E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তুরস্কের নির্বাচনে সিনান ওগানই হতে পারেন তুরুপের তাস

২০২৩ মে ২০ ১৬:০০:৫৪
তুরস্কের নির্বাচনে সিনান ওগানই হতে পারেন তুরুপের তাস

গোপাল নাথ বাবুল


তুরস্কের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচন হয়ে গেল গত রোববার, যেটিকে আধুনিক তুরস্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন বলে বর্ণনা করেছে সংবাদ মাধ্যমগুলো। উক্ত নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয়েছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান ও বিরোধী দলীয় জোটের কামাল কিলিচদারোগলুর মধ্যে। কিন্তু তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য একজন প্রার্থীকে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হয়। না পেলে দ্বিতীয় দফা ভোটের মুখোমুখি হতে হয়। 

তুরস্কের সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিল (ওয়াইএসকে) জানায়, গত রোববারের নির্বাচনে ৮৮.৯ শতাংশ ভোট পড়ে। তার মধ্যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগান পান ৪৯.৫ শতাংশ এবং তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি বিরোধী জোটের কিলিচদারোগলু পান ৪৪.৯ শতাংশ। ৫.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছেন সিনান ওগান। প্রথম দফা ভোটের ফলাফল দেখে ইলেকশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সিনান ওগানই হয়তো তুরস্কের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠবেন। অথচ রোববারের আগ পর্যন্ত সিনান ওগানের মতো প্রান্তিক, কট্টরপন্থী ও অতিজাতীয়বাদী রাজনীতিবিদ তুরস্কের বাইরে কার্যত অপরিচিতই ছিলেন। তুরস্কের নির্বাচন যখন দ্বিতীয় দফায় অর্থাৎ আগামী ২৮ মে রান অফ ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ ঘোষণা করা হয়, তখন তিনি আলোচনার টেবিলে উঠে আসেন। অনেকে বলছেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানের ভাগ্য হয়তো সিনান ওগানের হাতে। কারণ প্রথম দফার নির্বাচনে এরদোগান এগিয়ে থাকলেও সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার মতো যথেষ্ট রায় তিনি পাননি।

আবার রান অফ ভোটের দিকে নির্বাচন গড়াতেই কামাল কিলিচদারোগলুকে নিয়েও শুরু হয়েছে নতুন আলোচনা। বলা হচ্ছে, এরদোগানকে কুর্সি থেকে সরাবেন ‘তুর্কি গান্ধী’। তাঁর চেহারার সঙ্গে ভারতের মহাত্মা গান্ধীর অদ্ভূত মিল থাকায় ভোট প্রচারে সেটা তুলে ধরা হচ্ছে। তিনি গান্ধীর মতো হুবহু একই রকমের চশমা ব্যবহার করেন। ফলে তাঁকে তুলনা করা হচ্ছে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। ইতিমধ্যে নয়া নামকরণও হয়েছে তাঁর। কেউ বলছেন ‘তুর্কির গান্ধী’, কেউ বলছেন তাঁকে ‘গান্ধী কামাল’। পাশাপাশি স্বভাবগত দিক থেকেও মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ মেনে চলেন এ রাজনীতিবিদ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিষ্টভাষী ও ন¤্র স্বভাবের মানুষ হিসেবে কামাল কিলিচদারোগলুর যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। তিনি প্রতিপক্ষকে কখনোই ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন না। সুভক্তা হওয়ায় স্বয়ং এরদোগানও তাঁর প্রশংসা করেছেন।

তবে দ্বিতীয় ধাপে গড়ানো ওই নির্বাচনে দু’প্রার্থীই বলে বেড়াচ্ছেন, বিজয় তাঁদের হাতের মুঠোয়। দু’দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিশ্চিত করেছেন, আগামী ৫ বছর তিনিই তুরস্কের ক্ষমতায় থাকছেন। আবার প্রতিপক্ষ কামাল কিলিচদারোগলু দাবী করছেন, তিনিই আগামী ৫ বছরের জন্য ক্ষমতার গদিতে বসছেন। তবে তিনি অভিযোগ করেন, সরকার গণরায়কে ঠেকিয়ে দিতে চাইছে। তাঁর দলের দুই উদীয়মান তারকা ইস্তানবুল ও আঙ্কারার মেয়রদ্বয়ও ভোটাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, এটি এমন একটি কৌশল, যা এরদোগানের ‘একে’ পার্টি আগেও ব্যবহার করেছিল।

গত কয়েক মাস ধরে তুরস্কের বিভিন্ন বিরোধী দল চেষ্টা করছেন এরদোগানের শাসনের অবসান ঘটাতে। উল্লেখ্য যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে পশ্চিমা জোটের একটা ভূমিকা থাকে। তুরস্কের এবারের নির্বাচনেও পশ্চিমা দেশের জোট ঘনিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ, বিরোধী জোটের প্রার্থী হিসেবে ৭৪ বছর বয়সি রিপাবলিকান পিপল্স পার্টির নেতা কিলিচদারোগলু তুরস্কে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি ন্যাটো মিত্রদের সঙ্গে সু-সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রপতির মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা বাতিল করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন যা জনমনে গভীর দাগ কেটেছে।

অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ইসলামপন্থী সরকার পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তাঁর পতনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করছেন। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকায় একসময় ব্যঙ্গ করে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা তুরস্ককে ১৯৭০ সাল থেকেই অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও মন্দা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসে এরদোগানের দল জাস্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি)। ক্ষমতায় বসে এরদোগান অর্থনৈতিক ও কুটনৈতিকভাবে পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেন। তিনি তুরস্ক থেকে দারিদ্র বিদায় করেন, ব্যাপক কর্মসংস্থান করেন, এক দশক আগে তিন অংকে থাকা মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনেন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুর্কি মুদ্রা লিরার চাহিদা বাড়ান, পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সামরিক খাতে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেন এবং গত দু’দশকে তুরস্ককে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেন। ফলে এ অর্থনৈতিক সাফল্যের সিঁড়ি বেয়েই তিনি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী থেকে অঘোষিত সুলতান হয়ে যান এবং আধুনিক তুরস্কের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের শাসকে পরিণত হন। তুরস্কের জনগণ মনে করেন, বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময় চলা মোস্তফা কামাল আতার্তুক পন্থীদের শাসনের চেয়ে তাঁর আমলে তারা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত জীবন-যাপন করছেন।

এরদোগান ভৌগলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ভাবমূর্তি পুননির্মাণে ও এক সময় উসমানি খেলাফতের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোর প্রতি নজর দেন। ইউরোপীয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স-এর (ইসিএফআর) অ্যাসোসিয়েট সিনিয়র পলিসি ফেলো আসলি আইদিনতাসবাস তাঁর ‘রাজনীতির ঘোরাটোপ: মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্যের খোঁজে তুরস্ক’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, তুরস্কের এ প্রচেষ্ঠা তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে লিবিয়া থেকে সিরিয়া এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত বড় লড়াই’র সীমারেখা তৈরি করে। প্যালেস্টাইন থেকে কাশ্মীর আর বসনিয়া থেকে জিনজিয়াং-এ মুসলিমদের উপর নিপীড়নের বিষয়েও তিনি সোচ্চার হয়েছেন।

২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিজের গায়ে আগুন দিয়ে বিপ্লবের মশাল জ্বালিয়ে আরব বসন্তের সূচনা করেন তিউনিশিয়ার নাগরিক মহম্মদ বুয়াজিজি। ঘুষ দূর্নীতি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ওই বিদ্রোহের আগুন আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে রাজনীতির মাঠে পাকা খেলোয়াড় এরদোগান তাতে সমর্থন দেন। ফলে তুরস্কের বিরুদ্ধে এক হন আরব বিশ্বের স্বৈরশাসকরা। চোখে চোখ রেখে লড়তে থাকেন মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান নেতা সংযুক্ত আরব-আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মহম্মদ বিন জায়েদ। সুন্নী মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে আগে থেকেই প্রতিপক্ষ ছিল সৌদিআরব। এছাড়া সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে ইস্তাম্বুল কনস্যুলেটে নৃশংসভাবে হত্যার জন্যও এরদোগান সৌদি যুবরাজ সালমানকে দায়ী করায় দু’দেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। ফলে সৌদি-আমিরাত জোট তুরস্কের পণ্য আমদানির ওপর অঘোষিত অবরোধ আরোপ করে অর্থনৈতিকভাবে তুরস্ককে দুর্বল করার প্রক্রিয়া শুরু করে।

এ সময় মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত বাড়তে থাকে এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে। বর্তমানে মার্কিন ডলারের বিপরীতে লিরার বিনিময় হার সবচেয়ে দুর্বল। তুরস্কের অর্থনীতিতে এখন ৪৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি চলছে। ফলে মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয়-সঙ্কটে ভুগছেন। যার জন্য এরদোগানের ‘অপ্রথাগত অর্থনৈতিক নীতি’ দায়ী বলে মনে করেন তুরস্কের জনগণ। এর পাশাপাশি, গত ফেব্রুয়ারিতে পরপর দু’বার ভূমিকম্পের সময় ধীর গতিতে উদ্ধার অভিযানের জন্যও এরদোগানকে দায়ী করা হয়েছে। ওই ভূমিকম্পে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান।

তবে এরদোগান আসল ধাক্কাটি খেয়েছিলেন ২০১৩ সালে। ওই বছর গেজি পার্ক গুঁড়িয়ে দিয়ে শপিংমল বানানোর উদ্যেগের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ শুরু হলে এরদোগান কঠোর হাতে এ বিক্ষোভ দমন করলে পশ্চিমা বিশ্ব সরব হয়। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে এরদোগানের দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে পেছন দিকে হাঁটতে থাকে। তিনি নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সংসদীয় ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৪ সালে সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি বনে যান। এমন পদক্ষেপের বিরোধীতা শুধু বিরোধীরাই করেন নি, নিজের দল থেকেও প্রতিবাদ আসে। ফলে তার এক সময়ের বিশ্বস্ত সঙ্গীরা তাকে ছেড়ে যান।

২০১৬ সালে এরদোগানের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যূত্থান চেষ্টার পর তিনি শক্তিশালী জেনারেলদের কোণঠাসা ও সেনাবাহিনীকে অকার্যকর করে রাখেন এবং তার বিরুদ্ধে যাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনেন। তিনি কঠোরভাবে ভিন্নমত দমন করেন এবং বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হন। এ ব্যর্থ অভ্যূত্থানের জন্য তিনি তার এক সময়ের বিশ্বস্ত মিত্র ফেতুল্লাহ গুলেনকে দায়ী করেন। এরপর থেকেই তুরস্কের অর্থনীতিতে আরো বড় বিপর্যয় দেখা দেয়। বিরোধীদের দমন-পীড়নের অভিযোগের পশ্চিমাদের অঘোষিত অবরোধ শুরু হয়। বিনিয়োগে আগ্রহ হারায় পশ্চিমা কোম্পানীগুলো। ১৪০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ স্থগিত করে ভক্সওয়াগানের মতো জায়ান্ট গাড়ি নির্মাতা কোম্পানী।

এছাড়া ন্যাটো সদস্য হয়েও সিরিয়ায় তুরস্কের সৈন্য পাঠানো যুক্তরাষ্ট্র মোটেই পছন্দ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়া উত্তর সিরিয়ার কুর্দি এলাকা রাশিয়ার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ায় এরদোগানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হয়। এছাড়া গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর মস্কোয় রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু, তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকর, সিরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলী মাহমুদ আব্বাসের মধ্যকার বৈঠককেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব ভালোভাবে নেয় নি। এসব কারণে তুরস্কের ক্ষমতায় পুনরায় এরদোগান আসুক, এটা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব চায় না।

তবে কামাল আতাতুর্কের হাতে আধুনিক তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পর তুর্কি সমাজ কতটা বিভক্ত তা প্রথম পর্বের ভোটের ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে। আগামী ২৮ মে দ্বিতীয় পর্বের ভোট। দ্বিতীয় পর্বের ভোটে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট যদি কোনো প্রার্থী না পান, তাহলে তৃতীয় প্রার্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী সিনান ওগান হবেন দু’পক্ষের কাছে তুরুপের তাস। দু’পক্ষই চেষ্টা করবে তার মন জয় করতে।

লেখক :শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test