E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ছোট-বড় সকল সড়কই যমের দুয়ার

২০২৩ মে ০৪ ১৫:১৩:৪৪
ছোট-বড় সকল সড়কই যমের দুয়ার

গোপাল নাথ বাবুল


প্রতিদিন কোনও না কোনও সড়কেই যান দূর্ঘটনা ঘটেই চলছে। এ ব্যাপারে সরকারও যান দূর্ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। কঠোর আইন পাশ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োগও করেছে। কিন্তু কোনো প্রচেষ্টাতেই সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। তাই বলা যায়, বর্তমানে ছোট-বড় সকল সড়কই যমের দুয়ার।

বিভিন্ন যান দূর্ঘটনার মধ্যে আবার অন্যতম হয়ে উঠেছে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ক্ষেত্রে বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে এ বাহনটি। দ্রুতগতির এ বাহনটি বর্তমানে ‘সড়কের আপদ’ হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর রোজার ঈদে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহর থেকে নাড়ির টানে স্রোতের মতো মানুষ বাড়ি যান এবং আবার ঈদোৎসব শেষে কর্মস্থলে ফিরে আসেন। বাড়ি যাওয়া-আসার ভোগান্তির কারণে এ সময় মোটরসাইকেলে করে দূরপাল্লায় যাত্রার প্রবণতা বাড়ছে। তাই একটা বিশাল সংখ্যা মোটরসাইকেলে করে রোজার ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসা করেন। যার কারণে এ সময় সড়কে যানবাহনের চাপ বেশি হওয়ায় দুর্ঘটনার সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। আর এ বাহনটির দুর্ঘটনার জন্য বেশির ভাগ দায়ী চালকেরা এবং মোটরসাইকেল দূর্ঘটনাই প্রাণ হারাচ্ছে যারা, তারা অধিকাংশই বয়সে তরুণ। আবার এ তরুণদের মধ্যে অধিকাংশই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুুয়া শিক্ষার্থী। বিভিন্ন সড়কের দূর্ঘটনা থেকে যে এ তরুণেরা কোনো শিক্ষা নিচ্ছে না, প্রতিনিয়ত সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাই তার প্রমাণ। এরা মোটরসাইকেল দূর্ঘটনা ঘটিয়ে নিজেরাও মরছে অপরকেও মারছে এবং নিজের পরিবারকে বিপদগ্রস্থ ও শোকগ্রস্থ করছে।

গত ২ মে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক দুর্ঘটনা এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু সম্পর্কে এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে। উক্ত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ঈদুল ফিতরের ১৫ দিনে (১৫-২৯ এপ্রিল) দেশে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ১৬৭ জনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। অর্থাৎ এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। ১৬৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৭ জন নিহত এবং ১২০ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৫৪.৩ শতাংশ, নিহতের ৫১ শতাংশ ও আহতের ২১.৩ শতাংশ প্রায়। মূলত বর্তমানে সড়কে ক্যান্সারের মতো মোটরসাইকেল বেড়ে যাওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে, তার অল্পই সংবাদ মাধ্যমে আসে, বাকিগুলো অজ্ঞাত থেকে যায়। ফলে এসব দুর্ঘটনার সব হিসেব রাখা সম্ভব হয় না।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক জানান, এবারের ঈদে শুধুমাত্র ঈদের দিনে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণেই দুর্ঘটনায় আহত ২১৬ জন যাত্রী পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯৬ জনের অবস্থা খুবই গুরুতর। ঈদের দ্বিতীয় দিন দুপুর ২টা পর্যন্ত ১০৫ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে ৩৫ জনের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর। কেবল পঙ্গু হাসপাতালে এ ২ দিনে ভর্তি রোগীর সমপরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনার খবরও সংবাদপত্রে আসেনি। ফলে এসব দুর্ঘটনার ভয়াবহতার খবর আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরতেও পারিনি। এ পরিসংখ্যান সড়ক দুর্ঘটনার একটা নমুনা মাত্র। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারের বিগত ১৪ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে দেশের সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। যার কারণে ভোগান্তি কমার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমেছে এবং ২০২২ সালের তুলনায়ও সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমেছে। এছাড়া ঢাকার গণমাধ্যম কর্মীদের সংগঠন শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) পর্যবেক্ষণ ও জরিপেও উঠে এসেছে, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির দিক থেকে মোটরসাইকেলের অবস্থান শীর্ষে। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে ৫২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫৭৯ জন, যা মোট দুর্ঘটনা ও নিহতের যথাক্রমে ৪০.৪৭ ও ৩৯.০১ শতাংশ। দু’চাকার এ ক্ষুদ্র যানবাহনে গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছেন ৬ জনেরও (৬.৪৩) বেশি মানুষ। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু মার্চে সর্বাধিক ৪৭৯টি দুর্ঘটনায় নিহত ৫৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ১০২ জন।

বিআরটিএ’র নিবন্ধন থেকে জানা যায়-শুধু ঢাকায় ১৫ লাখ এবং ঢাকার বাইরে ২০ লাখ মোটরসাইকেল দেশের আনাচে-কানাচে চলাচল করছে। এছাড়া রেজিস্ট্রেশন ছাড়া চলাচল করছে আরও কয়েক লাখ। অনেকে আবার মোটরসাইকেলে স্ত্রী-সন্তান, লাগেজ-ব্যাগেজ নিয়ে ভারসাম্যহীন অবস্থায় বেপরোয়াভাবে বাস-কারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ছে। এমনিতে আমাদের বিপুল জনসংখ্যার দেশে মোটরসাইকেল অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়ায় এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কারণেও মোটরসাইকেল সংস্কৃতি চরমভাবে বেড়ে চলেছে। বেপরোয়া এ বাহনটির ধাক্কায় পথচারিও হতাহত হচ্ছেন।

এছাড়া কিছু কিছু মোটরসাইকেল চালকের দাপটে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। প্রতিটি রাস্তায় এদের দৌড়াত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলছে। মোটরসাইকেল চালনাতে এমনিতেই এদের জ্ঞানের অভাব, তার উপর এরা উপযুক্ত সরঞ্জামও ব্যবহার করতে চায় না। এরা হেলমেট না পড়েই কয়েকজন বন্ধু মিলে মেইনরোডে প্রতিযোগীতায় নেমে পড়ে।

সন্তানের প্রতি প্রেমান্ধ এমন কিছু অভিভাবককে ভুল বুঝিয়ে, বিভিন্ন বায়না ধরে, ফুসলিয়ে বন্ধুদের কাছে নিজেকে জাহির করতে এরা নতুন নতুন মডেলের মোটরসাইকেল চালাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। এমন অভিভাবকদের প্রশ্রয়ে এদের দৌড়াত্ম্য ক্রমশ বেড়েই চলছে।

নিয়ম না মেনে এ মোটরসাইকেল চালনা সাধারণ পথচারী ও অন্যান্য যান চলাচলেও বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এছাড়া অধিকাংশের প্রায় মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি, বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণ না থাকা, রাস্তার সিগনাল ও প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে এরা উদাসীন ও অজ্ঞ। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে নেতাকর্মীরা আইনের তোয়াক্কা না করে দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হচ্ছে। ফলে সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা দিনদিন বেড়ে চলছে। তার উপর পুলিশ ও পরিবহন সংস্থার তেমন কোনো তল্লাশিও চোখে পড়েনা। মাঝে মাঝে কিছু তল্লাশি দেখা গেলেও তা মোটরসাইকেল দূর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত নয়। ফলে এরা ইচ্ছেমেতো এ বাহনটি চালাতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনে।

এ ব্যাপারে উঠতি তরুণদের মধ্যে এক ধরণের রোমাঞ্চ ও নিজেকে নায়ক নায়ক ভাবার মতো তত্ত্ব কাজ করে। কিন্তু এমন যানটি চালানোর জন্য নিজেদের সন্তানদের ক্ষমতা, মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা আছে কিনা, তা না ভেবেই অনেক স্নেহান্ধ অভিভাবক নিছক শখের বসে সন্তানদের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দেন। ফলে অদক্ষ, অযোগ্য ও চঞ্চলতার কারণে সন্তানেরা এমন দূর্ঘটনার কবলে পড়ে।

কিছুদিন আগে আমার এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় সন্তানের মোটরসাইকেল কেনার আবদার রক্ষা করতে গিয়ে ‘মেইনরোডে কোনোদিন চালাবে না’ এমন সত্ত্বে মোটরসাইকেল কিনে দেন। কেনার পর প্রথমদিন দু’লাখ টাকারও অধিকমূল্য দিয়ে কেনা বড় ও অত্যাধুনিক দ্রুতগতির বাহনটি নিয়ে মেইনরোডে উঠার কিছুক্ষণ পর দানবীয় ট্রাকের নিচে ঢুকে পড়ে জীবনলীলা সাঙ্গ করে।

এ উঠতি তরুণেরা এভাবে মৃত্যুমূখে পতিত হওয়ার কারণে দেশের মানবসম্পদের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশের স্বার্থে এ উঠতি প্রজন্মকে বাঁচানো প্রয়োজন। আর এদের বাঁচাতে প্রথমে প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতন হওয়া। অনভিজ্ঞ সন্তানকে স্নেহান্ধ হয়ে একটি মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার আগে ভাবতে হবে, এ যানটা নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা এবং মানসিক দক্ষতা তার সন্তানের আছে কিনা বা যানটি আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা অথবা এ যানটি দ্বারা তার সন্তানের কোনো ক্ষতি হতে পারে কিনা। এরপর দায় থাকে পুলিশ প্রশাসন ও সড়ক পরিবহন সংস্থার উপর। এ সকল বিভাগগুলোর নজরদারি আরো অনেক বাড়ানোসহ নিয়মিত তল্লাশির আওতায় আনতে হবে দেশের প্রতিটি সড়ক-মহাসড়ক।

এরপর এ তরুণেরা যে দেশের ও সমাজের সম্পদ, মোটরসাইকেল চালানো ছাড়াও যে তাদের সমাজ ও দেশের প্রতি অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে এমন মোটিভেশন দেওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যেগ গ্রহণ করা জরুরি। পাশাপাশি সড়ক-মহাসড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণ করে মোটরসাইকেল চলাচলে নিরুৎসাহিত করা, অপ্রাপ্তবয়স্করা যেন এ বাহনটি চালাতে না পারে সেজন্য কঠোর আইনী পদক্ষেপ নেওয়া এবং সরকারের উচিত, গণপরিবহণ বাড়িয়ে সেবার মান উন্নত, সহজ ও সাশ্রয়ী করে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা। তাহলে এমন অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতে পারে।

লেখক :শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test