E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

এটা সারাবিশ্বের গল্প

২০২৩ মে ২৮ ১৫:৪৬:২৩
এটা সারাবিশ্বের গল্প

গোপাল নাথ বাবুল


‘দ্য কেরালা স্টোরী’পরিচালক সুদীপ্ত সেনের প্রথম বাণিজ্যিক ছবি। ছবিটির এক ঝলক সামনে আসার পর থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। ছবিটির প্রেক্ষাপট পশ্চিম এশিয়ার কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন আইসিস-কে ঘিরে। কেরল থেকে একদল অমুসলিম মেয়ে কীভাবে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে পৌঁছে যান এবং সর্বোপরি তাদের কী পরিণতি হয়, এ গল্পে পরিচালক তাই বলেছেন। 

পরিচালক কেরল রাজ্যের এ মুভিতে বলেছেন তিনজন নারীর গল্প, যাদের মনে অনেক আশা ছিল, জীবনে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কেরলের একটি নার্সিং কলেজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এ কাহিনী। তিনটি মেয়ে নার্সিং কলেজে পড়ার জন্য প্রথমবার বাড়ির বাইরে পা রাখেন। হোস্টেলে তাদের রুমমেট অর্থাৎ আইএসআইএসের এক ছদ্মবেশি ছাত্রীর হাত ধরে তারা পা দেন এক নতুন জীবনে। আইসিস্-এর সদস্য ও ছদ্মবেশি ছাত্রীটি কর্তৃক শুরু হয় অমুসলিম তিনজন মেয়ের মগজ ধোলাই। ওই রুমমেটের প্ররোচনায় শালিনী নামক হিন্দু মেয়েটি আরেক আইসিস-এর সক্রিয় কর্মী এক মুসলিম যুবকের প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে প্রেগন্যান্ট হন। পরবর্তীতে অনন্যোপায় হয়ে বিয়ের শর্তে ফাতেমা নাম ধারণ করে শালিনী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তারপর পরিকল্পনা মতো ওই যুবক নিরুদ্দেশ হয়। পরবর্তীতে বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক সন্ত্রাসী সংগঠন আইসিস-এর পক্ষে যুদ্ধ করতে তিনজন মেয়েকেই পাঠানো হয় সিরিয়ায়। পরে ধরা পড়লে শালিনী সব ঘটনা শোনায়। এটাই হলো ‘দ্য কেরল স্টোরী’ গল্পের প্রতিপাদ্য বিষয়।

বলা যায়, এ সিনেমাটি শুধু কেরল বা ভারতের গল্প নয়, এটা সারাবিশ্বের গল্প। কেউ কেউ এ সিনেমার গল্পকে একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বলে অভিযোগ করলেও তা সত্যি নয়। এতে কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কোনো সংলাপ নেই। এতে যা আছে তা হলো, জঙ্গীবাদের নগ্ন চিত্র এবং কেরলের অমুসলিম মেয়েদের কীভাবে কৌশলে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তরিত করে সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়, তার গল্প। পরিচালক বারবার দাবী করে আসছেন, চলচ্চিত্রটি মোটেও কোনো কাল্পনিক কাহিনী নয়, বরং প্রত্যেকটি চরিত্র, সংলাপ সত্য ঘটনা অবলম্বনে। চলচ্চিত্রটির কয়েকটি সংলাপ ও দৃশ্য খুবই হৃদয়বিদারক, নির্মম ও ভয়ানকও বটে।

এরই মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে এ সিনেমার এক চরিত্র সিদ্দি ইদনানির সংলাপটি, যা এখন সারাবিশ্বে লোকের মুখে মুখে ফিরছে। চলচ্চিত্রে বর্ণিত লাভ জিহাদের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করে বাড়ি ফিরে এসে কাঁদতে কাঁদতে মুভিটির অন্যতম চরিত্র তার কমিউনিস্ট বাবাকে বলেন, ‘পাপা, এটা আপনার দোষ যে আপনি আমাদের অনেক কিছু বলেছিলেন, কিন্তু ধর্ম কি সে সম্পর্কে তো কখনো বলেননি।’

চিত্র নির্মাতার কথার সত্যতা পাওয়া যায়, ২০০৬ সালে কেরলের তৎকালীন কংগ্রেসের মূখ্যমন্ত্রী ওমান চান্ডির বক্তব্যে। তিনি বিধানসভায় স্বীকার করেছিলেন, প্রতিবছর আনুমানিক ২৮০০-৩২০০ মেয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছে। সে হিসেবে আজ পর্যন্ত হিসেব করলে সংখ্যাটা ৩২ হাজার পার হয়।

উল্লেখ্য, চলচ্চিত্রটির টেইলারে কেরল থেকে ৩২ হাজার মহিলা আইসিস-এ যোগদানের কথা প্রচার হয়েছে। যদিও আদালতের নির্দেশে সে অংশটি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
২০১০ সালে কেরলের আরেকজন প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রী তথা প্রবীণ বাম নেতা ভিএস অচ্যুতানন্দ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এভাবে ধর্মান্তরিত হতে থাকলে আগামী ২০ বছরে কেরল ইসলামী রাজ্যে পরিণত হবে। এক বিশ্বস্ত রিপোর্টে জানা যায়, কেরল থেকে নার্সিং পড়ার জন্য যেসব মহিলা আরবের বিভিন্ন দেশে যান, পরবর্তীতে তাদের অনেকেরই খোঁজ পাওয়া যায়নি। সুতরাং কেরলের ধর্মান্তরিতের মতো ঘটনাগুলো দিনের আলোর মতো সত্য।

কেরলের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের মেয়েও জেহাদের স্বীকার হয়ে বিয়ে করেছে ক্ষমাতাসীন সিপিআইএম-ছাত্রসংগঠনের রাজ্য সম্পাদক গিয়াসউদ্দিনকে। যাকে আবার কোনো এমপি না হওয়া সত্তেও মন্ত্রীত্ব দেওয়া হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর মেয়ে জামাই হিসেবে। চিন্তা করুন এমন ঘটনা ভারত ছাড়া কোনো মুসলিম প্রধান দেশে কোনো ক্ষমতাসীনের মেয়ের সাথে ভিন্ন ধর্মের লোকের সঙ্গে ঘটলে কী হতো ! ভাগলপুর মেডিকেলে পড়তে গিয়ে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের মেয়ের বেলায়ও এমন ঘটনা ঘটেছিল। পরবর্তীতে উনি টের পেয়ে পাটনা মেডিকেলে ট্রান্সপার করে সে যাত্রায় মেয়েকে রক্ষা করেন।

এ সকল খবর শুনে ভাবতে হয়, এ সবের জন্য কী শুধু একটি সম্প্রদায় দায়ী ? হিন্দুদের কী কোনো দায় নেই ? আমার মতে, সমানভাবে হিন্দুরাও দায়ী তাদের সন্তানদের ধর্মান্তকরণের জন্য। তারা খবর রাখেন না, তাদের স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ুুয়া সন্তানরা কোথায় যায়, কী করে ? ছোটবেলা থেকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষাও দেওয়া হয় না সন্তানদের। যা ছবিটিতে সিদ্দি ইদনানী চরিত্রটির সংলাপেও ওঠে এসেছে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কেরলের সঙ্গে ইসলামী স্টেটের যোগসূত্র প্রকাশিত হয়ে আসছে অনেক আগে থেকে। এনআইএ এবং কেরল রাজ্য পুলিশ ভারত জুড়ে এমন ১৫৫ জন জঙ্গীকে গ্রেফতার করে, যাদের যোগসূত্র ছিল কেরল এবং আইসিস-এর সঙ্গে, যা ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালে প্রকাশ করেছিল। কেরল আইসিস এবং কট্টর ইসলামী সংগঠন পিএফআই-এর জন্য ছিল খোলা বিচরণ ভূমি। যদিও কিছুদিন পূর্বে ভারত সরকার পিএফআইকে নিষিদ্ধ করে। ২০১৩ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রমাণ পায় সিরিয়ার যুদ্ধে আইসিস-এ ভারতীয়দের যোগদানের কথা। কেরল রাজ্যের কোঝিকোড এবং মালাপ্পুরমের ২টি স্বীকৃত ধর্মান্তর কেন্দ্র ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় ৬ হাজার জনকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছে, যাদের মধ্যে ৪৯১৯ জন হিন্দু এবং বাকি ১০৭৪ জন খৃষ্টান। উল্লেখ্য, ধর্মান্তরিতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী যাদের বয়স ৩৫ এর মধ্যে ছিল। যা ২০১৬ সালে দি টাইমস্ অব ইন্ডিয়া’য় প্রকাশ হয়েছিল।

আমেরিকার দ্য ব্যুরো অব কাউন্টার টেরোরিজমের মতে, ভারতে ২০২০ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা এনআইএ সন্ত্রাসবাদী-যোগে ৩৪টি মামলায় ১৬০ জনকে গ্রেফতার করেছে। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন বলেছে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আইসিসপন্থী প্রায় ২০০ জন যুবাকে গ্রেফতার করেছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট শিরোনামের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৬৬ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত যোদ্ধা আইসিস-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের মৌলবাদীরা যেমন ভারতকে ‘গজবা হিন্দ’-এর অংশ হিসেবে কল্পনা করে, তেমনি আইসিসও ভারতকে অনেকদিন আগে থেকেই তাদের ‘খোরাসান খিলাফত’-এর অংশ হিসেবে দেখে এসেছে।

আজ শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়। ধর্মীয় এ উগ্রতাবাদী ও ধর্মান্তকরণে সারাবিশ্ব উদ্যোগ প্রকাশ করছে। ‘দ্য কেরালা স্টোরী’র মতো চলচ্চিত্রের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গুণীজনরা। বৃটিশ হুম সেক্রেটারী সুইলা ব্রেভারম্যান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের পুরুষরা বৃটেনের ছোট ছোট মেয়েদের রেপ করছে, তাদের মগজ ধোলাই করছে এবং তাদের জীবনটা নরকে পরিণত করে দিচ্ছে।’ ডাচ পার্লামেন্টারিয়ান গীর্ট উইল্ডারস্ বলেছেন, ‘দ্য কেরালা স্টোরী’ ইউরোপের প্রত্যেকটি সিনেমা হলে দেখানো উচিত। আমাদের মেয়েদের বাঁচানো উচিত। ‘দ্য কেরালা স্টোরী’ অবশ্যই প্রত্যেকটি মানুষের দেখা উচিত।’

এ চলচ্চিত্রে যে চারজন মহিলাকে দেখানো হয়েছে, তাদের নাম যথাক্রমে শালিনী ওরফে ফাতেমা, সোমা সেবার্সোন ওরফে আয়েশা, মেরী জেকব ওরফে মারিয়ান ও রিফেলা। তাদের মধ্যে একজন হিন্দু, দু’জন খৃষ্টান, (যারা পরবর্তীতে ধর্মান্তরিত হয়েছে) ও একজন মুসলিম। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অধীন ‘এনআইএ’ যে ২০ জন কুখ্যাত আইএস জঙ্গীর নাম প্রকাশ করেছে, তাদের কেরলের ওই চারজন মহিলা ছাড়াও আরও দু’জন মহিলা আছেন। তাদের নাম আজমেলা ও শামাশিয়া। দু’জনই মুসলিম। এরা এতই ভয়ঙ্কর যে, কেন্দ্র সরকার আফগানিস্থানের কারাগারে আটক এসব মহিলাদের ভারতে ফেরার অনুমতি দেয়নি।

সুতরাং বলা যায়-দ্য কাশ্মীর ফাইলসের নজরকাড়া সাফল্যের পর দ্য কেরালা স্টোরীও রাজনৈতিক তরজার মারপ্যাঁচেও সফল। ছবিটি এত বিতর্কের মধ্যেও সমালোচকদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দু’শো কোটির ক্লাবে পৌঁছে গেছে। চলচ্চিত্র জগৎ হলো বিনোদন জগৎ। মানুষকে বিনোদন দেওয়ায় যার কাজ। মুভিটি তৈরি হয় নারী অধিকারের উদ্দেশ্যে। নারী অধিকার, নারীদের সচেতন করা ও নারীর সুরক্ষায় সিনেমাটি প্রত্যেক দেশেই মুক্তি দেওয়া উচিত। এখানে কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কোনো সংলাপ নেই। বর্তমানে সারাবিশ্বে মহাসন্ত্রাস হলো ধর্মান্তরিতকরণ এবং জেহাদী তৈরি করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন যুদ্ধে পাঠানো। ছবিটি সেটিই সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মোটামুটি যুবতীদের নেশাজাতীয় দ্রব্যের অভ্যাসজাত ব্রেনওয়াশ, ধর্মান্তকরণ, টানা ধর্ষণ, মানবপাচার, বলপূর্বক গর্ভপাতের প্রতিচ্ছবি ‘দ্য কেরালা স্টোরী’।

লেখক :শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test