ্টা করেন। এর কারণ তাঁরা বোঝাতে চান যে, তাঁরা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান নন! একই কারণে এঁরা মুঘল বাদশাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, নিজেদের আওরঙ্গজেব’র উত্তরসূরি ভাবতে পছন্দ করেন। মোঘল-পাঠানরা যে বহিরাগত, ধর্ম ভিন্ন হলেও ভারতীয় মুসলমান যে ভারতীয় সংস্কৃতি’র অংশ, এটি মানতে কষ্ট হয়। ধর্ম আর সংস্কৃতি যে এক কথা নয়, একথা কে কাকে বোঝাবে?

আমার কথাগুলো তেতো, সত্য তেঁতোই হয়! কিন্তু সত্যকে মেনে নিতে হয়, এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই! বেশি সংখ্যক মুসলমান আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে বেরিয়ে এলে এখন যেটি ‘হিন্দু সংস্কৃতি’ মনে হয় তা আপনাআপনি ‘বাঙ্গালী সংস্কৃতি’ হয়ে যাবে। অবশ্য, এটি বেশ কঠিন, আপাতত: সেটি হবার সম্ভবনা তেমন নেই, কারণ বাংলাদেশে এখন ‘আরবি’র জোয়ার বইছে। এরমধ্যে আশার আলো হচ্ছে, ঢাকায় বিশাল মঙ্গল শোভাযাত্রা, নিউইয়র্কে পহেলা বৈশাখে মানুষের ঢল।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test