E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্মৃতিতে ২৯ এপ্রিল

২০২৩ এপ্রিল ২৮ ১৫:৫০:৩৩
স্মৃতিতে ২৯ এপ্রিল

গোপাল নাথ বাবুল


১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষদের জন্য ভয়াল একটি রাত। এদিন সমুদ্র উপকূলের এলাকাগুলোতে ‘ম্যারি এন’ নামক ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বিশেষ করে চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা, কাট্টলী, হালিশহর, আনোয়ারা, বাঁশখালী, কতুবদিয়া, মহেশখালী উপজেলায় বিস্তর প্রাণহানির সাথে জলোচ্ছ্বাসের ছোবলে একাকার হয়ে গিয়েছিল মানুষ ও পশুপাখির মৃতদেহগুলো। দুমড়ে-মুছড়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে গিয়েছিল বাড়িঘর, গাছপালা, জমির ফসল ও বাপ-দাদার ভিটের শেষ চিহ্ন পর্যন্ত। ঘূর্ণিঝড়ের এ মহাতান্ডব সারারাত ধরে পরেরদিন সকাল পর্যন্ত চলে। সিম্পসন স্কেলে এ ঝড়ের মাত্রা ছিল ক্যাটাগরি-৫। গতিবেগ ছিল সময়ভেদে ঘণ্টায় ১৬০ কিমি থেকে ২৪০ কিমি পর্যন্ত। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ২০/২২ ফুট। ব্যাস ছিল প্রায় ৬০০ কিমি। বাংলাদেশের ১৬টি জেলার প্রায় ৪৭টি থানা বিধ্বস্ত হয়। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এ ঘূর্ণিঝড়। প্রায় ১ কোটি লোক আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবে ১ লাখ ৩৯ হাজার লোকের মৃত্যুর কথা বলা হলেও ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের ছোবলে বেসরকারি হিসেবে এর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। প্রায় ৭০ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। মোট সম্পদের ক্ষতি হয় ৬০ বিলিয়ন টাকা। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বিভিন্ন অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি। বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরের ১০০ টন ওজনের একটা ক্রেনের প্রচন্ড আঘাতে কর্ণফুলি নদীর উপর নির্মিত নতুন ব্রীজ, চট্টগ্রাম বন্দরে থাকা ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ আকারের বিভিন্ন মালামাল পরিবহণের জাহাজ, বড় বড় তেলের ট্যাঙ্কার, নৌবাহিনীর জাহাজগুলো ও বিমানবন্দরে থাকা প্রায় ৩০/৩৫টি যুদ্ধ বিমান। অনেক জলযান নিখোঁজ হয়ে যায়। বিভিন্ন উপকূলীয় বেঁড়িবাধগুলো ও চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধও বিলিন হয়ে যায়।

সেদিন ছিল সোমবার। ঈদুল ফিতরের তৃতীয় দিন। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সকাল থেকেই গুমোট আবহাওয়া ছিল। বিকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। কয়েকদিন ধরে ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছিল। ২৩ এপ্রিল দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের মিলনস্থলে উৎপত্তি হওয়া ‘ম্যারি এন’ নামক অপেক্ষাকৃত দূর্বল একটি লঘুচাপ প্রথম আবহাওয়াবিদদের কাছে ধরা পড়ে। প্রথমদিকে আবহাওয়াবিদরা তেমন পাত্তা না দিলেও লঘুচাপটি ধীরে ধীরে নিম্নচাপে রূপ নেয়। এমন লঘুচাপ প্রায় সময় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন নামে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। তাই উপকূলীয় মানুষের কাছে সেবারও তেমন একটা ঘূর্ণিঝড় মনে হয়েছিল বিধায় কেউ তেমনভাবে ভাবেনি। কিন্তু ২৩ এপ্রিলে ধরা পড়া এ ছোট্ট লুঘুচাপটি মহাশক্তিশালী রূপ নেয় ২৯ এপ্রিল।

আমি থাকতাম তখন চট্টগ্রাম শহরের কোরবাণীগঞ্জের বলুয়ার দিঘীর পূর্বপাড়ে এবং পশ্চিম পাড়ে বালি চাচার বাড়িতে লজিং থাকতাম। ২ বেলা ভাতের বিনিময়ে ওনার মেয়েকে পড়াতাম। সেদিনও যথারীতি সন্ধ্যা ৭টার দিকে পড়াতে গেলাম। হাল্কা বাতাস শুরু হয়েছে তখন। মুসলিম হলেও চাচী খুব আদর করতেন। সেদিন বললেন, বাবু, আজকে তো আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ। তুমি তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে চলে যাও। ভাত খেতে বসেছি। বাতাসের গতিবেগ আরো বেড়ে যায়। চাচী বললেন, বাবু, ভাত খেয়ে তুমি আমাদের ঘরে বিশ্রাম নাও। আমারও ছেলেমেয়ে আছে বাবা। এমন অবস্থায় তোমাকে আমি যেতে দিতে পারিনা। সেটাই হলো। তখন প্রযুক্তির তেমন কোনো ব্যবহার ছিল না। বিকাল থেকে ক্রমান্বয়ে ৬, ৭, ৮ করতে করতে যখন টিভিতে ১০ নং সিগনালের কথা জানানো হলো, তখন অবস্থা বেগতিক। বিদ্যুৎ চলে গেলে সারা চট্টগ্রাম অন্ধকারে তলিয়ে যায়। সমস্ত আকাশ সিঁদুরের মতো লাল হয়ে উঠল। রাত ৯টা বাজতেই বাতাসের গতিবেগ বেড়ে গেল। প্রচন্ড দমকা হাওয়া শুরু হলো। রাত ১/২টার দিকে ছাদে উঠে দেখি, কর্ণফুলির সমস্ত পানি যেন কূলে উঠে গিয়েছিল। বিশাল বিশাল গাছ দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। তৃণের মতো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বস্তির যত কাঁচা ঘরের টিনের চালসহ ঘরগুলো। সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিল্ডিংও কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, বুঝি কেয়ামত উপস্থিত। আজ হয়তো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই সবাই নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে লাগলাম। এভাবে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে রাত কাটল।

ভোরে বৃষ্টির সাথে প্রচন্ড বাতাস। বৃষ্টি সম্পূর্ণ শেষ হলে নাস্তা খেয়ে বের হলাম। দেখলাম, চাক্তাই খালের পাশে থাকা আমার বাসা তখনো পর্যন্ত বুক বরাবর পানির নিচে। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বের হলাম। পতেঙ্গা, হালিশহরের দিক থেকে স্তরে স্তরে লাশের খবর আসছে। সবার সাথে সেদিকে দৌড়ালাম। দেখলাম, রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে লাশ আর লাশ। গাছপালা ভেঙ্গে পড়ায় চলাচলের রাস্তা প্রায় বন্ধ। খবর পাওয়া যায়, সমগ্র উপকূলীয় এলাকার অবস্থায় একই। কোনো উলঙ্গ মৃত মায়ের বুকের ওপর মরে পড়ে আছে মৃত ছোট্ট শিশু। গরুর সাথে মানুষ জড়াজড়ি করে মরে পড়ে আছে। লম্বা তুলা গাছের শাখায় পা দু’টো আটকে ওল্টা হয়ে লটকে আছে কারো আদরের মৃত কিশোরী। সব জায়গায় খাবার ও পানির মারাত্মক সঙ্কট দেখা দেয়। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়াসহ নানা রোগের উপদ্রবে বেঁচে থাকা অনেক মানুষ পরবর্তীতে মারা যায়। এ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এমন দিনটির কথা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলতে পারব না।

ব্যতিক্রমী ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বারবার ক্রান্তীয় বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিধ্বসের কারণে ভূক্তভোগী হয়েছে তীরবর্তী লাখ লাখ মানুষ। ১৯৭৬ সালের ১ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২০ কিমি/ঘণ্টা, জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল প্রায় ৪০ ফুট। ঘূর্ণিঝড়ের পর দূভিক্ষ ও মহামারিতে প্রায় ২ লাখ লোকের প্রাণহানি হয়। ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২২ কিমি/ঘণ্টা, জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১০.৬ মিটার। সরকারি হিসেবে ৫ লাখ লোকের মৃত্যু বলা হলেও বেসরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। গবাদিপশু মারা যায় প্রায় ১০ লাখ। বাড়িঘর ধ্বংস হয় প্রায় ৪ লাখ। এরপর ১৯৭১, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৭৭, ১৯৮৩, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালের ঘূর্ণিঝড়েও বহু মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানিসহ বহু সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর প্রতিবছরই বিভিন্ন নামে ক্ষতিকর ঘূর্ণিঝড় দেশের উপর বয়ে যায়। ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালের ৩ মে নার্গিস, ২৭ অক্টোবর রেশমি, ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল বিজলী, ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৭ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ২ আগষ্ট কোমেন, ২০১৬ সালের ২০ মে রোয়ানু, ২০১৯ সালের ৫ মে ফনী ও ১২ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের আম্পান, ২০২১ সালের ইয়াস, ২০২২ সালের সিত্রাং সহ প্রায় প্রতিবছরই ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের কথা বিভিন্ন কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ওইদিনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাওয়ার দৃশ্য প্রিন্ট/ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ত্রাণ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে এবং বিভিন্ন দাতা দেশ সামুদ্রিক উপকূলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধগুলো পুনঃনির্মাণ করে দেয়। বর্তমানে অনেক বেড়িবাঁধের অবস্থা নাজুক। কারণ নিয়মমাফিক উক্ত বাঁধগুলো এক বছর অন্তর অন্তর মেরামত করা হয় নি। ফলে বর্ষাকালে অনেক বেড়িবাঁধ উপচে বৃষ্টির পানি গ্রামে ঢুকে পড়ে।

পরিশেষে বলব, দূর্যোগ সবসময় মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে। আর দূর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে সরকারকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য নিয়োগ দিলে আশা করি প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হবে এবং দূনীতি ও রাজনৈতিক রাহুমুক্ত হবে। সুতরাং ওইদিন সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে মারা যাওয়া লক্ষ লক্ষ নর-নারীর আত্মার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test