E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের ধারনা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু আলো

২০২৩ মে ১৫ ১৬:৫৭:১০
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের ধারনা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু আলো

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


১৬ মে আন্তর্জাতিক আলোক দিবস ২০২৩। এর মূল উদ্দেশ্য হলো পদার্থবিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ার থিওডোর মাইমানের ১৯৬০ সালে লেজারের প্রথম সফল অপারেশনটির উপলক্ষে প্রতিবছর ১৬ ই মে তারিখটিতে আন্তর্জাতিক আলোক দিবস (আইডিএল) পালিত হয়। বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শিল্প, শিক্ষা, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এবং ইউনেস্কোর ‘শিক্ষা, সাম্যতা এবং শান্তিতে সাফল্য অর্জনের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং শক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের জন্য দিনটিকে উদযাপিত করা হয়। আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আলো-ভিত্তিক প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে বিশ্ব সচেতনতা গড়ে তোলা।

আলো কি?

সমস্ত আলো সূর্য থেকে আসে, বা যা বৈজ্ঞানিকভাবে সূর্যের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বর্ণালী হিসাবে পরিচিত। ফ্রিকোয়েন্সিগুলির এই পরিসরটি আমাদের মহাবিশ্বের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণের বিভিন্ন রূপের সাথে মিলে যায়।লোকেরা যখন আলোর কথা বলে, তখন তারা সাধারণত দৃশ্যমান ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বর্ণালী থেকে আলোর কথা বলে। তবে বেশিরভাগ আলো দেখা যায় না। দৃশ্যমান আলোর পাশাপাশি, বর্ণালীতে রেডিও তরঙ্গ, মাইক্রোওয়েভ, ইনফ্রারেড, অতিবেগুনী, এক্স-রে এবং গামা-রশ্মিও রয়েছে—যার কোনোটিই মানুষের চোখে দেখা যায় না। দৃশ্যমান আলো প্রায়৩৮০ এবং ৭৫০ ন্যানোমিটারের মধ্যে পড়ে (ইনফ্রারেড এবং অতিবেগুনী মধ্যে), এবং একমাত্র আলো যা আমরা দেখতে পারি।

আলো কেন গুরুত্বপূর্ণ?

আলো সুস্পষ্ট কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছাড়া, উদ্ভিদের জীবন সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করতে সক্ষম হবে না, একটি প্রক্রিয়া যেখানে উদ্ভিদ কার্বন ডাই অক্সাইড এবং জল থেকে খাদ্য সংশ্লেষ করতে সূর্য থেকে আলো ব্যবহার করে। যাইহোক, আলো গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার আরও অনেক কারণ রয়েছে, যা এতটা স্পষ্ট নয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেক লোক বুঝতে পারে না যে আজকের অনেক প্রযুক্তি আলো ব্যবহার করে।

আলোর অধ্যয়ন কি?

আলোর অধ্যয়ন, যা "অপটিক্স" নামেও পরিচিত, এটি পদার্থবিদ্যার একটি শাখা যা আলোর আচরণ এবং বৈশিষ্ট্যগুলি পরীক্ষা করে, এটি কীভাবে পদার্থের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে এবং লেজারের মতো আলো-ভিত্তিক সরঞ্জামগুলির বিকাশ সহ। সৌর শক্তি, চিকিৎসা ডায়াগনস্টিক টেকনোলজি এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তির মতো সবুজ শক্তির উত্সগুলির বিকাশের মাধ্যমে অপটিক্সের ক্ষেত্রটি প্রযুক্তির অগ্রগতিতে একটি বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, ফাইবার-অপটিক কেবল, যেগুলি ডেটা প্রেরণের জন্য অতি-দ্রুত আলোর স্পন্দন ব্যবহার করে, যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।এই উদ্যোগের সাফল্যকে ভিত হিসেবে ব্যবহার করে ইউনেস্কো-র এক্সিকিউটিভ বোর্ডের সামনে ‘আন্তর্জাতিক আলোক দিবস’ পালন করার একটি প্রস্তাব পেশ করে ঘানা, মেক্সিকো, এবং রাশিয়া। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেস্কো-র সদর দফতরে এই প্রস্তাব গৃহীত হয় ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, এবং ৭ নভেম্বর, ২০১৭ এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করে ইউনেস্কো-র সাধারণ সম্মেলন। যার ফলে প্রথম আন্তর্জাতিক আলোক দিবস উদযাপিত হয় ১৬ মে, ২০১৮।

কারা এর আয়োজন করছে?

আন্তর্জাতিক আলোক দিবস আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল বেসিক সায়েন্স প্রোগ্রাম বা আইবিএসপি। এই আয়োজনের পরিচালনা কমিটিতে ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা যেমন রয়েছেন, তেমনি আছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহযোগী সংগঠনগুলোর সদস্যবৃন্দ। প্রতিটি দেশের একটি করে সহযোগী সংগঠন ন্যাশনাল নোড হিসেবে কাজ করে। ওই সংগঠন মূলত সংশ্লিষ্ট দেশের সকল আয়োজন সমন্বয় করে। বাংলাদেশের ন্যাশনাল নোড হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি (এসপিএসবি)।

আলোক দিবসের প্রধান যত বিষয়

ফোটোনিকস বিজ্ঞানের ধারনা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু আলো। শত শত বছর ধরে আলো আর তার বৈশিষ্টসমূহ বিজ্ঞানের জগতে তোলপাড় তুলে এসেছে। ইবনে আল হাইথাম থেকে আইনস্টাইন পর্যন্ত সকলেই আলো নিয়ে কাজ করে গেছেন।

গামা রশ্মি থেকে রেডিও তরঙ্গ, আলোকবর্ণালী আমাদের সামনে তুলে ধরেছে বিশ্বের সৃষ্টিরহস্য থেকে আজকের পৃথিবী বদলে দেয়া প্রযুক্তি পর্যন্ত। ন্যানোফোটোনিক কিংবা কোয়ান্টাম অপটিকসের উচ্চতর গবেষণা মেলে ধরেছে নতুন সব আবিষ্কারের সুযোগ আর বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখা।

আলোকভিত্তিক প্রযুক্তি আর ফোটোনিকস সরাসরি মানবজাতির কাজে লাগছে, দিচ্ছে তথ্যভান্ডারে অবাধ প্রবেশাধিকার, টেকসই উন্নয়ন ও উচ্চতর জীবনমান।

ফোটোনিকস ভিত্তিক শিল্পগুলো হয়ে উঠছে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। উন্নততর ঔষধ, কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা ও শক্তি উৎপাদনে ফোটোনিকসের ব্যবহার সমাজে নিয়ে আসছে ইতিবাচক পরিবর্তন।

দৃষ্টিশক্তি উন্নয়নের প্রযুক্তি থেকে হাতের স্মার্টফোনটি, মহাকাশ পর্যবেক্ষন প্রযুক্তি থেকে শুরু করে ইন্টারনেট বিপ্লবের ফাইবার অপটিক কেবল – ফোটোনিকসের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেন সর্বব্যাপী।

আলো ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা

আলোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত প্রয়োগ সমাজের সমাজের উন্নয়ন ও ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। ক্রমবর্ধনমান সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার্থে এর প্রয়োজনীয়তাও অসীম। বিশ্বের শক্তি উৎপাদন, টেকসই উন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্য সংরক্ষনে ফোটোনিকস ব্যবহারিক ও সাশ্রয়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তথা “দারিদ্র দূরীকরন, অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলার লক্ষ্যে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহন” অর্জনের সংগ্রামেও ফোটোনিকস এক অন্যতম হাতিয়ার।

ফোটোনিকস বিশ্বের নাগরিকদের ইন্টারনেট ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যমে যুক্ত রাখে। ব্যবসা ও শিক্ষার এক অপরিহার্য অংশ হয়ে পড়েছে এখন ফোটোনিকস। এই নেটওয়ার্ক জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে ন্যায়বিচার, শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা তথা শান্তি নিশ্চিত করে। আলোকপ্রযুক্তি চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যতম চাবিকাঠি। রোগনির্নয় থেকে শুরু করে উন্নত রোগনিরাময় প্রক্রিয়া ও গবেষণা, সবকিছুতেই রয়েছে আলোকপ্রযুক্তির বিবিধ ব্যবহার। রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি জন্ম দেয় টেকসই কৃষিব্যবস্থার, যা বিশ্বের ক্ষুধা নিবারনের অন্যমত হাতিয়ার। একই সাথে টেকসই কৃষিব্যবস্থা জলাশয় ও সাগরের জীববৈচিত্র্য রক্ষার অন্যতম নিয়ামক। আধুনিক আলোকব্যবস্থা জীবনযাত্রার মানোয়ন্নে কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব সমাধান দিতে পারে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মনিটর করা ও এর প্রভাব অনুমান করার জন্য আলোক ভিত্তিক কার্যকর সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষা

আলো একটি অনুপ্রেরণামূলক বিষয় হওয়ায় তরুণদের বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করার উৎকৃষ্ট উপায়। বিশ্বব্যাপী শিশুদের উদ্দ্যেশ্যে করা আলোক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কর্মসূচি, লিঙ্গ বৈষম্যজনিত সমস্যা তুলে ধরে এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশকে কেন্দ্র করে শিক্ষা্র সুযোগ গড়ে তোলে।

উদ্ভাবন ও উদ্যোগ

বিজ্ঞান ও আলোর বহুবিধ প্রয়োগ স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় উদ্ভাবনের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে আসছে, এমনকি সংকটপূর্ণ পরিবেশেও। আলো ও এ সম্পর্কিত জ্ঞান ও শিক্ষা নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী করার পাশাপাশি তাদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠারও প্রেরণা দেয়।

সংস্কৃতি

আলো মানুষের সংস্কৃতিতে যুগ যুগ ধরে প্রভাব ফেলে আসছে, এবং এখনও ফেলছে। আলো ও সংস্কৃতির যোগসূত্রকে ইসলামের স্বর্নযুগ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত স্টাডি করলে বিজ্ঞান, শিল্প ও মানবিকতার মধ্যকার সম্পর্ককে নতুন আলোয় চেনার এবং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভালভাবে বোঝার ও জানার সুযোগ হয়ে ওঠে।

আলো সবসময়ই শিল্প-সাহিত্য ও মানুষের চিন্তাধারায় বড় ভূমিকা রেখে এসেছে। আলোর এই থিম তাই বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরির মাধ্যমে এই দুই জগতের মধ্যকার অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে দেয়ায় অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।আন্তর্জাতিক আলোক দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্য হল বিশ্বব্যাপী সমাজের বিভিন্ন সেক্টরের মানুষকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধনের মধ্য দিয়ে কিভাবে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করা যাবে তা প্রদর্শন করা।পৃথিবীতে মানুষের জীবনে শান্তির আলো পৌছে দিতে জাতিসংঘ’এর উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে।তাই আলোক দিবস পালনের মধ্যে দিয়েই আমরা আামদের দেশকে আলোকিত করতে চাই।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test