E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আত্মমানবতার সেবক মহাত্মা হেনরি ডুনান্টের জন্মদিন

২০২৩ মে ০৮ ১৫:১৭:৫৬
আত্মমানবতার সেবক মহাত্মা হেনরি ডুনান্টের জন্মদিন

গোপাল নাথ বাবুল


বিশ্বে আর্তের সেবায় প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রেডক্রস-এর প্রতিষ্ঠাতা মানবদরদী মহাত্মা জিন হেনরি ডুনান্ট ৮ মে, ১৮২৮ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের রু-ভারদেইনির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম জিন জ্যাকুয়াস ডুনান্ট এবং মায়ের নাম এন্টো ইনেট ডুনান্ট। মানবতার সেবক স্যার হেনরী ডুনান্টের ১৯৫তম জন্ম দিবসে জানাই শুভেচ্ছা ও গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। 

আর্তমানবতার তরে তাঁর অনেক সৃষ্টির মধ্যে বড় অবদান ‘রেডক্রস’ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ১৯০১ সালে সর্বপ্রথম শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। ২৪ জুন, ১৮৫৯ সালে ইতালির উত্তর সীমান্তবর্তী ছোট শহর সলফেরিনোতে ইউরোপের দুই বৃহৎশক্তি ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ার মধ্যে মাত্র ১৫ ঘন্টার তুমুল যুদ্ধে সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফ্রান্স জয়লাভ করে। একদিকে বিজয়ী শক্তির উম্মত্ত বিজয়োৎসব, অন্যদিকে ৪৫ হাজারের মতো আহতদের যন্ত্রনাদায়ক আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তখন সম্রাট নেপোলিয়নের সাথে ব্যবসা সম্পর্কিত জরুরী প্রয়োজনে সাক্ষাতের অভিপ্রায়ে স্যার হেনরী ডুনান্ট সলফেরিনোতে যান এবং স্বচক্ষে যুদ্ধের বিভীষিকা অবলোকন করেন। এ মর্মান্তিক দৃশ্য তাঁর হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তিনি তাঁর সকল কর্মসূচী বাতিল করে ‘সকলে ভাই ভাই’ শ্লোগান দিয়ে স্থানীয় নারীদের নিয়ে যুদ্ধে উভয়পক্ষের হতাহত প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের সেবার প্রয়াস চালান । আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করে হাল্কা পানি ও খাবারের ব্যবস্থা করেন। এমন সেবা পেয়ে হাজার হাজার সৈন্য ওই সময় মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান।

১৮৫৯ সালের জুলাইতে তিনি জেনেভায় ফিরে গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে একটি বই লিখে বিশ্বব্যাপী আর্তমানবতার সেবামূলক নিরপেক্ষ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলতে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানান, যা ১৯৬২ সালে ‘সলফেরিনোর স্মৃতিকথা’ নামে প্রকাশিত হয়। স্যার হেনরি ডুনান্ট তাঁর বইটিতে দু’টি প্রস্তাব তুলে ধরেন।

১। প্রত্যেকটি দেশে স্থায়ীভাবে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রস্তুত করা যা যুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধে হতাহতের শুশ্রুষা প্রদান করবে।

২। প্রতিটি দেশেই যুদ্ধকালে এ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও যোদ্ধাহতদের রক্ষায় নিরপেক্ষ উদ্যোগ গ্রহণের অঙ্গীকার করবে।

স্যার হেনরি ডুনান্টের প্রস্তাব বিবেচনায় সুইস জুরিস্ট গুস্তাব ময়নার নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত করা হয় এবং এ কমিটি ১৮৬৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এক সভায় মিলিত হয়। ১৯৬৩ সালের ২৬ অক্টোবর জেনেভায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গঠিত রেডক্রসই হচ্ছে আইসিআরসি সংগঠনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ডের ২৫ জন নাগরিক নিয়ে এ কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালের ২২ আগস্ট জেনেভায় ১৬ দেশের কুটনৈতিক পর্যায়ে এক বৈঠক হয় এবং যুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধাহতের সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১০ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির জন্য একটি স্বতন্ত্র ও সাধারণ প্রতীকের প্রস্তাব করা হয়।

এ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার সময় প্রথম পর্যায়ে স্যার হেনরি ডুনান্টসহ সবাই সুইজারল্যান্ডের নাগরকি ছিলেন এবং সুইজারল্যান্ডও রাষ্ট্রীয়ভাবে এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাই পতাকা নির্বাচনে সুইজারল্যান্ডের কথা মাথায় রেখে রক্তরাজ জমিনে সাদা ক্রস যুক্ত সুইস জাতীয় পতাকার স্থলে সাদা জমিনে লাল ক্রসকে প্রথম পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র প্রতীক ও পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এমনিভাবে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক আর্তের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘রেডক্রস’ জন্মলাভ করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সদস্য সংখ্যা ১৮৮ এবং পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৯৮ মিলিয়নের বেশি নিবেদিত নারী-পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত আছেন। প্রতিষ্ঠানটির সফল মানবিক কর্মকান্ডের জন্য ১৯১৭, ১৯৪৪ ও ১৯৬৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়।

১৯৩৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় স্থায়ীভাবে রেডক্রসের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। এ পর্যন্ত ৪টি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ২২ আগস্ট, ১৯৪৯ সালে অনুষ্ঠিত কনভেনশনে পূর্ববর্তী সকল কনভেনশনের বিধিসমূহ চুড়ান্ত করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি সমূহের সমন্বয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি) গঠিত হয় এবং ১৯৬৫ সালের অক্টোবরে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ২০তম আন্তর্জাতিক রেডক্রস সম্মেলনে রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট আন্দোলনের ৭টি মূলনীতি গৃহীত হয় (১. মানবতা, ২. পক্ষপাতহীনতা, ৩. নিরপেক্ষতা, ৪. স্বাধীনতা, ৫. স্বেচ্ছামূলক সেবা, ৬. একতা, ৭. সর্বজনীনতা) এবং ১৯৮৬ সালে ২৫তম আন্তর্জাতিক রেডক্রস সম্মেলনে মূলনীতিসমূহ সংগঠনের বিধিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

১৯৯৯ সালে রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আন্তর্জাতিক সম্মেলনকালে সদস্য দেশসমূহ একটি অভিন্ন প্রতীকের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। ফলে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে জেনেভায় অনুষ্ঠিত কুটনৈতিক পর্যায়ে সম্মেলনে ‘প্রটোকল-৩’ এর আওতায় একটি নতুন নিরপেক্ষ প্রতীক হিসেবে ‘রেড ক্রিস্টাল’ গৃহীত হয়। মানবতার সেবক হেনরী ডুনান্ট ১৯১০ সালের ৩০ অক্টোবর ৮৩ বছর বয়সে সুইজারল্যান্ডের নিভৃত পল্লী হেইডেনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সুতরাং প্রতিটি যুদ্ধের ভয়াবহতায় যখন পুরো যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে এবং মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর ও বিপন্ন মানুষের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, তখন আশার আলো হয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠানটির স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ। তাই রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট আজকের বিশ্বে অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর্তের সেবায় সদা জাগ্রত রেডক্রসের ¯্রষ্টা, প্রস্তাবক এবং এক বিচিত্র জীবনের প্রতিচ্ছবি মহাত্মা স্যার জীন হেনরি ডুনান্টের জন্ম দিবসে পুনরায় জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক :শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test